প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৩০ জুন, ২০২১ at ৭:১৫ পূর্বাহ্ণ

সৌদি-ইরান সুসম্পর্ক মুসলিম বিশ্বের জন্য অত্যাবশ্যক

ইরানের নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইব্রাহীম রাইসি তার বক্তব্যে সৌদি আরবসহ আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তা কার্যকর হলে বিশ্বের জন্য সুসংবাদ বলা যাবে। অতি রক্ষণশীল বিচারপতি ও পশ্চিমা দেশগুলোর কড়া সমালোচক ইব্রাহীম রাইসি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির স্থলাভিষিক্ত হবেন। সংবাদ সম্মেলনে ইব্রাহীম রাইসি আরব প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে তার সরকারের বিশেষ গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন। তবে এতে বড় বাধা হতে পারে ইয়েমেন বিষয়। যেহেতু ইয়েমেনের শিয়াপন্থি হুতিদের উত্থান সৌদি আরব তার রাজতন্ত্রীয় বিশাল দেশের জন্য হুমকি মনে করতে থাকে। তিন দিকে ওমান, আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, জর্ডান ছোট ছোট রাজতন্ত্রীয় দেশ সৌদি আরবের জন্য হুমকি নয়। ইরাকের সাথে সীমান্ত থাকলেও ইরাককে হুমকি মনে করে না।
এখানে প্রশ্ন আসে কাতার রাজতন্ত্রীয় আরব দেশ। কাতারের সাথে ইরানের সুসম্পর্ক থাকতে পারলে সৌদি আরব আগ্রহী হলে না পারার কথা নয়। সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সুসম্পর্ক মুসলিম বিশ্বে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক।
আজ থেকে ৪০/৪৫ বছর আগেও ইরানের সাথে সৌদি আরবের সুসম্পর্ক ছিল। অর্থাৎ ইমাম খোমেনীর আগে ফাহলভী শাহ এর আমলে দীর্ঘ সময় উভয় দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। ১৯৭৯ সালে ইমাম রুহুল্লাহ খোমেনী ফ্রান্স থেকে দেশে ফিরে আসেন। তিনি প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রী হয়ে ক্ষমতায় না এলেও তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ইমাম হিসেবে তার মুরব্বিয়ানায় ইরান পরিচালিত হতে থাকে। এরই মধ্যে সৌদি আরবের বাদশা খালেদ ইমাম রুহুল্লাহ খোমেনীর নিকট অভিনন্দন বার্তা প্রেরণ করেন। বার্তায় বাদশা খালেদ বলেন, ইসলামিক ঐক্য দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মূল ভিত্তি হতে পারে। তিনি আরও বলেন, ইরানে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপিত হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা থাকতে পারে না।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আমেরিকার মিত্র ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ইরানে খোমেনী পন্থি নতুন দুর্বল সরকার মনে করে ইরান আক্রমণ করে বসে। এতে মুসলিম বিশ্বের ঐক্য তছনছ হয়ে যায়। অর্থাৎ এতে সৌদি আরবসহ আরব রাষ্ট্রগুলো কৌশলগত চিন্তা করে সাদ্দাম হোসেনের পক্ষে অবস্থান নেয়। যা মুসলিম বিশ্বের জন্য অত্যধিক ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।
ইমাম খোমেনীর ইরান শিয়াদের মুরব্বি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তার মন মানসিকতা সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে উদার মনোভাবাপন্ন বুঝা গিয়েছিল। তিনি উগ্র না হয়ে ত্যাগী ছিলেন। অপরদিকে বাদশা খালেদ মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের স্বার্থে ইরান-সৌদি আরব সহাবস্থানসহ ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ থাকার জন্য ইমাম খোমেনীর কাছে অভিনন্দন বার্তার মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। শাহ’র আমল থেকে দীর্ঘ সময় সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সুন্দর সহ অবস্থান ছিল। ইমাম খোমেনীর আমলে এসেও তা অটুট থাকত। কিন্তু আমেরিকা মুসলিম বিশ্বকে ছারখার করার জন্য বেছে নিল তাদের প্রিয় উগ্র হিতাহিত জ্ঞানশূন্য ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে। সাদ্দামের সাথে আমেরিকার খুব নিবিড় সু-সম্পর্ক ছিল সে সময়।
এ যুদ্ধে সৌদি আরবের নেতৃত্বে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রসমূহ ইরাকের পক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। আট বছরব্যাপী ভ্রাতৃঘাতী এ যুদ্ধে কোন পক্ষের জয় পরাজয় নেই। কিন্তু উভয় দেশের লক্ষ লক্ষ মুসলিম শহীদ হন। দীর্ঘ আট বছর পর ইরান-ইরাক এ যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বে শিয়া-সুন্নী সহ অবস্থান ভেঙে যায়। যা মুসলিম বিশ্বের জন্য খুবই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এ দিকে উগ্র সাদ্দাম কুয়েত দখল করে বিশ্বে এক ঘরে হয়ে যায়। ইরাকীদের জীবনে বয়ে আনে দুর্বিষহ অবস্থান।
ইসলামের প্রারম্ভ থেকেই শিয়াদের উৎপত্তি। আমিরুল মুমেনিন হযরত ওসমান ও হযরত আলী এবং তৎপরবর্তী সময়ে ইসলামে শিয়াসহ নানান ছোট বড় দল উপদল আবির্ভূত হয়। তন্মধ্যে শিয়া বাদে অন্যান্য মতাবলম্বীরা অনেকটা বিলীন হয়ে যায়। শিয়ারা নবী পাক (স.) এর পরে হযরত আলী খলিফা তথা ইমামের দাবিদার বলে বিশ্বাস করে। তাদের মত বা দাবি হল নবী পাক (স.)’র পরে পরিবারবর্গের প্রাণপুরুষ হযরত আলী এবং তাঁর বংশধররাই নেতৃত্ব দেবেন।
এ থেকে শিয়াদের সাথে মূল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে এবং শিয়া-সুন্নী সংঘাত মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে চরম ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে আসছিল।
এশিয়ার পশ্চিম অংশ তথা ইসলামের প্রাণকেন্দ্রের বলয়ের মধ্যে শিয়া-সুন্নী সংঘাতের বহু ইতিহাস রয়েছে। এতে উভয়পক্ষে বহু মুসলমান শহীদ হয়। বহু নগর বন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয় মসজিদ, মাজার। শিয়া-সুন্নী সংঘাত নিয়ে বাগদাদ নগরীকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।
বিশ্বে শিয়াদের একক নিয়ন্ত্রিত দেশ ইরান। এখানে সুন্নিরা খুবই নগণ্য এবং তা অনেকটা সীমান্ত এলাকায়। অপরদিকে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, বাহরাইন, আজারবাইজান, ইয়ামেন এসব দেশ শিয়া প্রভাবিত। শিয়া ম্যাজরিটি হউক বা মাইনরিটিই হউক এসব দেশের উপর ইরানের মুরব্বিয়ানা অস্বীকার করা যাবে না।
সৌদি আরবের দক্ষিণে প্রজাতন্ত্রী ইয়েমেন। দীর্ঘ কয়েক দশক যাবৎ এই দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছিল। উত্তর দক্ষিণ দুই ইয়েমেনে ভাগ হয়ে যায়। দক্ষিণ ইয়েমেনে অস্থিতিশীল অবস্থা চলমান থাকে। উত্তর ইয়েমেনে আলী আবদুল্লাহ সালেহ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শক্ত অবস্থানে। কিন্তু এক দিকে প্রজাতন্ত্রী ইয়েমেন অপরদিকে তুর্কি আমলের পর সৌদি আরব ও ইয়েমেনের সীমান্ত স্পষ্ট চিহ্নিত ছিল না। অর্থাৎ কোন সময় সৌদি আরব ইয়েমেন নিয়ে টেনশনমুক্ত থাকতে পারে নাই। দক্ষিণ ইয়েমেনে বিশৃংখল পরিবেশ এবং উত্তর ইয়েমেনে আলী আবদুল্লাহ সালেহ এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে শক্ত অবস্থানে। এতে উভয় ইয়েমেন একীভূত হওয়ার সহায় বলা যাবে। ১৯৯০ সালে উভয় ইয়েমেন একীভূত হয় অনেক রক্তক্ষয়ের পর। দীর্ঘ সময়ের শাসক আলী আবদুল্লাহ সালেহ ইয়েমেনকে শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ এই দেশটির প্রতি তুলনামূলক কল্যাণকরই ছিল।
কিন্তু আরব বসন্ত দেশটির জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, লিবিয়া, মিশর এসব আরব দেশের মত ইয়েমেনও আলী আবদুল্লাহ সালেহকে সরাতে গণ জোয়ার শুরু হয়। ফলে টিকতে না পেরে তার দক্ষিণহস্ত আবদুর রহমান মনসুর হাদীকে ক্ষমতা দিয়ে দিতে বাধ্য হয়। এতে ইয়েমেনে বিভিন্ন দল উপদল সশস্ত্র সংগঠন বেপরোয়া হয়ে উঠে। দেশে আইনশৃংখলার চরম অবনতি ঘটে। সুন্নি মুসলমানগণের মধ্যে চরম বিশৃংখলার সুযোগে সুসংগঠিত শিয়া হুতিরা চাঙ্গা হয়ে উঠে। তারা ইয়েমেনে ক্ষমতা দারপ্রান্তে এসে যায়। রাজধানী সা’না সহ আশেপাশের এলাকা দখল করে নেয়। মনসুর হাদী নিরাপত্তার জন্য সৌদি আরবে পালিয়ে যায়। শিয়া হুতিদের দমাতে সৌদি আরব সহ আরবের কয়েক রাষ্ট্র হুতিদের উপর ২০১৫ সালের মার্চ থেকে বিমান হামলা শুরু করে। পরবর্তীতে সাগরপথে অবরোধ সৃষ্টি করে। ইয়েমেনে চরম দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছে। লাখ লাখ মানুষ মারা যায় বোমায় ও অনাহারে অর্ধাহারে। লক্ষ লক্ষ শিশু অপুষ্টির স্বীকার। অপরদিকে ইয়েমেনে মুসলমানদের উপর সৌদি বিমান হামলা বিশ্বে সৌদি আরবের মান সম্মানের ক্ষতি হচ্ছে। ইহা সৌদি আরবের জন্য চরম ভুল সিদ্ধান্ত তাতে ইতস্ততা নেই।
এদিকে আমেরিকার সাথে তোষামোদ, অস্ত্র ক্রয়, ইসরাইলের সাথে বন্ধুত্ব, কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, ইয়েমেনে বিমান হামলা সব কিছুর মূলে কিন্তু ইরান। ইরানকে ভয় পেয়ে বা কাবু রাখতে সৌদি আরবসহ আরব রাষ্ট্রগুলো যা করতেছে তা রাজতন্ত্রীয় সরকার হলেও এসব নিকৃষ্ট কর্মকাণ্ড এতে সন্দেহ নেই। এতে দেশের জনগণের শতকরা ৯০ জন এ নীতি বিরোধী তা বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। জনগণের সম্মান, মনোভাবকে তোয়াক্কা না করে রাজতন্ত্রীয় ক্ষমতা বলে যা ইচ্ছা তা করবে এমন হতে পারে না।
অপরদিকে ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম রাইসিও অনুভব করতেছেন সৌদি আরবসহ নিকটতম আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলা ইরানসহ মুসলিম বিশ্বের জন্য কল্যাণকর।
ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট রাইসি মুসলিম ঐক্য এর গুরুত্ব অনুভব করছেন। এতে আরব রাষ্ট্র আমেরিকার তাবেদারী না করে, চিরশত্রু ইসরাইলের সাথে বন্ধুত্ব না করে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ইরানের সাথে সু-সম্পর্ক করা অত্যন্ত কল্যাণকর হবে। আরও কল্যাণকর হবে মুসলিম বিশ্বের জন্য। সে সব আরব দেশের জনগণও খুশি হবে। ইয়েমেনে শান্তি ফিরে আসবে। ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনীদেরকে পাখির মত মারাও থেমে যাবে।
অতএব আশা করব ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের গুরুত্বকে মূল্যায়ন করে সৌদি আরব আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সহাবস্থানে আসবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআগরতলা মামলা-খ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী মাণিক চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধপটিয়ায় মাদ্রাসা ছাত্রকে নিপীড়নের অভিযোগ চা দোকানি গ্রেফতার