যুদ্ধদিনের গল্প

সনজিত দে | বুধবার , ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৯:২৫ পূর্বাহ্ণ

রবিবার ইশকুল বন্ধ। তাই বন্ধুদের নিয়ে বাড়ির সামনের মাঠে খেলছিল রিফাতরা। হঠাৎ পেছন থেকে রিফাত এই রিফাত এই রিফাত বলে ডাকে রিফাতের আব্বু । রিফাত ঘাড় ফিরে দেখে আব্বু।
কী হল এ অবেলায় তো আব্বুর বাড়ি ফেরার কথা না।
আব্বু, ডাকছ কেন ? আব্বুর মুখ শুকনো দেখে আর কোনো প্রশ্ন না করে বাড়ি ফিরে গেল আব্বুর হাত ধরে। উঠোনে রিফাতের ছোটো বোন শিলা ও ছোটো ভাই সিফাত খেলা করছিল। রিফাতের আব্বু তাদের কাছে ডেকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। আর সবার ছোটো সিফাতকে কোলে তুলে নেয়। রিফাতের আব্বুর কান্না দেখে তিন ভাই-বোনও কেঁদে ওঠে। কান্নাটা যেন ছোঁয়াছে রূপ ধারণ করে। রিফাতরা জানে না কেন কাঁদছে তাঁরা।
ততক্ষণে রিফাতের আম্মু ঘর থেকে বেরিয়ে এল। আব্বুকে বলল কী হয়েছে ? রিফাতের আব্বু কিচ্ছু বলতে পারে না।
রিফাত কী হয়েছে ? তোরা কাঁদছিস কেন ?
জানি না আম্মু। আমি কিছুই জানি না। আমাকে আব্বু মাঠ থেকে নিয়ে এসেছে।
রিফাতের আব্বুকে কোনোদিন কাঁদতে দেখেনি বলে বিভিন্ন শংকায় আম্মু আর স্থির থাকতে পারে না। আম্মুও কেঁদে ওঠে। আব্বু এবার সবাইকে নিয়ে ঘরে ঢোকে। আম্মুকে বলে জানো শিরিন আমার এই বাগান নিয়ে জানি না কয়দিন একসাথে থাকতে পারবো।
মাথাটা ভীষণ ধরেছে। এক কাপ আদা তেজপাতা দিয়ে চা দাও। আম্মু চা বানাতে গেল। আব্বু তখন কিছুটা স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে। আমরা তিন ভাইবোন আব্বুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আব্বু কেন কাঁদছে ? আমরা কেন কাঁদছি ?
আম্মু আব্বুকে চা এনে দিল। অসময়ে আব্বুকে চা খেতে দেখিনি। আজ আব্বু আম্মুকে চা দিতে বলল। আম্মুও চা বানিয়ে দিল। আব্বু একটুও চা মুখে তুলেনি। আম্মুকে কাছে ডেকে বসালো। জানো শিরিন বড় বড় শহরগুলোতে গতরাতে পাকিস্তানিরা হামলা করেছে। ঘুমের মানুষেরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বলে আব্বু আর বলতে পারে না। খবরের কাগজটি আম্মুকে ধরিয়ে দিল। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পত্রিকায় শুধু হাহাকারের খবর। আম্মু নিজেকে শক্ত করে। আব্বুকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে এতো ভেঙে পড়লে চলবে? জীবন মানে তো সংগ্রাম। আম্মু বলে আমার তো ইচ্ছে করছে এই সংগ্রামে অংশ নিতে। বাঁচার মতো বাঁচতে। রিফাতের আব্বু আমি চাই দেশের প্রয়োজন হলে তুমিও এই মহান যুদ্ধে অংশ নেবে। তুমি তোমার বাগানের কথা ভাবছ? তাদের রক্ষার জন্য আমি তো আছি। দেশ বাঁচলে আমরা বাঁচব। স্বাধীনতাহীনভাবে নয়।
তুমি আমাকে উদ্বুদ্ধ করছ শিরিন। তোমার মতো সহধর্মিণী পেয়ে আমি গর্বিত। গর্বিত হওয়া লাগবে না। আমার আব্বার আদর্শে আমরা মানুষ হয়েছি। বাবা ছিলেন আমাদের গ্রামের আদর্শ চেয়ারম্যান যিনি তিন তিনবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হিসেবে ছিলেন। এক পয়সাও তিনি চেয়ারম্যানের ভাতা গ্রহণ করেনি। অন্যদের সুযোগ দিতে তিনি আর নির্বাচন করেন নি। আমি তাঁর মেয়ে হয়ে দেশের জন্য স্বামীকে যুদ্ধে যেতে বলব না এটা কেমন কথা।
:স্বস্তি পেলাম শিরিন। আমি কাঁদছিলাম এ জন্যেই তো। আমার দেশের দুঃসময়ে তোমাদের নিয়েই থাকতে হবে। দেশের জন্য কিছু করতে পারব না বলে।
ঠিক আছে ওসব পরে ভাবলেও হবে। চা টাতো ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আরেক কাপ চা বানিয়ে দিই। লাগবে না শিরিন। আমি অসময়ে চা খাই না।
গ্রামের মানুষের কাছে শহরের খবরাখবর এক কান আরেক কানে পৌঁছে গেছে। কেউ জানে না কী হচ্ছে। সবার মনে মনে আতঙ্ক বিরাজ করে কিন্তু কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। যুদ্ধ যদি গ্রামে শুরু হয়ে যায় তাদের কি হবে। অন্যদিকে খুব খোশ মেজাজে মালু মাতব্বর লম্বা পায়জামা পাঞ্জাবী পরে পাকিস্তানের পতাকা হাতে পান খেয়ে দাঁত কিলিয়ে হাসছে। আর চিৎকার দিয়ে পতাকা উড়িয়ে বলছে পেয়ারের পাকিস্তান জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। তার সাথে আরো দু’চারজন চামচা চেলা।
রিফাতের আব্বু মনসুর মিয়া এসব দেখেও নিশ্চুপ।
এদের এখনো কিছু বলার সময় আসেনি। যা করবে গোপনে করতে হবে। তার আগে নিজেদের সংগঠিত করতে হবে। মালু মাতব্বরের অজান্তেই। মালু মাতব্বর জানলে ঘোর বিপদ হবে। মালু মাতব্বরের হাত অনেক লম্বা।
একদিন মনসুর মিয়া ও আরো দুজন গেল মাতব্বরের বাড়িতে কৌশলে কিছু খবর জানার জন্য। কিন্তু মাতব্বর বাড়িতে নেই। ব্যাপারটা কি? কোথায় গেল? কৌশলে জানতে হবে কোথায় গেল।
মাতব্বরকে না পেয়ে মনসুর মিয়ারা ফিরে আসতে দেখল মাতব্বরের বাডড়ির কাজের ছেলে রমজানকে। রমজানকে কাছে ডেকে মনছুর মিয়া বলল তোমার মাতব্বর চাচা কোথায় রে?
মনসুর ভাইয়া মাতব্বর চাচা গঞ্জে গেছে। সাহস দিলে একটা কথা বলতে পারি?
কী কথা রমজান ? তুমি আমার ওপর বিশ্বাস রেখে বলতে পারি।
আমি পেটের দায়ে কাজ করে খাই। চুরি করি না। অন্যায় করি না। আর অন্যায় পছন্দও করি না। কিন্তু মাতব্বরের হালচাল ভালো ঠেকছে না মনসুর ভাইয়া। শুনেছি শহরে শহরে গণ্ডগোল চলছে। গ্রামের সবাই কেমন জানি একটা ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছে। আর মাতব্বর দেখি খুশিতে ধেই ধেই করে নাচে আর বুলি আওড়াতে থাকে। পেয়ারের পাকিস্তান জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ। আলমিরার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে বুঝবে এবার বাঙালি কত ধানে কত চাল। আরো কত কি। আমি এ বাড়িতে কাজ করব না আর। আগামী মাসেই
চলে যাব।
রমজান মাতব্বরের কথা-বার্তায় আমি আগেই বুঝে গেছি। এ মাতব্বর একটা খারাপ মতলবে ঘুরাঘুরি করছে। তোমার সাথে কথা বলে বুঝলাম আমার ধারণা ভুল ছিল না। তুমি চাকরি ছাড়বে না। এ সময় চাকরি ছাড়া উচিত ও না। আর এখানে তুমি থাকলে আমাদের সারা গ্রামের উপকার হবে। কখন কী হচ্ছে জেনে আমাদের জানাতে পারবে।
ঠিক মনসুর ভাইয়া। আপনার কথাই থাকল। গ্রামের ও দেশের জন্য আমি প্রাণ দিতেও রাজি।
ঠিক আছে রমজান। সাবধানে থেকো, চোখ কান খোলা রেখো।
জ্বি ভাইয়া। তাহলে আমি আসি।
এসো, বলে মনসুর মিয়ারা যার যার বাড়ি চলে গেল।
শহরগুলোতে তুমুল যুদ্ধ চলছে। শহর থেকে অনেক কষ্টে গ্রামে ফিরে এল অধ্যাপক যতীন রায়। যতীন রায় গ্রামে ফিরেছেন শুনে মনসুর
মিয়া ও তার আরও নয়জন বন্ধুসহ দেখা করতে গেল যতীন রায়ের বাড়িতে। যতীন রায় বয়সে সবার চেয়ে বড় ও শিক্ষিত তাই তারা সবাই যতীন রায়কে বলল দাদা আপনি আমাদের সবার বড় ঢাকায় থাকেন রাজনীতিও আমাদের চেয়ে বেশি বুঝেন। আমরা যুদ্ধ যাব আপনিই আমাদের নেতৃত্ব দেবেন। পারবেন না?
অবশ্যই পারব। আমি ঢাকা থেকে অনেক কষ্ট করে গ্রামে এসেছি। আমার পরিবার আমার গ্রাম গ্রামের মানুষ মানুষকে বাঁচাবো বলে। যুদ্ধ করতে হলে গ্রামের মানুষকে সাথে নিয়ে যুদ্ধ করব। তোমারা আমার সাহসকে বাড়িয়ে দিয়েছে। যুদ্ধ বললে তো যুদ্ধ করা যায় না। আমি কাল গঞ্জে যাব। ওখানে বড় বড় নেতাদের সাথে কথা বলে জেনে নেব। ট্রেনিং নিতে যেতে হবে আসামে কখন যেতে হবে জানি না। গন্ধ থেকে ফিরে সব জানাব। তবে এটা জেনে রেখো যেকোনো সময় আমাদের চলে যেতে হবে। তাই যার যার অবস্থান থেকে তৈরি থাকবে।
ঠিক আছে তোমরা এখন এসো।
সবাই ঘরে ফিরে যায় সে দিনের মতো। পর দিন যতীন রায় গঞ্জে গিয়ে সব ঠিক করে এল। সন্ধ্যায় আবার তারা মিলিত হল, যতীন রায় সবাইকে বলল রাত ঠিক বারোটায় ঘর থেকে বের হতে হবে। ঘরের ভিতর কোনোরকম কান্নাকাটি করতে পারবে না। আমরা যেই ট্রেনিং নিতে যাচ্ছি এ কথা কাক পঙ্খিও যেন না জানে।
রাত ঠিক বারোটায় এগারোজন এক জায়গায় উপস্থিত হয়ে এই মাটিকে রক্ষার জন্য পা বাড়াল।
অনেক কষ্ট করে পায়ে হেঁটে হেঁটে তাঁরা অবশেষে পৌঁছে একদিন বিশ্রাম থেকে ট্রেনিংয়ে যোগ দিয়ে অস্ত্র চালানোর কৌশল শিখে বিশ দিন পরে ফিরে এল মাতৃভূমি নিজ গ্রামে।
এই বিশদিনে গ্রামে অনেক ঘটনার জন্ম দিয়েছে মাতব্বর। যারা যারা ট্রেনিং নিতে ভারতে গিয়েছে তাদের টার্গেট করে মাতব্বর কারো গরু ছাগল হাঁস মুরগি যখন ইচ্ছে তখন ধরে নিয়ে তার কাচারি ঘরে পাখিদের ভূড়ি ভোজনের আয়োজন চলে। এই এগারোজন যোদ্ধার অনুপস্থিতিতে মাতব্বর একাই লঙ্কার রাজার রাবণের মতো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
অনেকেই তার সাথে যোগ দিয়েছে। কিন্ত তার জায়গায় তার নামে মসজিদ, মসজিদের ইমাম সাহেব লতিফ মিয়াকে যখন মাতব্বর ডাক পাঠালেন তার বাড়িতে। লতিফ মিয়া মাতব্বরের সামনে দাঁড়ায়।
বলুন কেন ডেকেছেন ?
বসো, বসো। এত তাড়া কীসের? তোমাকে ডেকেছি চোখ কান খোলা রাখতে।
কেন মাতব্বর সাহেব? আমি তো আপনার সামনেই। আমার চোখ মুখ কান বন্ধ দেখছেন?
বন্ধ দেখিনি সত্য তবে আরও সজাগ থাকতে বলেছি।
ঠিক আছে সজাগ থাকব।
মুক্তিরা যেন কোনো অবস্থাতে এই গ্রামে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে যেন না পারে।
মাতব্বর সাহেব আপনি কি আমাকে মুক্তিদের বিপক্ষে থাকতে বলছেন?
হ্যাঁ তুমি ঠিক ধরতে পেরেছ লতিফ মিয়া।
না মাতব্বর সাহেব, আমি আপনার কথা রাখতে পারব না। আমি বাঙালি জাতি। সবাই আমাকে ইমাম সাহেব বলে ডাকে, এ গ্রামের হিন্দু-মুসলিম সবার শ্রদ্ধার পাত্র। তাদের সাথে আমি বেঈমানী করতে পারব না ।
ঠিক আছে সবার শ্রদ্ধার পাত্র কাল থেকে থাকবে না।
তার মানে?
কাল থেকে তুমি আর ইমাম সাহেব থাকছ না।
ভয় দেখালেন? আমি কাল নয় এখনই চলে যাচ্ছি।
ঠিক আছে যাও যাও। আমিও দেখে নেব।
এলাকার প্রায় মানুষগুলো মাতব্বরের বিরুদ্ধে ক্ষেপে আছে। ইমাম সাহেব আপনি বললে এখনই মাতব্বরকে শেষ করে দেব।
মাথা গরম করবেন না আপনারা। আমরা ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধে নেমেছি। কোনো অবস্থাতে প্রমাণ ছাড়া কোনো কাজ করা উচিৎ হবে না।
আমি শুনেছি এই গ্রামের এগারোজন ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসেছে তাদের সাথে আপনারা এক হয়ে কাজ করলে এই মাতব্বর লোটা কম্বল ফেলে দৌড়াবে।
এমন সময় এগারোজনই কাঁধে অস্ত্র নিয়ে হাজির। ইমাম সাহেব বলে উঠলেন বলছিলাম না দেখুন আপনারা দেখা করার আগে যাদের কথা বলছিলাম সবাই এসেছেন। প্রথমে ইমাম সাহেব আবেগকে থামিয়ে রাখতে পারলেন না। জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে উঠলেন। যতীন রায় ইমাম সাহেবকে বললেন হুজুর আপনি আবেগটাকে ধরে রাখতে পারেননি। তাই শ্লোগান দিয়ে উঠলেন। কিন্তু হুজুর আমরা যা কিছু করব সাবধানে করব সাবধানে থাকব। ঠিক আগের মতো । ইশারায় ইঙ্গিতে।
আমাদের কাজ করতে হবে খুব গোপনে মাতব্বরকে ক্ষেপানোর দরকার নেই। মাতব্বরকে আমাদের সবার চেনা হয়ে গেছে। সময় বলে দেবে কখন কী করতে হবে। আর আপনারা যারা আমাদের সাথে কাজ আগ্রহী সবাই মনসুর মিয়ার থেকে ট্রেনিং এর কলাকৌশল শিখে নেবেন। ট্রেনিং নিতে গিয়ে আমরা শিখেছি যুদ্ধের রণকৌশল এবং সব সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখা ও নেতৃত্বদানকারীর আদেশ মেনে চলা। আমার অবর্তমানে আপনারা মনসুর মিয়ার সাথে সব ধরণের যোগাযোগ করে নেবেন। আজকের জন্য বৈঠক এখানে শেষ। সবাই যার যার বাড়ি চলে গেল। মনসুর মিয়া ঘরে ঢুকতে পেছন থেকে মাতব্বরের কাজের ছেলে রমজান মনসুর ভাইয়া দাঁড়ান কথা আছে।
আরে রমজান হাঁপাচ্ছ কেন? ঘরে এসে বস।
কী খবর বল।
বাড়িতে গত রাতে পাঁচজন মিলিটারি এসেছে। মাতব্বর তাদের সাথে উর্দুতে কথা বলে। কতই না খাতির যত্ন করে। শফিক ও রফিককে পাঠিয়ে সোলেমানের বউয়ের বড় খাসিটা এনে খাওয়ালো। সোলেমানের বউ শফিক রফিকের পায়ে ধরে বলল আমার স্বামী নাই তোমরা জানো ঋণের টাকা নিয়ে আমি সারা বছর ছাগল হাঁস মুরগি লালন পালন করি। কোরবান এলে বিক্রি করে সংসার চালাই তোমরা এই খাসিটা নিও না। চুপ কর তোমার ভাগ্যটা ভালো পেয়ারের বান্ধা পাকিস্তানি অফিসাররা খাবে ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু : অসমাপ্ত জীবনের এক মহানায়ক
পরবর্তী নিবন্ধবিজয়দিনের হাসি