প্রতিটা সকালে আমার দৃষ্টি চলে যায় কারাগারের প্রধান ফটকে

কুমুদিনি কলি | মঙ্গলবার , ১ নভেম্বর, ২০২২ at ৬:৫৮ পূর্বাহ্ণ

পুলিশ হেডকোয়ার্টারের প্রধান ফটকের বাম পাশ লাগোয়া যে কৃষ্ণচূড়া গাছটি দাঁড়িয়ে আছে, তাতে এই ভরা ভাদ্রেও আগুনরঙা কৃষ্ণচূড়া। তার যৌবন যেনো ফুরালো না আর! সদ্য বৃষ্টিস্নাত হওয়াতে তার রং যেনো উপচে পড়ছে। তিরতির করে কাঁপতে থাকা সবুজ পাতা, তার ফাঁকে ফাঁকে সিঁদুর রঙা কৃষ্ণচূড়া। সকালের একপশলা বৃষ্টিশেষে সূর্যের সোনা রোদ এখন তার গায়ে। রোদে, লালে, সবুজে তার সেকি রূপ! ভাদ্রের শেষ প্রসঙ্গেও সে সমান রূপবতী! জেল রোডের ধার ঘেঁষে প্রতিটা সকালে যখন গাড়ি তার বাঁক নেয়, আমার দৃষ্টি চলে যায় কারাগারের প্রধান ফটকে। অদ্ভুতভাবে আমার পুরোটা শরীর কেঁপে ওঠে। অন্তরটাও। এই কারাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সরকার কর্তৃক, অপরাধীদের অপরাধের শাস্তির জন্য। এর সাথে জড়িত আছে নানা প্রকার প্রতিষ্ঠান, আইন, নিয়ম-কানুন। সেসবের কোনটাই আমি ততটা জানি না। তবে আমি এইটুকু জানি, এই আইনের ফাঁকফোকরে বিভিন্নভাবে নিরপরাধ মানুষেরাও হয়রানির শিকার হয়ে অপরাধের দণ্ডপ্রাপ্ত হয়।
আর সে মানুষগুলো জীবন থেকে হারিয়ে ফেলে তার সোনালি সুদিন। তাদের পরিবার ক্ষয়প্রাপ্ত হয় দিনের পর দিন, ক্ষয়ে যাওয়া মানুষগুলোর সাথে। এমনি হাজারো পরিবার এখনো দিনগোনে, সুবিচার প্রাপ্তির আশায়। বিনা অপরাধের জেরে কারাবাসের তিক্ত অভিজ্ঞতা কেউ ভুলতে পারে না। সমাজ তাকে, তাদেরকে সেই কথা মনে করিয়ে দেয় প্রতিটা পদে পদে। আর তাই মানুষগুলোর মেরুদণ্ড আর সোজা হয় না, কক্ষণো।
খুব কাছ থেকে না দেখলে, অনুভব করা যায় না এর ক্ষতটা ঠিক কতটুকু দগদগে। কারাগারের পাশের রাস্তায় সকাল, দুপুর, বিকেল–সবসময় দেখতে পাওয়া যায় বেশ মানুষের আনাগোনা। খুব খেয়াল করলে দেখা যায়, কারোর কোলে কাঁথা মোড়ানো ছোট্ট শিশু। কারোর বয়স্ক বাবা-মা। অনেক দূর থেকে চিৎকার করে তারা জেলের বন্দীদের সাথে কথা বলতে চায়। আর এতদূর থেকে কিছু বুঝতে না পারা বন্দীরা ছোটো ছোটো জানালাগুলোয় মাথা ঠেকিয়ে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে। এই অসহায় দৃষ্টির কাছে পৃথিবীর যাবতীয় কষ্ট তুচ্ছ। চোখ তুলে তাকাতেই কষ্ট হয়। আর বিফল মনোরথে পরিবারের যারা ফিরে যায়, তাদের চোখে আর জল থাকে না। সে চোখগুলোর দিকে তাকাতে গেলে প্রচণ্ড সাহসের প্রয়োজন। প্রতিদিনের আসা-যাওয়ার পথে চিরচেনা এই দৃশ্যগুলোতে চোখ ভিজে যায়, কিন্তু কিছু করার থাকে না। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা জানানো, যারা নিরপরাধ, তাদের পরিবার যেনো তাদের সসম্মানে ফিরে পায়। এইটুকুন ছাড়া আমাদের মতো সাধারণের হাতে করার মতো আর কিছুই থাকে না। আবার চোখ চলে যায় সেই কৃষ্ণচূড়ার আগুনে, যেখানে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যেনো একসাথে মাখামাখি হয়ে থাকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধছিনতাই হয়ে গেছে
পরবর্তী নিবন্ধঅনুভব