পৃথিবীতে কেউ অপরিহার্য নয়…

লতা মঙ্গেশকর | সোমবার , ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

গত ৬ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হলেন ভারতের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর। গত সেপ্টেম্বরে ৯২ বছর পূর্ণ করেছিলেন তিনি। সেসময় জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ভারতীয় সাংবাদিক সুভাষ কে ঝা। প্রয়াণের দিন ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ফার্স্টপোস্ট সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করে। শেষদিকে নেওয়া এটি তাঁর অন্যতম একটি সাক্ষাৎকার। এতে ওঠে আসে লতা মঙ্গেশকরের ব্যক্তিগত ও সঙ্গীতজীবনের নানা অজানা কথা, বিশেষ করে সিনেমায় জনপ্রিয় ও বিস্মৃত কিছু গানের নানা গল্প।
সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন রাফসান গালিব
আপনি ছাড়া এ-পৃথিবী কি কল্পনা করা যায়?
এ-পৃথিবীতে কেউ অপরিহার্য নয়। আমার থেকে অনেক অনেক বেশি প্রতিভাবান মানুষ-বিজ্ঞানী, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা, চিকিৎসক এবং প্রকৌশলী এসেছেন এবং চলে গেছেন। কিন্তু পৃথিবী থেকে যায় তার মতো।

কিন্তু আপনার লিগ্যাসি কখনো ক্ষয় হবে না। একশ বছর পরেও আপনার গান শোনা হবে

সেটি খুব নিশ্চিত করে বলা যায় না। আজকাল তরুণদের মনোযোগের পরিধি খুবই সীমিত। তারা মোটেও অতীতের দিকে তাকায় না। এটি হচ্ছে তাৎক্ষণিক পরিতৃপ্তির যুগ। মুহূর্তকে ঘিরে সবাই বাঁচতে চায়। ফলে আমি সন্দিহান, আমার গান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কতটা অর্থবহ হবে, আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে কী না।

সঙ্গীত জগতের আপনার সমস্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সমসাময়িকরা চলে গেছেন। তাঁদের কথা কি আপনার মনে পড়ে?

অবশ্যই। আমার সহকর্মী মোহাম্মদ রফি সাব, কিশোর দা (কিশোর কুমার), মুকেশ ভাইয়া, মান্না দা (মান্না দে) ছিলেন আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমি প্রতিদিন রেকর্ডিংয়ে তাঁদের সঙ্গে দৌড়াতাম। সম্পর্কগুলো শুধু কাজের জন্য ছিল না। সুরকার এবং গীতিকার যেমন মদন ভাইয়া (মদন মোহন), নরেন্দ্র শর্মা যাকে আমি ড্যাডি ডাকতাম, চিত্রগুপ্ত সাব এবং মাজরুহ সুলতানপুরী সাব নিয়মিতই আমার বাড়িতে আসতেন। আমি তাঁদের বাড়িতে যেতাম। আমরা ছিলাম পরস্পরের পারিবারিক বন্ধু। আর এখন মানুষ দেখা করে ভিডিও কলে।

কারা আপনার প্রিয় সুরকার ছিলেন?
এটি একটি বিপজ্জনক প্রশ্ন। যদি আমি কোনো নাম ভুলে যাই, তখন সমস্যায় পড়ে যাই, (হাসি)। তবে সত্যিই আমি শঙ্কর-জয়কিশ-ান, সলিল চৌধুরী, এসডি বর্মণ, আরডি বর্মণ, লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল, চিত্রগুপ্ত এবং আমার ভাই হৃদয়নাথের সুরে গাইতে দারুণ উপভোগ করেছি। আমি তাঁদের নাম উল্লেখ করলাম, তাঁদের সাথে আমি প্রচুর কাজ করেছি। অন্য যেসব সুরকারদের সঙ্গেও আমি কাজ করেছি তাঁরাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। আমি প্রত্যেক গীতিকার ও সুরকারের কাছে একেবারে হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞ, যারা তাঁদের গান আমাকে গাইতে দিয়েছেন। যদি রাজা মেহদী আলী খান লাগ যা গালে না লিখতেন এবং মদন মোহন সেটি সুর না করতেন, তাহলে কী আমি সেটি গাইতাম?

লাগ যা গালে গানের কথা বললেন। আপনার ভান্ডারের উজ্জ্বল রত্নগুলোর মধ্যে এই গানটির অবিনশ্বর জনপ্রিয়তাকে কীভাবে দেখেন?
আমি জানি না, কেন কিছু গান অন্যগুলোর চেয়ে অধিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে? উও কৌন থি (১৯৬৪) সিনেমায় দারুণ সুর করা আরেকটি গজল আমি গেয়েছি- জো হামনে দাস্তান আপনি সুনায়ে আপ কিয়ো রোয়ে। কিন্তু লাগ যা গালে বছরের পর বছর ধরে প্রমাণ করেছে, সেটিই বেশি জনপ্রিয়। কেন কিছু গান অন্যগুলোর চেয়ে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে থাকে, তা বলা মুশকিল।

আপনার জনপ্রিয় গানগুলো অনেক দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু একেবারে আপনার পছন্দের গানগুলো সেভাবে স্বীকৃতি পায়নি, তেমন হয়েছি কি?
স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়ে আমার ধারণা নেই। তবে আমার নিজস্ব পছন্দের গানগুলো সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে এমন নয়। মায়া মেমসাব (১৯৯৩) সিনেমায় আমার ভাই হৃদয়নাথের সুর করা গানগুলো আমার খুব ভালো লাগে। লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলালের সুর করা একটি গান আছে, ইয়ে রাত ভি জা রাহি হ্যায় (সাউ সাল বাদ, ১৯৬৬)। সেটি আমার খুব প্রিয়। এরপর আছে রুস্তম সোহরাব (১৯৬৩) সিনেমায় সাজ্জাদ হুসাইন সাবের সুর করা এয় দিলরুবা নাজরিইন মিলা। এ ছাড়া ঋষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের অনুরাধা (১৯৬০) সিনেমায় পণ্ডিত রবিশঙ্করের সুর করা গানগুলোও আমি খুব পছন্দ করি। কিন্তু জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে অনেক গান অনেক কারণে পিছিয়ে যায়।

গাওয়ার পর আপনার অনেক গান সিনেমায় ব্যবহারই করা হয়নি। এ নিয়ে কি আপনি কখনো আফসোস করেন?
তখন আসলে আফসোসের সময় ছিল না। আমরা এক রেকর্ডিং থেকে অন্য রেকর্ডিংয়ে ছুটতাম। আমার গান একবার রেকর্ড হয়ে গেলে সেটি কখনো আমি শুনে দেখতাম না। ফলে আমার জানার উপায় ছিল না, কোনটি পরে ব্যবহার করা হয়েছে, কোনটি হয়নি। তবে একটি গান কোনো সিনেমায় ব্যবহার না হলে, সেটি তার প্রাপ্য স্বীকৃতি পায় না। আমার মনে আছে মিলন (১৯৬৭) সিনেমাতে লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলালের একটি সুন্দর কম্পোজিশন ছিল- আজ দিল পে কোই জোর চলতা নাহি, যেটি সিনেমা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলালের সুর করা গানগুলোর মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় এটি। আমি খুশি যে মদন মোহনের সুর করা কিছু গান অব্যবহৃত রয়ে গিয়েছিল, সেগুলো যশ চোপড়া বীরজারা (২০০৪) সিনেমায় কাজে লাগিয়েছেন। ফলে তেরে লিয়ে এবং তুম পাস আ রাহি হো’র মতো অসম্ভব মেলোডি গানগুলো পুনরুজ্জীবন পেয়েছিল। নইলে তারা বিস্মৃতিতেই থেকে যেত।

একবার রেকর্ডিংয়ের সময় আপনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন
সলিল (চৌধুরী) দা’র সাথে একটি গান রেকর্ডিংয়ের সময় আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম বলে কথাবার্তা চালু আছে। তবে সেটি ভুল। অবশ্যই তার গান গাওয়া খুব কঠিন ছিল। এমনকী আমার ভাই হৃদয়নাথের গানও। তবে আমার বাবার আশীর্বাদে রেকর্ডিং স্টুডিওতে যে কোনো চ্যালেঞ্জ আমি মোকাবিলা করতে পারতাম। এই ঘটনা সলিল দা’র সঙ্গে নয়, ঘটেছিল নওশাদ সাবের সঙ্গে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরম এক বিকেলে আমরা রেকর্ডিং করছিলাম। গ্রীষ্মে মুম্বাইয়ের অবস্থা কেমন হয় জানেনই তো। সেসময় স্টুডিওতে কোনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও ছিল না। চূড়ান্ত রেকর্ডিংয়ে এমনকী ফ্যানও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ব্যাস, আমি তখন অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

রেকর্ডিংয়ে কার সঙ্গ আপনি সবচেয়ে উপভোগ করতেন?
কিশোর দা। তাঁর সঙ্গে রেকর্ডিং মানেই ছিল আনন্দের। তিনি আমাকে এত হাসাতেন, আমি গাইতে পারতাম না। আমি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলতাম- কিশোর দা, আগে গান, তারপর মাস্তি। এটি বেশি সমস্যা করত যখন আমরা দুঃখের কোনো ডুয়েট গাইতাম। তখন দুঃখের কান্নার পরিবর্তে হাসির কান্না চলে আসত আমার।

কথিত আছে যে, হির রানঝা (১৯৯২) সিনেমায় মদন মোহনের হির এবং ইশক পার জোর নাহি ((১৯৭০) সিনেমায় এসডি বর্মণের তুম মুঝছে দুর চালে জানা না রেকর্ডিং করার সময় আপনি ছাড়া সবাই কেঁদেছিল?
সেটি সত্য। আমি ছাড়া সবাই কেঁদেছিল। খুব বিষণ্ন কোনো গানেও আমার কখনো কান্না আসে না। আমি কান্নার চেয়ে হাসিকেই প্রাধান্য দিয়েছি। ঈশ্বর আমার প্রতি সব সময় সদয় ছিলেন। আমাকে কান্নার কোনো কারণ দেননি। তবে আমার মনে আছে আমি সবচেয়ে বেশি কেঁদেছিলাম যখন আমার বাবা ও মাকে হারিয়েছিলাম।

৯২ বছর বয়সে এসে আপনি কি আপনার তারুণ্যের সময়টিকে মিস করেন?
আমি কি আপনাকে সত্যিটা বলব? আমি আমার বয়স মনে রাখি না। আমি নিজেকে এখনো তরুণই মনে করি। আমি কখনো আমার কষ্টগুলো নিয়ে ভারাক্রান্ত হইনি। প্রত্যেকের জীবনে তার সমস্যাগুলোর ভাগ রয়েছে। যখন আমি ছোট ছিলাম এবং সংগ্রাম করছিলাম, তখন কিশোর দা ও মুকেশ ভাইয়াদের মতো অন্যান্য সংগ্রামী মানুষদের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে এক স্টুডিও থেকে আরেক স্টুডিওতে ঘুরতে আমার ভালো লাগত। এমনকি সারা দিন না খেয়ে কাটালেও সেসব সময় ছিল দারুণ আনন্দের। তখন আমার কাছে টাকা ছিল না। মনে শুধু আশা ছিল। ভবিষ্যৎ যতই কঠিন লাগুক না কেন, একটি ভালো আগামীকালের আশাই আমি সবসময় করেছি।

সর্বশেষ আপনার কোনো ভাবনা…
গত ৭০ বছর ধরে আমার সঙ্গে থাকার জন্য আমার শ্রোতাদের প্রতি আমি যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা জানাতে পারিনি। সময়টি কীভাবে চলে গেল বুঝতেও পারলাম না। আমি যদি আবার সুযোগ পেতাম, কিছুই পরিবর্তন করতাম না। একটি জিনিসও না। এমনকি উমা দেবীর সঙ্গে রেকর্ডিংয়ের সময় টুল থেকে পড়ে যাওয়াটাও।

পূর্ববর্তী নিবন্ধলায়ন্স ক্লাব অব চিটাগাং মেট্রোপলিটনের খতনা ক্যাম্প
পরবর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল