প্রফেসর এ.জে.এম নুরুদ্দীন চৌধুরী স্মরণে

ড. ইসরাত জাহান | শনিবার , ৩ অক্টোবর, ২০২০ at ৬:৫১ পূর্বাহ্ণ

মৃত্যু নিরন্তন আর কিছু কিছু মৃত্যু মানুষকে বাকরুদ্ধ করে দিতে পারে অতি সহজেই। এরকম একটি মৃত্যুর খবর পেয়েই আজ আমরা বাকরুদ্ধ। রব্বুল করিমের ডাকে সাড়া দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন সাদার্ন ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের পূর্ণকালীন সম্মানিত শিক্ষক ও আইকিউএসির পরিচালক এবং সাদার্ন ইউনিভার্সিটি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সকলের শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক এ জে এম নুরুদ্দীন চৌধুরী। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন। (“আমরা তো আল্লাহরই এবং আর নিশ্চয়ই আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী”)। আল্লাহতায়ালা তাঁকে ক্ষমা করুন ও তাঁর সমস্ত নেক আমলকে কবুল করুন। (আমিন)। গুণী এই শিক্ষকের পরলোকগমনে গভীরভাবে মর্মাহত সাদার্ন ইউনিভার্সিটি। গুণী এ শিক্ষকের স্মরণে তিনদিনের শোকসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ। এক শোকবার্তায় সাদার্ন ইউনিভার্সিটির ভিসি প্রফেসর ড. মো. নুরুল মোস্তফা, ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান, উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর সরওয়ার জাহান, প্রোভিসি প্রফেসর ইঞ্জিনিয়ার এম আলী আশরাফ, ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভাগীয় প্রধানগণ, শিক্ষকবৃন্দ এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। তাঁরা বলেন, তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল আর অমরা হারালাম একজন অভিভাবক, পথ প্রদর্শক, জ্ঞান প্রদীপ ও বিশিষ্ট ব্যক্তি।

তিনি ছিলেন একজন ভাল মানুষের প্রতিচ্ছবি, নিরহংকারী, একজন অনন্য বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, ধর্ম পরায়ন, নির্লোভ, মিষ্টভাষী, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ও হাজারো শিক্ষার্থীর অনুকরণীয় প্রিয় শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা এবং বিপননের অধ্যাপক। যার জীবনে অন্যায় বা লোভ কখনো স্পর্শ করতে পারেনি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সফল উপাচার্যের পদ ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন বরেণ্য এই শিক্ষাবিদ। এছাড়াও চট্টগ্রাম শহরস্থ সাদার্ন ইউনিভার্সিটিতে দক্ষতার সাথে উপাচার্য এর দায়িত্ব পালন করেছেন, বড়মাপের মানুষ হয়েও যিনি সহজ সরল জীবন যাপন করেছেন, সেপ্টেম্বর ২৬ তারিখে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের শেষ দিন ছিল।

আমার কর্মজীবনের ২০ বছর স্যারের সাথে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল প্রকাশনা ও গবেষণাধর্মী লিখার মান যাচাই ও শুদ্ধতার মাপকাঠির জন্য তিনি ছিলেন অনন্য। আমাদের জন্যে এই ক্ষতি সত্যিই অপূরণীয়। শিক্ষা পেশায় যাঁরা তাঁর সাহচার্যপ্রাপ্ত হয়েছেন তাঁরা বলতে পারবেন তিনি কতটা নিষ্ঠাবান ছিলেন। অনেক কিছুই তাঁর কাছ থেকে শিখেছি। একজন পরিপূর্ণ মানুষ এবং একজন পরিপূর্ণ শিক্ষাবিদ বলতে যা বুঝায় তিনি তাই ছিলেন।

শ্রদ্ধভাজন এই মানুষটি করোনা আক্রান্ত হয়ে স্থানীয়ভাবে ভাল চিকিৎসা না পেয়ে সংকটপূর্ণ অবস্থায় ঢাকায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন অনেকদিন। পরিবারের মাধ্যমে জানা গেল উনার অবস্থা অবনতির দিকে। গতমাসে তাঁর একটু সুস্থতার খবর শুনে যেমন কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলাম পরের মাসেই সেই স্বস্তিটুকুও শেষ হয়ে গেল।

শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং শিক্ষার প্রসারে চিন্তা চেতনায় তিনি ছিলেন অনন্য। কারণ যেখানে যে কাজ করেছেন তিনি সেই কাজকে অত্যন্ত আপন করে নিতেন নিজের পরিবারের মত। এই রকম উঁচু মাপের একজন শিক্ষক যদি ঢাকায় হতো তাঁর প্রচার আরও ব্যাপক হতো। সংকীর্ণতা পরিহার করে এই ধরনের মানূষগুলোকে যথাযথ মূল্যায়ন করলে সকলেই উপকৃত হতো। আমরা সেটা করতে পারিনি। তাঁকে সঠিক সম্মান দেওয়া হয়নি। এইরকম গুণী শিক্ষক ক্ষণজন্মা। আমি ভাগ্যবান, উনার সান্নিধ্যে থেকে কাজ করতে পেরেছি।

কোন অহমিকাবোধ না রেখে সরলমনে দলমত নির্বিশেষে কাজ করেছেন নিঃস্বার্থভাবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন সাধন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে মেধা, মনন দ্বারা একটি যুগোপযোগী উচ্চশিক্ষার ধারায় উন্নীত করেছেন, তিনি অত্যন্ত সাদামাটা, নিরহংকার জীবন যাপন করেছেন। এতো বড় মাপের মানুষ হয়েও সহজ সরল চলাফেরা ছিল সাধারণ। এই বিশ্ববিদ্যলয়ের দায়িত্ব নিয়ে অত্যন্ত সুচারুরূপে প্রতিষ্ঠানটির একাডেমিক ও ভবন উন্নয়নে যে অগ্রণী ভূমিকা রেখে গেছেন, তা প্রশংসনীয় এবং বিশ্ববিদ্যলয় কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ রাখবে আজীবন।অনেক প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার যেমন সুযোগ ছিল, তেমনি পরিবার থেকে অনুরোধও ছিল। কিন্তু কোন কিছুকেই তোয়াক্কা না করে আঁকড়ে ছিলেন সাদার্ন ইউনিভার্সিটিতে। এই বয়সেও অফিসের নিয়মানুবর্তিতা তার কাছ থেকে ছিল শিক্ষণীয়। যা অনেক প্রবীণ ও নবীনের মধ্যেও দেখা যায় না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি শিক্ষকতা পেশাকে ভালবেসে দায়িত্ব পালন করেছেন। সাদার্ন ইউনিভার্সিটির কোন কাজ কোনদিন অনীহা দেখাননি, ছোট করেও দেখেননি। শুধু আক্ষেপ করে বলতেন সঠিক অবকাঠামো পেলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

একজন মানুষের সব কিছু থাকে না, কোন না কোন খুঁত থাকে। কিন্তু তিনিই আমার দেখা এমন একজন ব্যক্তি, যাঁর ক্ষেত্রে এটি ব্যতিক্রম। এ বয়সেও এতো কাজ নিখুঁতভাবে সম্পাদন করেছেন যা ভাবা যায় না। তাঁর চলা, বলা, লেখা সবকিছুতেই ছিল যেন এক অপূর্ব সম্মিলন। তিনি শুধু লেখাপড়া নিয়ে থাকতেন তা নয়; ক্রিকেট পাগল সংস্কৃতিমনা মানুষটি চলে যাওয়া আমাদের অঙ্গন আজ বিষাদে ভরে গেছে, লিখতে গিয়ে বার বার থমকে যাচ্ছি, কেননা এই প্রিয় নক্ষত্রটি আজ আমাদের ছেড়ে অসীমের পথে পাড়ি দিয়েছেন। তারপরও ভাল মানুষেরা সবসময় অমর হয়েই থাকবেন ।

হাটহাজারির উত্তর মাদার্শায় ১৪ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে তাঁর জন্ম। তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে এক পুত্র সন্তান রেখে গেছেন। তার একমেয়ের শ্বশুর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপচার্য জনাব ফজলী হোসেন। তিনি চট্টগ্রাম মুসলিম হাই, চট্টগ্রাম সরকারি বাণিজ্য কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন । শুধু মেধাবী নন প্রতিটি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন ১৯৭২ সালে, এছাড়াও ইংল্যান্ডের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় উচ্চতর ডিগ্রি নেন। যে ত্যাগ, মেধা, সময় তিনি দিয়ে গেছেন, তা কখনো ভুলবার নয়। ইতিহাস স্মরণ রাখবে যুগ যুগান্তর, অনন্তকাল। এরকম ব্যক্তিরাই সব সময় স্মরণীয়, বরণীয় হয়ে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে। সাদার্ন ইউনিভার্সিটির অগ্রযাত্রায় মহান এ শিক্ষকের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এইরকম একজন মানুষ বেঁচে থাকলে সমাজের আরো অনেকের আলোকিত হবার সুযোগ হতো।

মানুষের মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু একজন সফল শিক্ষকের কি মৃত্যু হয়? আমার এই অভিভাবক, এই গুণী ব্যক্তিত্ব বেঁচে থাকবেন তাঁর অগণিত শিক্ষার্থীর মনের মাঝে, তাদের সফলতার মাঝে। তাঁর কর্ম, তাঁর শিক্ষা, তাঁর আদর্শ দেশেবিদেশে, সরকারিবেসরকারি বিভিন্ন পদে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অগণিত শিক্ষার্থীদের কাছে স্মৃতি হয়ে থাকবে যুগযুগান্তর।

আজ আমাদের মাঝে প্রফেসর এ.জে.এম নুরুদ্দীন চৌধুরী প্রয়াত। আল্লাহ জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন। আমিন, আমিন।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ব্যবসায় প্রশাসন, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরশ্রীকাতর না হয়ে নিজেকে সুখি করে তুলতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধহিডেন হার ফাউন্ডেশনের উপহার সামগ্রী প্রদান