সরকারি কর্মকর্তার সততা নিয়ে ভাবনা
সম্প্রতি অবসরে যান এক সচিব ও এক অতিরিক্ত সচিব। এ দু’জনের সাথে দীর্ঘদিন আমার সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কাছ থেকে তাদের জানার, দেখার সুযোগ হয়।
প্রথমে আসি সচিবের কথা নিয়ে। তিনি বরিশালের সন্তান; রাজশাহীতে জেলা প্রশাসক থাকতে তাঁর সাথে পরিচয় হয়। চট্টগ্রামে তাঁর বড় ভাই! বন্ধু বিধায় সে সুবাদে পরিচয়। রাজশাহী সফরে সার্কিট হাউজে অবস্থান করি তাঁর ইচ্ছায়, তাঁর বাসায় রাতে খাওয়ার ব্যবস্থা করেন ২/৩ জন সহযাত্রী নিয়ে। সার্কিট হাউজের ভাড়া ও তথায় খাবার বিল দিতে চেয়েছিলাম, যেহেতু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা। কিন্তু নিজ থেকে প্রতিশ্রুতি দেন, তার নিজ তহবিল থেকে এ বিল পরিশোধ করবেন। অবশ্য দেশে একাধিক জেলা সদরের সার্কিট হাউজে এবং বিভিন্ন দপ্তরের গেস্ট হাউজে থাকা হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিল নিতে অনীহা দেখালেও বিল প্রদান করতে শক্ত অবস্থানে থাকতাম। রাষ্ট্রীয় সম্পদ তথা ১৭ কোটি জনগণের সম্পদ। এখানে পাস কাটার সুযোগ নেই।
সম্মানিত রাজশাহী জেলা প্রশাসক প্রমোশন পেতে পেতে সচিব হন। পর্যায়ক্রমে কয়েক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমান অবসর জীবন যাপন করছেন। তাঁর সাথে এখনও মাঝে মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে। পরিবার নিয়ে হজ্ব করতে গেলে পবিত্র নগরীতেও সাক্ষাত হয়।
তিনি সরকারিভাবে উত্তরায় একটি প্লট পান। ঢাকা মহানগরীতে ইহাই তাঁর সম্বল। ডেভেলপারকে দিয়ে দালান নির্মাণ করা হয়। তথায় ফ্ল্যাট কম নিয়ে গ্রীণ রোডে ফ্ল্যাট নিয়ে বসবাস করতেছেন। অতি সাদামাটা জীবন যাপন করেন। বরিশালে পৈতৃক বাড়ি, তেমন সম্পদের মালিক নন।
অপর অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব নোয়াখালীর বাসিন্দা। চট্টগ্রাম ও কঙবাজারে দীর্ঘ সময় ছিলেন। ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট, ইউ,এন,ও, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। ঢাকায় একাধিক মন্ত্রণালয়ে ছিলেন। চট্টগ্রাম ও কঙবাজার অবস্থানকালীন সময় হতে তার সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক হয়। ঢাকায় যাওয়ার পরেও এ সম্পর্কের এদিক সেদিক হয়নি। ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন। নোয়াখালীতে পৈতৃক সম্পত্তি যা আছে সেটুকুই সম্বল।
বস্তুতঃ আমাদের দেশে বিসিএস ক্যাডারের হাজার হাজার পদ রয়েছে। সহকারী কমিশনার থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে প্রমোশন পেতে পেতে যুগ্ম সচিব বা অতিরিক্ত সচিব অথবা সচিব বা সিনিয়র সচিব থেকে অবসরে যাচ্ছেন।
একালে সৎ মানুষ দ্রুত কমে যাচ্ছে স্পষ্টত ফুটে উঠছে। এ দুইজন বাদেও আরও অনেক ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার সাথে সম্পর্ক রয়েছে। তবে এ দুইজনকে অনেকটা কাছ থেকে দেখেছি।
বিসিএস প্রশাসন অনেকটা দেশের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রক। তারা সরকারকে সহায়তা করে, দেশের সেবা দান করে। বর্তমানকালে যে হারে ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাটের দুর্নাম সাথে সাথে ধরপাকড় চলতেছে এখানে সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কতটুকু দায়মুক্ত ভাবা দরকার।
মানুষ লোভের ঊর্ধ্বে নয়, লোভের মূলে হল স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি। তাদের জন্য সম্পদ রেখে যাওয়া। সেই লক্ষে শত হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়া হচ্ছে। উদ্দেশ্যে একটাই সন্তান-সন্ততির প্রতি অতি দুর্বলতা।
মহান আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (স.) বলে গেছেন- পিতা-মাতার প্রতি অতি দুর্বল থাকতে হবে। অপরদিকে সন্তান-সন্ততির প্রতি নিয়ম নীতি মতে দায়িত্ব পালন করতে। একালে হয়ে গেছে সম্পূর্ণ উল্টো। অনেকের ক্ষেত্রে পিতা মাতা অবহেলিত, বৃদ্ধাশ্রমে। অপরদিকে সন্তান-সন্ততির প্রতি সীমাহীন দুর্বলতা। মানুষ মরণশীল, যাওয়ার সময় কাফনের কয়েক টুকরা সাদা কাপড় ছাড়া আর কিছু নিতে পারবে না। তা সকলেই বুঝে, তারপরেও লোভ সামলাতে পারতেছে না।
আজ দেশে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, সরকারি অফিসে, ঘরে বিলাসী জীবন যাপন করা হচ্ছে। ইহা ১৭ কোটি জনগণের সম্পদ তা ভাবা হচ্ছে না।
এ দুইজন অবসরে যাওয়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হয়ত বিবেকের তাগিদে দেশের সম্পদ বেআইনীভাবে অর্জন করা থেকে দূরে ছিলেন। হয়ত তাদের পরকালের ভয়ও কাজ করছিল।
সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণের মধ্যে ভাল মানুষ নাই তা না, তবে তা হাতেগোনা।
ক’বছর আগে এ রকম অবসরে যাওয়া আরেক সচিব নিয়ে লিখেছিলাম। তিনিও চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন। ঢাকায় একাধিক মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্বপালন করেন। সাহসী নামকরা সচিবগণের মধ্যে অন্যতম একজন। তিনিও ঢাকার পৈতৃক বাড়িতে বসবাস করছেন। উত্তরায় বরাদ্দ পাওয়া প্লটটিতে ডেভেলপারের মাধ্যমে দালান নির্মাণ করেন। এখান থেকে আয় রোজগারে গুলশানে পৈতৃক বাড়িতে ভাগে পাওয়া ফ্ল্যাটে থেকে শেষ জীবন কাটাচ্ছেন।
সম্প্রতি সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিদেশে অর্থ পাচারের কথা দেশে বহুলভাবে প্রচারিত হচ্ছে এবং তা সচেতন জনগণকে ভাবিয়ে তুলতেছে। যেহেতু তারা উচ্চ শিক্ষিত, দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দেশের সেবা করার কথা। কিন্তু দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ কোটি কোটি টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করতেছে তাদের অনেকেই। ধন সম্পদ বেশি দেখাতে পারলে উন্নত বিশ্বে ভিসা পেতেও সহজ। তারা সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য উন্নত বিশ্বে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সন্তানের দেখভালের জন্য বেগমেরা ঘনঘন যাওয়া-আসা করতেছে। এতে কানাডার বিভিন্ন স্থানে বেগমপাড়া বা বেগম পল্লী গড়ে উঠে দুর্নীতিবাজদের অর্থে। তেমনিভাবে নিউইয়র্কেও। সেখানে বসতি গড়ায় সচেতন বাঙালিরা প্লেকার্ড নিয়ে মিছিল করেছে বলে শুনি এ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রীও স্বীকার করেন। তিনি বলেন প্রাপ্ত রিপোর্টে পাচারকারীদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা অত্যধিক। গত ২২ নভেম্বর রবিবার হাইকোর্টের মাননীয় দুই বিচারপতির বেঞ্চ টাকা পাচারকারীদের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এরা দেশের শত্রু জাতির সাথে বেঈমানী করেছে। হাইকোর্ট বিভিন্ন দপ্তর থেকে এদের তালিকা চেয়েছে।
সরকারি কর্মকর্তাগণের প্রতি আবেদন থাকবে দেশের ১৭ কোটি জনগণের সম্পদ আপনাদের কাছে আমানত। বউ বাচ্চার কল্যাণে দেশের সম্পদ এর উপর লোভ করলে কল্যাণত নয়ই বরং উল্টো সন্তান-সন্ততির অকল্যাণ বয়ে আনছে। তার অহরহ প্রমাণ রয়েছে। সন্তান-সন্ততিকে সৎভাবে হালাল রোজগারের মাধ্যমে মানুষ করতে না পারলে এ সব সন্তানাদি ভাল হওয়ার আশা ক্ষীণ, তা আমাদের বুঝতে হবে।
সন্তান-সন্ততির মূল মালিক আল্লাহ তাআলা। আল্লাহর দরদকে ডিঙ্গিয়ে সন্তানাদির প্রতি নিজের দরদকে প্রাধান্য দিলে অকল্যাণ হওয়া স্বাভাবিক, তাও অনুধাবন করতে হবে। অপরদিকে জনগণও বুঝে অতিরিক্ত ধন সম্পদ অসৎভাবে উপার্জিত। মানুষ থেকে সম্মান অন্তর থেকে পাওয়া চাই। উপরে সম্মান দেখাবে, অন্তর থেকে ঘৃণা থাকবে, এ সম্মানের দাম নাই। আশা করব সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে লোভের ঊর্ধ্বে থাকবে, সততার পরিচয় দিবে, এতে অন্তর থেকে জনগণের শ্রদ্ধা লাভ করবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট