অধীনস্তদের প্রতি নবী পাকের (স.) দয়া
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হযরত আনাস (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী পাক (স.) ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের। তিনি একদিন আমাকে কোন এক কাজে পাঠালেন। আমি চিন্তা করলাম যাবো না, আর মনে মনে আমার চিন্তা আসে যে, নবী পাক (স.) আমাকে যে কাজে নির্দেশ দিয়েছেন আমি সে কাজে যাব। আমি বের হলাম পথি মধ্যে আমি কয়েকজন বালকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম যারা বাজারে খেলছিল। তখন আমিও তাদের সাথে খেলতে শুরু করলাম। হঠাৎ নবী পাক (স.) আমার কাঁধে হাত দিলেন, তিনি তাকিয়ে দেখে হাসলেন। হে ওনাইস (আনাসকে) আদর করে, আমি তোমাকে যেখানে পাঠিয়েছিলাম তুমি কি সেখানে গিয়েছিলে? আমি বললাম, আমি যাব ইয়া রাসূলুল্লাহ (স.)।
হযরত আনাস (র.) বলেন: আল্লাহর কসম! আমি ৯ বছর তাঁর কাছে ছিলাম, অথচ আমার জানা নেই যে আমি তাঁর নির্দেশিত কোন কাজ না করলে তিনি আমাকে বলেছেন যে, কেন করলে না বলে আমার জবাবদিহী করতে হয় না। (মুসলিম শরীফ)। হযরত আনাস (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী পাক (স.) আমাকে কৌতুক করে এই বলে ডাকতেন যে এই ‘দুই’ কানওয়ালা।
হযরত আনাস (র.) থেকে র্বর্ণিত, তিনি বলেন: এক ইহুদী খাদেম নবী পাক (স.) এর খেদমত করতেন। একদা সে অসুস্থ হল। তখন নবী পাক (স.) তাকে দেখতে গেলেন। অতঃপর তিনি তার মাথার নিকট বসলেন, এরপর তাকে বললেন: তুমি ইসলাম গ্রহণ কর, তখন সে তার পিতার দিকে থাকাল (পিতা তার পাশেই ছিল) তার পিতা তাকে বলল, তুমি মুহাম্মদের (নবী পাক (স.))এর কথা মান। তখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করল। অতঃপর নবী পাক (স.) এই বলে বের হলেন, সমস্ত প্রশংসা ঐ সত্বার জন্য যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে বাঁচালেন।
হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী পাক (স.) মাটিতে বসতেন,মাটিতে বসে খাবার খেতেন। বখরী নিজে লালনপালন করতেন । অধীনস্থ লোকেরা জবের রুটি খাওয়ার দাওয়াত দিলে তিনি গ্রহণ করতেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী পাক (স.) বলেছেন: যে ব্যক্তি তার কৃতদাসকে থাপ্পড় মেরেছে বা পিটিয়েছে তার কাফ্ফারা হল তাকে আযাদ করে দেয়া। (মুসলিম)
হযরত আবু মাসউদ আল আনসারী (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি চাবুক দিয়ে আমার এক কৃতদাসকে প্রহার করছিলাম। হঠাৎ আমার পিছন থেকে একটি আওয়াজ শুনতে পেলাম, হে আবু মাসউদ সাবধান। কিন্তু রাগের কারণে আমি আওয়াজটা স্পষ্ট করে বুঝতে পারছিলাম না। যখন আওয়াজটি আমার নিকটবর্তী হল তখন আমি দেখতে পেলাম যে, (ঐ আওয়াজকারী ছিলেন) নবী পাক (স.), যিনি বলেছিলেন যে, হে আবু মাসউদ, সাবধান! হে আবু মাসউদ, সাবধান! আমি এই আওয়াজ শুনে নিজের চাবুক নিচে ফেলে দিলাম। নবী পাক (স.) বললেন: হে আবু মাসউদ স্মরণ রাখ তুমি এই কৃতদাসের উপর যতটা ক্ষমতাবান, আল্লাহ তোমার উপর এর চেয়ে অধিক ক্ষমতাবান। আমি বললাম আজকের পর আমি আর কোন কৃতদাসকে প্রহার করব না। অন্য এক বর্ণনায় বর্ণিত রয়েছে, হযরত আবু মাসউদ বলল: ইয়া রাসূলুল্লাহ (স.) আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য তাকে আযাদ করে দিলাম। নবী পাক (স.) বললেন: যদি তুমি এরূপ না করতে তাহলে জাহান্নামের আগুন তোমাকে জ্বালিয়ে দিত বা আগুন তোমাকে স্পর্শ করত। (মুসলিম)
হযরত মুয়াবিয়া ইবনে সুয়াইদ (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি তোমাদের এক কৃতদাসকে থাপ্পড় মেরেছিলাম। এরপর আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম। যোহরের সামান্য আগে ফিরে এসে মসজিদে আমার পিতার পেছনে নামাজ আদায় করলাম। নামাজের পর আমার পিতা আমাকে ও কৃতদাসকে ডাকল। এরপর কৃতদাসকে বলল: তার কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তখন কৃতদাস আমাকে ক্ষমা করে দিল। (মুসলিম শরীফ)
হযরত আয়েশা (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী পাক (স.) এর সাহাবাগণের মধ্যে এক ব্যক্তি তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে আবেদন করল, ইয়া রাসূলুল্লাহ (স.) আমার কিছু কৃতদাস আছে যারা আমার সাথে মিথ্যা বলে, খিয়ানত করে, আমার কথা শুনে না; তাই আমি তাদেরকে গালিগালাজ এবং প্রহার করি। কিয়ামতের দিন তাদের ব্যাপারে আমার কি অবস্থা হবে?
নবী পাক (স.) বললেন: তোমার অধীনস্থদের খিয়ানত, অবাধ্যতা এবং মিথ্যা বলা ওজন করা হবে এবং তুমি তাদেরকে যে শাস্তি দিয়েছ তাও ওজন করা হবে, যদি তোমার দেয়া শাস্তি তাদের অপরাধের তুলনায় কম হয় তাহলে তুমি সোয়াব পাবে, আর যদি তোমার দেয়া শাস্তি তাদের অপরাধের সমান সমান হয় তাহলে তোমার কোন শাস্তিও নেই আবার কোন সোয়াবও নেই। আর তোমার দেয়া শাস্তি যদি তাদের অপরাধের তুলনায় বেশি হয় তাহলে অতিরিক্ত শাস্তি দেয়ার কারণে তোমাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। তখন ঐ ব্যক্তি নবী পাক (স.) এর সামনে কাঁদতে লাগল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন তুমি কেন কাঁদছ। তুমি কি কোরআন মাজীদের এই আয়াত তেলাওয়াত কর না? আমি কিয়ামতের দিন ন্যায় বিচারের মানদন্ড স্থাপন করব, সুতারাং কারও প্রতি জুলুম হবে না। যদি কোন আমল সরিষা দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করব এবং হিসাব গ্রহণের জন্য আমিই যথেষ্ট। (সূরা আম্বিয়া-৪৭) এ কথা শুনে ঐ ব্যক্তি বলল: ইয়া রাসূলুল্লাহ (স.) আমি আমার ব্যাপারে এর চেয়ে আর ভাল কিছু দেখছি না যে, আমি তাদেরকে আযাদ করে দিব, আমি আপনাকে স্বাক্ষী রেখে বলছি যে তারা সবাই আযাদ”। (আহমদ, তিরমিযী)
বস্তুতঃ বাংলাদেশসহ উপ মহাদেশে এবং আরব রাষ্ট্রগুলোতে ঘরের কাজের লোক রাখার প্রবণতা তুলনামুলকভাবে বেশি। যা ইরান, তুরস্কসহ পশ্চিমা বিশ্বে নাই বললেই চলে। আমাদের দেশে স্বচ্ছল হলেই গরীব ঘরের ছেলে মেয়ে তথা কাজের লোক বা কাজের মেয়ে রাখা স্বাভাবিক ব্যাপার।
তারাও মানুষ, শুধু ব্যবধান হল আর্থিক অবস্থা। অর্থাৎ যার ঘরে থাকছেন তারা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল, যারা কাজ করছেন তারা আর্থিকভাবে দুর্বল। শুধু একটাই ব্যবধান আর তা হল অর্থ সম্পদ।
অতএব ওদের প্রতি অমানবিক আচরণ কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমাদের মহান নবী পাক (স.) ও তাঁর মহান সাহাবাগণের নির্দেশ, চরিত্র, আদর্শ অনুসরণ করা আমাদের কর্তব্য। (চলবে)।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট