ভদ্রলোক মিনিবাস ধরবেন। কাজির দেউড়ি স্টপেজ থেকে। বাস থামার পর ক’জন যাত্রী নামেন। উঠবেনও বেশ ক’ জন। ফাঁক তৈরি হলে হাতল ধরে দ্রুত উঠতে গিয়েই বিপত্তি। অদৃশ্য কিছুর সাথে টান খেয়ে তিনি পড়ে যান রাস্তায়। গাড়ির কন্ডাকটর সার্বক্ষণিক ব্যস্ত মানুষ। ছোটখাট বিষয়ে মনোযোগ বা অপেক্ষার প্রশ্নই ওঠেনা। মিনিবাস ভরা যাত্রী। করোনাবিধি মতে ভাড়া দ্বিগুণ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে নিতে হয় অর্ধেক যাত্রী, তাও বাধ্যতামূলক মাস্ক পরিহিত। কিন্তু ভাড়ার বিধি মেনে দ্বিগুণ ভাড়া নিলেও গরজ নেই অর্ধেক যাত্রী নেয়া বা মাস্ক শর্তপূরণের। আইন প্রয়োগে মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসে। ওইটুকুই শেষ। তারপর সব চলে যানচালক- মালিকের ইচ্ছায়। ভদ্রলোক হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ান। বেশি ব্যথা পাননি হাল্কা পাতলা বলে। কিন্তু পা চালাতে গিয়ে আবার আটকে যান। চপ্পলে আটকে আছে কিছু। হাতড়ে দেখেন, পলিথিন আটকানো চপ্পলে। হাতে টেনে ছুটিয়ে নেন। ময়লা পিলিথিনটিতে আঁটালো কিছু একটা কঠিনভাবে আটকে ছিল। যা কামড়ে ধরে তাঁর চপ্পল। বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো। গাড়িটি দাঁড়ানো থাকায় কপালগুণে বেঁচে গেছেন।
এমন ঘটনা-দুর্ঘটনা প্রচুর। কিছু হঠাৎ চোখেও পড়ে। বেশির ভাগ আড়ালেই। বড় দুর্ঘটনা হলে মিডিয়ায়ও ভাসে। ফুটপাত, ব্যস্ত পয়েন্ট বা মোড়ে এরকম ছোট বড় পলিথিন ব্যাগসহ উৎকট প্রচুর আবর্জনা প্রায় চোখে পড়ে। বর্ষায় বৃষ্টিতে আরও বেশি। আসলে এগুলো ছড়াই বা ফেলি আমরা! বাসার উপর থেকে কিছু মহিলা আবর্জনাও ছুঁড়ে ফেলেন। এমন অসুখ, নাগরিক দায়বদ্ধতার অভাব, নাকি জঘন্য স্বেচ্ছাচারিতা? এনিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত বা পরামর্শও নেই। চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতার অন্যতম একটি উপসর্গ পলিথিন, প্লাস্টিক বোতল, বয়াম কৌটাসহ অপচনশীল বর্জ্য। এসব বর্জ্য নালা, নর্দমা, খাল, জলাশয়, নদীতে জমে পরিবেশ দূষণ ও জল নিস্কাশন ব্যবস্থা দ্রুত অচল করে দেয়। সামান্য বৃষ্টিতেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। অবৈধ দখলবাজি ও পাহাড় কাটার মত গুরুতর অসুখও বাসযোগ্য নগর গড়ার বড় বাধা। ভয়ঙ্কর ব্যাধিগুলো নিরাময়ের ব্যবস্থাও নেই। নেই নিবেদিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা সার্জন, সোজা বাংলায় দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নিজ আগ্রহে জলাবদ্ধতা রোগের স্থায়ী নির্মূলে সিডিএ কে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার বিশাল বরাদ্দ অনুমোদন দিয়েছেন প্রায় ৫ বছর আগে। চলছে বেশ কটি মহাপ্রকল্পের কাজ। প্রকল্পগুলো এরমাঝে মেয়াদোত্তীর্ণ। চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা, এক বছরের বাড়তি সময় নিয়ে। হয়নি, আবারও সময় এবং আরো ক’ হাজার কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। একই অবস্থা ওয়াসারও। চট্টগ্রাম ওয়াসা আসলেই অসম্পূর্ণ শব্দ। মহানগরের মাষ্টার প্ল্যানে স্যুয়ারেজ বা পয়ঃনিষ্কাশন সিষ্টেম থাকলেও বাস্তবে নেই। মানে ওয়াসার ‘এস’ নেই। বহু কোটি টাকা ব্যয়ে স্যূয়ারেজ প্রকল্প তিন বছর আগে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটাও বেখবর। নগরীর অবৈধ দখলে গায়ের ৪০টির বেশি খাল দখলমুক্ত হয়নি। চট্টগ্রামের প্রাণভোমরা কর্ণফুলী নদীকে নানা প্রকল্পের নামে সরু করে ফেলা হয়েছে। সবকিছুর দায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ঘাড়ে চাপালেও নাগরিক দায় এড়ানোরও সুযোগ নেই। ৭০ লাখ মানুষের মহানগর চট্টগ্রামের মানুষ আমরা নাগরিক হয়ে উঠিনি। বিশৃঙ্খল জন জঙ্গলের অংশমাত্র। সবসময় দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে অভ্যস্ত। নাগরিক সংলাপ, আলোচনা সেমিনার, মিডিয়ায় সুপরামর্শ দেই-পুরো শরীরে আবর্জনা মেখে। নাগরিক হলে নাগরিক দায় অবশ্যই পালন করতে হয়। নগরের পরিবেশ, সৌন্দর্য সুরক্ষায় সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হয়। কিছুই করিনা, লাভ-লোভে একচুলও ছাড় দেইনা। যদি নাগরিক হতাম, যে কোন মূল্যে পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্য বর্জন করতাম। গড়ে তুলতাম পরিবেশবান্ধব স্বাস্থ্যকর বাসোপযোগী নগর গড়ার বড় রোগ পলিথিন পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধে জনমত। দুর্ভাগ্য, এখন সব পণ্য এমন কী ঝালমুড়ি, বাদামের ঠোঙাও মুড়িয়ে দেয়া হয় পলিথিন ব্যাগে। মিনারেল ওয়াটার, কোমল পানীয়,জুস, চিপস, চকোলেটসহ সব দামি খাদ্য ও নিত্যপণ্য বিক্রি হয় প্লাস্টিক প্যাক, কন্টেনার বা বোতলে। দামি ওষুধ পর্যন্ত! প্লাস্টিকজাত মোড়ক বা বোতলগুলো কোনটাই ফুডগ্রেডও নয়। প্লাস্টিক এবং পলিথিন জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে। আবার যত্রতত্র পলিবর্জ্য ছুঁড়ে ফেলে পুরো নগর বসবাসের অনুপযোগী করে ফেলছি আমরা। বিপদাপন্ন করছি মানুষের জীবন। পলি ও প্লাস্টিক বর্জ্য বছর ধরে জমে নগরীর নালা, নর্দমা, খালে তৈরি হচ্ছে অসহনীয় জলাবদ্ধতা। বছরে শত শত কোটি টাকার প্রকল্প বর্জ্য অপসারণে নষ্ট হচ্ছে। একবার পরিস্কার হলে আবার দ্রুত জমে ভরাট হচ্ছে। এটা এমন এক অসুখ, যার কোন স্থায়ী চিকিৎসা হচ্ছেই না। টাকা বরাদ্দ হচ্ছে আর উড়ছে! নিত্য ভারী হচ্ছে কারো কারো অ্যাকাউন্ট। এ’ছাড়া টানা পাহাড় কাটার ক্ষত, খাল- নালায় বালি জমে উন্নয়নের গতিতে ব্রেক কষে দিচ্ছে।
দুরারোগ্য নিত্য ব্যাধিগুলো দূর করতে পারে কঠোর নাগরিক সচেতনতা। পৃথিবীর কোন সভ্য দেশের নগরে সড়ক, ওয়াকওয়ে বা ফুটপাতে থুতু, সিগারেটের টুকরো ফেললে মোটা জরিমানা গুণতে হয়। ব্যস্ত সড়কে অনাবশ্যক গাড়ির হর্ণ চাপলেও জরিমানা। এমন কী নাগরিকরা নিজেরাই অবাঞ্চিত বস্তু বা আবর্জনা রাস্তা- ফুটপাতে দেখলে পরিস্কার করে ফেলেন। নগর পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর রাখেন নিজের বাড়ির মতন। বিপরীতে আমরা কী করি? পরিবেশবাদীরা পরিবেশ ধ্বংস করি। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কর্তা মানবাধিকার হরণ করি। নারী অধিকার নেতা নারী নির্যাতনে এগিয়ে আছি। নিজেদের এত বৈপরীত্যের সুযোগ নিচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কিছু সর্বভুক রাঘব বোয়াল ও ক্ষমতাধর। তারা জানে, আমরা যতই হৈ চৈ করি, একটু হাড়গোড় ছুঁড়ে দিলে চুপসে যাব ফুটো বেলুনের মত। আসলে কঠোর কঠিন নাগরিক অঙ্গীকার ছাড়া কাউকেই জবাবদিহির আওতায় আনা যায়না, যাবেওনা। আমরাও আশা করতে পারিনা, সুন্দর বাসযোগ্য স্বাস্থ্যসমত নগর।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট