নূর বানু ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ২৪ এপ্রিল, ২০২১ at ১০:৫২ পূর্বাহ্ণ


ঝিনুক জোবায়দার ‘নুরবানু’ বইটি হাতে পেয়েছি বেশ কিছুদিন আগে। পড়ার সুযোগ হয়ে উঠেনি। কারণ বিবিধ। নারীর সাহিত্য চর্চা ও পড়াশুনার জন্য সংসার থেকে আলাদা সময় বের করে নিতে হয়। সংসারধর্ম বাদ দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন লেখার সুযোগটা পুরুষ লেখকেরা যেভাবে পান, নারী লেখকদের জন্য সেরকম হয়ে উঠে না, যেটাকে সরলভাষায় বলতে পারি সংসারের প্রতি তার নিজের দায়বদ্ধতা। আবার এভাবেও বলতে পারি সমাজের সাজানো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঘেরাটোপের কারণে। তাছাড়া প্রচলিত ধারণায় ‘নারীর বই ও নারী’ এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বের হয়ে আসার পথটাও সুপ্রশস্ত হয়নি এখনও। লেখালেখির ব্যাপারে লিঙ্গ সমতার ‘পাস’ পাওয়া গেছে এমন ভাবারও কোন কারণ নেই। অচলায়তন ভাঙ্গা সেলিনা হোসেন, রিজিয়া রহমান, রাবেয়া খাতুনসহ আরও যারা আছে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তাঁদের শুরুর পথটাও মসৃণ ছিল ইতিহাস কিন্তু তা বলে না।
বাংলাদেশ সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির হিসেব অনুযায়ী প্রতিবছর বাংলাদেশে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজারের মত বই প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে কেবল বইমেলার সময়ই প্রকাশিত হয় চার হাজার বই। বলা যায় বাংলাদেশের প্রকাশনা খাতটি মূলত বইমেলাকেন্দ্রিক। বইমেলায় ছাপা হওয়া বইয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ নারী লেখকের বই। সবাই কিন্তু প্রতিষ্ঠিত লেখক নন তাছাড়া নতুন লেখকও রয়েছেন। প্রকাশকদের মতে এই সময়ের নারী লেখকরা কম লিখছেন তাই তাদের বইয়ের সংখ্যাও কম। এই ব্যাপারে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের মতে, মেয়েরা যে কম লিখছে তার দায় তো মেয়েদের একার নয় এর সঙ্গে আছে পারিপার্শ্বিক অনেক কারণ। তাছাড়া রাষ্ট্রব্যবস্থা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাও রয়েছে। অনেক সময় তাদের আড়াল করেও রাখা হয়। নারীদের জন্য লেখালেখির ভাল পরিবেশেরও অভাব রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা প্রকাশকদের আগ্রহের অভাব, পারিবারিক ও সামাজিক অসহযোগিতা। বয়সে তরুণ লেখকদের মধ্যে অদিতি ফাল্গুনী মনে করেন, পারিবারিক বাধার পাশাপাশি আরও অনেক কারণ রয়েছে। তাছাড়া টিকে থাকাটাও এখানে বড় একটা চ্যালেঞ্জ।
আর আমি নিজে যেটা উপলব্ধি করি লেখালেখির জন্য অভিজ্ঞতা ও প্রচুর পড়াশুনার প্রয়োজন সেখানটায় নারীদের সুযোগ কম। তাই লেখার ক্ষেত্রে পুরুষের লেখার পার্থক্য আর বঞ্চনা বোধ থেকে নারীর লেখা পুরুষের থেকে আলাদা হয়ে উঠে।
আসলে লিখতে বসেছিলাম ঝিনুক জোবায়দার নুর বানু বইটি নিয়ে। এইবার বইমেলায় নন্দিতা প্রকাশ থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছে।
আটটি গল্প নিয়েই তার এই বইটি। প্রায় প্রতিটি গল্পেই উঠে এসেছে নারীর যাপিত জীবনের কষ্টের পদাবলী। জীবন বৈচিত্র্যময় হলেও নারীর কষ্টের জায়গাগুলো একইরকম। বঞ্চনাবোধ, প্রতারিত জীবন ও উপেক্ষিত হওয়ার ঘটনাগুলোই পুনরাবৃত্তি ঘটে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে। লেখক মুক্তোর মত করে কুড়িয়ে নিয়েছেন সেসকল। রেবু, মনুর মা, কাশেমের বৌ, রাজিয়া, নুরবানু, সবার জীবনের রং এক হয়ে মিশে আছে ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে নারীর যাপিত জীবনে। প্রচ্ছদ করেছেন নির্ঝর নৈ:শব্দ্য। প্রচ্ছদটি চমৎকার। নীল রঙের একটি বৃত্তের মধ্যে একজন দাপুটে পুরুষের অবয়ব। লেখক একজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সম্ভবত এটি তার প্রথম গল্পগ্রন্থ। বইটি পাদপ্রদীপের আলোয় আসুক। পৌঁছুক পাঠকের হাতে। পরিশেষে পাঠকের কাছে আবেদন থাকবে ‘নারীর রচিত লেখা ও নারী’ এই বিবেচনা বোধ থেকে বের হয়ে আসুন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রশ্নের গায়ে প্রশ্ন জমে থাকে
পরবর্তী নিবন্ধহতদরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান