সারা দেশে প্রতিদিন সূচি ধরে এক ঘণ্টা করে বিদ্যুতের লোডশেডিং শুরু হচ্ছে আজ মঙ্গলবার থেকে। এক সপ্তাহ এভাবে চলার পর ‘অবস্থা দেখে’ পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গতকাল সচিবালয়ে নিজের দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পেট্রোল পাম্প সপ্তাহে একদিন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত কবে থেকে কার্যকর হবে, তা এখনও ঠিক হয়নি। খবর বিডিনিউজের।
বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকট এড়াতে এদিন সকালেই বিদ্যুৎ ও তেলের খরচ কমানোর একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত হয় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ডিজেলের দাম ‘আকাশচুম্বি’ হয়ে যাওয়ায় আপাতত দেশে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন স্থগিত রাখা হবে। পাশাপাশি পেট্রোল পাম্প বন্ধ থাকবে সপ্তাহে একদিন। চলমান ডলার সংকটের প্রেক্ষাপটে জ্বালানি তেল আমদানিতে ঋণপত্র খোলায় জটিলতা এবং আগের মূল্য পরিশোধে ধীরগতির খবরের মধ্যে সরকারের তরফ থেকে এসব সিদ্ধান্ত হলো। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে, এখন কয়লা থেকে ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, গ্যাস থেকে ৫০ দশমিক ৮৪ শতাংশ, ফার্নেস অয়েল থেকে ২৮ শতাংশ এবং ডিজেল থেকে ৬ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এ অবস্থায় জ্বালানি সাশ্রয় নীতির কারণে দিনে এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তা সমন্বয় করতেই দিনের একটা সময় বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতে হবে বিভিন্ন এলাকায়। আপাতত দিনে এক ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের পরিকল্পনা জানিয়ে নসরুল হামিদ বলেন, আমরা আগামীকাল (আজ) থেকে শুরু করব। এক সপ্তাহ দেখব। যদি দেখি এক ঘণ্টায় হচ্ছে, ফাইন। আমরা চেষ্টা করব পিক ও অফ পিকের জায়গাটা দেখার জন্য। আমরা যদি দেখি পিকের জায়গায় এক ঘণ্টা দিলে কভার করতে পারব, ফাইন। আর যদি দেখি, অফ পিকের জায়গায় এক ঘণ্টা দিলে কভার হচ্ছে, তাহলে সেটাই করব।
গ্যাসের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য ‘পিক ও অফ পিকের’ জায়গা বেছে নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এলাকাভিত্তিক আমরা সারা বাংলাদেশে যদি এক ঘণ্টা লোডশেডিং দিই, আমার মনে হয় না তেমন সমস্যা হবে। বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পিক আওয়ার ধরা হয়, মানে এই সময়ে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা থাকে। এভাবে এক সপ্তাহ দেখে পরের সপ্তাহে লোডশেডিং বাড়বে কি বাড়বে কিনা সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তবে শিল্প ও বাণিজ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা তুলে ধরে নসরুল হামিদ বলেন, আমরা প্রায়োরিটি দেব ইন্ডাস্ট্রিতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের, বাণিজ্যে যেন বিদ্যুৎ পায়। কখন কোন এলাকায় বিদ্যুৎ বন্ধ থাকবে সেই সূচি জানিয়ে দেবে বিতরণ সংস্থাগুলো। তবে গতকাল বিকাল ৫টা পর্যন্ত সেটা চূড়ান্ত হয়নি বলে ডিপিডিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বৈদেশিক বাণিজ্যে লেনদেন ভারসাম্যে বড় ধরনের ঘাটতিতে থাকা বাংলাদেশ বিদেশি মুদ্রা বাঁচানোর জন্য নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মধ্যে জ্বালানি তেল আমদানিতে এলসি পেতে সমস্যা হচ্ছে বলে সমপ্রতি খবর এসেছে। সারা দেশে যে ডিজেল ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে ১০ শতাংশ যায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং বাকি ৯০ শতাংশ পরিবহনসহ অন্যান্য খাতে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুতের ১০ শতাংশ এবং অন্যান্য খাত থেকে আরো ১০ শতাংশ, মোট এই ২০ শতাংশ ডিজেল সাশ্রয় করতে পারলে যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা আমরা সেইভ করতে পারব, এটা অনেক বড় বিষয় হবে। এ সিদ্ধান্ত আমরা না নিলে সারা বছর এই ১০ শতাংশ ডিজেলের যে দাম দেই সেই মূল্য তো আমরা বিদ্যুৎ থেকে পাব না। ডিজেল থেকে যে বিদ্যুৎ হয়, তা ৩৫ থেকে ৪০ টাকার মতো পড়ে প্রতি ইউনিট। বিদ্যুৎ বিক্রি করছি গড়ে প্রায় ৭ টাকায়। ডিজেল আমদানি কমালে ভর্তুকির খরচও কমবে হবে বলে মন্তব্য করেন নসরুল হামিদ।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বের বহু দেশ জ্বালানি সংকটে হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশ এ মাসের শুরু থেকেই স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। এখন জ্বালানির আমদানি খরচে রাশ টানতে ডিজেলের দিকে নজর দিয়েছে সরকার। বিপিসির হিসাবে, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩০ লাখ ৬৩ হাজার টন বিভিন্ন ধরনের পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি হয়েছে। এ সময় অপরিশোধিত তেল এসেছে ৮ লাখ ৭০ হাজার টন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানিতে পরিশোধ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন। শতকরা হারে বেড়েছে ১০৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ সময়ে এলসি খোলার পরিমাণও বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৩ দমশিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার; বেড়েছে ১১১ শতাংশ।
নসরুল হামিদ বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিপিসি মূল্যবৃদ্ধির জন্য জানিয়েছে। আমরা এ বিষয়টাও লক্ষ্য রাখছি। প্রাইস অ্যাডজাস্ট করলেই তো সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের দেখতে হবে কতটুকু সাশ্রয় করলে আমরা চলতে পারি। তার পরবর্তী অবস্থায় মেজারস আমরা কী নেব? তবে সরকার আপাতত সমন্বয়ে না গিয়ে গ্রাহকদের জন্য মূল্য স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে ভারতের থেকে আমাদের তেলের দাম ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কম। আমরা কিন্তু এখনো অ্যাডজাস্টমেন্টে যাইনি। তাহলে তেলের দাম বাড়ানোর চিন্তাভাবনা কি সরকারের নেই? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখনো চিন্তাভাবনা করছি।
সপ্তাহে একদিন পেট্রোল পাম্প বন্ধের বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিপিসি পেট্রোল পাম্প মালিক সমিতির সঙ্গে বসবে। সপ্তাহে একদিন বন্ধ রাখতে পারি কিনা সেটা চিন্তাভাবনা করব। উপাসনালয়ে এসি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে নামাজের সময়টুকু এসি ব্যবহার করে বাকি সময় বন্ধ রাখতে অনুরোধ করেন তিনি।
রাত ৮টার পর শপিংমলের আলোকসজ্জা বন্ধ : রাত ৮টার পর দোকানপাট, শপিংমল বন্ধ থাকবে। একই সঙ্গে শপিংমলের আলোকসজ্জাও বন্ধ রাখতে হবে। নির্দেশনা অমান্য করলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, অফিসের সময় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এটা নিয়ে এখনো পুরোপুরি সিদ্ধান্ত হয়নি। এটা নোটিশ আকারে যাবে।