সকাল থেকেই বৃষ্টি। কখনও জোরেসোরে আবার কখনও ধীর গতিতে হচ্ছে। তারপর হঠাৎ হঠাৎই মেঘ গর্জন করে ওঠে। এখন বৃষ্টির তীব্রতা বেড়েছে। বৃষ্টি পছন্দ করে পারুল। বিশেষ করে পাহাড়ি বৃষ্টি। এই মুহূর্তে তার গ্রামের কথা খুব মনে পড়ছে।
দুর্গম পাহাড়ে অবস্থিত পারুলের গ্রামটি খুব সুন্দর। সুউচ্চ পাহাড়, দূরের সমভূমি, বয়ে যাওয়া নদী, গাছপালা, পশু-পাখি সবই সুন্দর। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাতাস, মাথার ওপর নীল আকাশ। প্রকৃতি স্নেহময়ী মায়ের মতো স্নেহের সাথে সকলকে কোলে তুলেছে। পারুল গ্রামে মুক্ত পাখির মতো কিচিরমিচির করত। তার খুব ভালো লাগতো যখন বৃষ্টির পর আকাশে রঙিন রংধনু দেখা দেয়। সেই রংধনু দেখে ছোটবেলা থেকেই তার মন অনেক স্বপ্ন বুনেছে। কিন্তু কৈশোরে পা রাখার পর স্বপ্নগুলো আরও রঙিন হয়ে ওঠে। মনের রাজপুত্রও রঙিন স্বপ্নে তার সাথে দেখা দেয়।
পারুলের পৃথিবীতে সুন্দর স্বপ্ন ছিল। কিন্তু দুইবেলা খাবারের অভাব। শরীর ঢেকে রাখার জন্য অপর্যাপ্ত পোশাক। মা আর ছোট ভাই সবাই মাঠে কাজ করে। এত পরিশ্রম করে যা পায় তার একটা বড় অংশ চলে যায় বাবার মদের নেশায়। যেটুকু বাকি ছিল, দু’বেলা কষ্ট করে চুলাও জ্বলতে পারে। কষ্ট সত্ত্বেও, সে স্বপ্ন নিয়ে খুশি ছিল। সে আশা করেছিল একদিন তার স্বপ্ন পূরণ হবে।
পারুলের স্বপ্নের শান্ত জগতে হঠাৎ আলোড়নের মতো এলো শিপন। পাঁচ বছর আগে সে গ্রাম থেকে পালিয়ে দুবাই চলে যায়। দুবাইয়ের চমকপ্রদ গল্প তাকে টেনে নিয়ে গেছে। তারপর থেকে তার কথা কেউ জানে না। যখন সে ফিরে এলো তখন তার চেহারা সুদর্শন যুবকের মতো। বাংলা চলচ্চিত্রের নায়কের মতো চেহারা তৈরি করেছে শিপন। সবাই এমনই মন্তব্য করল। দুবাই যাওয়ার পর তার হাতে কিছু ধন এসেছে। একসময় বাবা-মা তাকে অকেজো, অলস বলে ডাকত। এখন সবার কাছে সে প্রশংসিত।
প্রতিবেশী পারুলও শিপনের উন্নতি দেখে মুগ্ধ। সে মায়ের সাথে শিপনকে দেখতে গেল। শিপন পারুলকে খুব পছন্দ করল। দু’জনে বন্ধু হয়ে গেল। পারুলও তার প্রতি আকৃষ্ট হলো। দুজনেই প্রতিদিন দেখা করে। শিপন দুবাইয়ের গল্প শোনায়। মনে মনে দুবাই যাওয়ার স্বপ্ন দেখে পারুল।
একদিন দুজনেই নদীর তীরে বসা। শিপন বলল, আমার সাথে দুবাই যাবি? তোদের পারিবারিক অবস্থা আবার ঘুরে যাবে। এখানে সারাদিন মাঠে কাজ করিস, তবু পেট ভরে খেতে পাস না। ওখানে ঘরের কাজের জন্য ভালো টাকা পাবি। এই পারুল। বৃষ্টি হবে রে!
তার কথা শুনে পারুল প্রলুব্ধ হয়ে বলল, তুমি সত্যি বলছো?
হ্যাঁ আমাকে দেখ। আমি অনেক টাকা উপার্জন করেছি। ওখানে এমন নয় যে পরিশ্রম করে কেউ কিছু পাবে না। কঠোর পরিশ্রমের মূল্য আছে।
শিপন যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল তার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। সে সারারাত জেগে থাকে। শিপনের কথাগুলো কানে বাজতে থাকে। সে একটি সুখী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। পরদিন বাড়িতে কথা বলল। ব্যাখ্যা করে বলল, যদি সে দুবাই যায় তবে বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে অভাব দূর করতে পারবে। এছাড়া দুবাই পাঠানোর ভিসা আর বিমান ভাড়ার খরচও লাগবে না।
মা সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি করলেন। বললেন, তুই বিদেশ গিয়ে একা থাকবি কী করে?
কিন্তু তার মাতাল বাবা শুধু টাকার বান্ডিলগুলো কল্পনায় দেখতে পেলেন। তিনি পারুলের মাকে গালি দিলেন। পারুলের মনে হল মা তার স্বপ্ন বুঝতে পারছেন না। তার স্বপ্নের মাঝে প্রাচীর হয়ে উঠছেন। কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপচাপ শিপনের সঙ্গে শহরে চলে এলো সে। মাসখানেক লাগবে পাসপোর্ট বানানো আর ভিসা প্রসেসিং কাজ শেষ করতে।
শিপন শহরে পৌঁছে পারুলকে একটি ছোট খোলসে আটকে রাখে। এখানে দমবন্ধ হয়ে এলো পারুলের। সে বার বার বিদেশে যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করল। শিপন বলল, বিদেশ যেতে সময় লাগে।
এভাবে কয়েকটা দিন কেটে গেল। একদিন শিপন এসে বলল, তোকে রেডি হতে হবে। আজ তোকে পাসপোর্ট অফিসে নিয়ে যাবে।
পারুল খুশি খুশি রেডি হয়ে চলে গেল। দুজনে একটা বড় বাড়িতে পৌঁছে গেল। বাড়ির ভেতরে একটি বড় সুইমিং পুল। পারুল খুব কৌতূহলী হয়ে সব দেখছে। শিপন তাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। একটি ঘরে একজন মোটা মতোন মহিলা বসা। পারুলকে মহিলার সামনে নিয়ে গিয়ে শিপন বলল, এটাই…।
মহিলাটি মাথা থেকে পা পর্যন্ত পারুলের দিকে তাকাল। যেন নিজের চোখ দিয়ে চেখে দেখছেন। এরপর শিপনের হাতে একটি খাম তুলে দেওয়া হয়। পকেটে রেখে শিপন হেসে বেরিয়ে গেল। পারুল কিছুই বুঝতে পারল না। যখন বুঝতে পারল অনেক দেরি হয়ে গেছে। সে এক ভয়ানক নরকে আটকা পড়ল। প্রতিদিন কিছু দুষ্টু গোছের লোক এসে তাকে বকা দেয়। কয়েকদিন ধরে তার চিৎকার এই বাড়ির ভেতরে আছড়ে পড়তে থাকে। তারপর সেও চিৎকার বন্ধ করে দিল। সারাদিন তাকে আর অন্য মেয়েদের বাড়ির উপরের অংশে রাখা হয়। সন্ধ্যায় তাদের প্রস্তুত করে লালসা-ক্ষুধার্ত নেকড়েদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বারোজন মেয়েকে একটা ছোট ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। প্রত্যেকের বয়স চৌদ্দ থেকে বাইশ বছরের মধ্যে। ঘরে একটাই ছোট জানালা। এত লোক থাকায় দমবন্ধ হয়ে গেল।
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে পারুল। বৃষ্টি একটু আগেই থেমে গেছে। জানালা দিয়ে যে আকাশের টুকরো দেখা যাচ্ছিল তার গায়ে রংধনু ফুটেছে। তাকে দেখে পারুলের গ্রামের কথা মনে পড়ে গেল। এই জাহান্নামে সে এসেছে ছয় মাস হলো। এখানে প্রতি রাত তার জন্য কষ্ট নিয়ে আসে। কিন্তু এসবের মাঝেও তার মনে একটা আশা যে, একদিন সে অবশ্যই গ্রামে যাবে। আজ রংধনু দেখে তার আশা দৃঢ় হল।