প্রকৃতি সুন্দর। অনিন্দ্য, অনুপম, অতুলনীয় সে সৌন্দর্য। কখনো অবাক বিস্ময়ে ভরা এই সৌন্দর্য! কখনো ভয়ংকর এ–সৌন্দর্য! পৃথিবীতে এই জল,মাটি, প্রকৃতি নিয়ে এত অবারিত সুধা, এত এত সৌন্দর্য মানব জীবনে যার দর্শন কেবল নির্মলতা দেয়,সরলতা দেয়, বিচক্ষণতা দেয়।
সেন্টমার্টিন থেকে অদূরেই, সমুদ্রপথ পার হয়ে ভীষণ সুন্দর এক টুকরো সমতল। ছোটবেলায় পড়তাম পৃথিবীর মোট অংশের তিনভাগ জল একভাগ স্থল। কিন্তু সেই শৈশবের একমুঠো মগজে এই গোটা পৃথিবীর তিনভাগ জল কেমন আর একভাগ স্থল কেমন তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারতাম না। আট বছর বয়সে বাবার সাথে প্রথম যেবার কক্সবাজার গেলাম, সমুদ্র দেখে অবাক হলাম! ভাবলাম, ওমা! তিনভাগ জল, একভাগ স্থল তো নয়! এ তো পৃথিবীর অর্ধেক জল বাকি অর্ধেক স্থল!
তো আমাদের গন্তব্যে যাওয়ার সেই সমুদ্রপথে জল থৈ থৈ, অথই সমুদ্রের চারপাশে গভীর নীলে ভাসতে ভাসতে এই ধাড়ি বয়সেও মনে হচ্ছিল ওমা! এ তো পুরো পৃথিবীই জল! কোথাও একটি মাটির ঢেলাও তো নেই! এ কি রহস্য! কি আশ্চর্য রহস্য!
দুটো ছোট্ট সন্তান, রঙিন চশমা চোখে সামনে বসে থাকা প্রিয়, পাশে আমার বেঁচে থাকার ঈশ্বর, আমার মা। সব্বাই তো আমার ভীষণ প্রিয়। মুহূর্তে মনে পড়ে গেল কলিজা হিম করা এক গল্প!
ডার্লিং কিলিং
সেই গল্পে মাঝসমুদ্রে নৌকোকে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে, ব্যালেন্স করার জন্য একজন একজন করে প্রিয়জনকে বাদ দিতে হয়। বাছাই করতে হয়… সবচেয়ে প্রিয়জনকে! (অর্থাৎ যে নিজের সবচেয়ে প্রিয়) একজনকেই কেবল নৌকোটিতে রাখা যাবে! কি ভীষণ কঠিন এই সিদ্ধান্ত! কি নির্মম! কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। জব ট্রেনিংয়ের একটা পর্যায়ে এ–গল্পে নাটক করতে গিয়ে আমি কেঁদে কেটে একসার হয়েছিলাম।
তো সেই পুরো পৃথিবীভরা জলের নির্মম নীলে, স্পিডবোটে, ভেতর ভেতর আমার প্রাণ ক্রমশ জলশূন্য হয়ে যাচ্ছিল যেন।
সেই ভয়ংকর আতংক নিয়ে পৌঁছে গেলাম দ্বীপের কাছাকাছি। আবার বোট থেকে নৌকায় লাফাতে হল তপাকে বুকে নিয়ে। নৌকো নিয়ে গেল এক অদ্ভুত সুন্দর রাজ্যে!
এ যেন রূপকথা! এ যেন সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করার পর সেই তেপান্তরের মাঠ! এ যেন আমার সমস্ত বিস্ময় কাটানো সেই ছোটবেলার প্রশ্নের সমাধান! এ যেনো তিনভাগ জল কাটিয়ে, পৃথিবীর ম্যাপে শৈশবে বাবার দেখানো সেই রহস্যময় স্থল!
ছেঁড়াদ্বীপ
ঘন সবুজ কেয়াবনে ঘেরা বাগান বাড়ি।
কি অদ্ভুত এর প্রতিটি প্রবাল! পাথর তো নয় যেন শিল্পীর নিপুণ হাতে তৈরি কোনো সৌধ! যেন পাথরের ভেতরে খোদাই করা ঝিনুক শামুকের বাড়ি আর বাড়ির সামনেই তার অবারিত পুকুর! আরে না…সে তো দিঘী! আরে না না…তাও নয়…এতো পরম সৌভাগ্যবতী ঝিনুক শামুকের ঘরের আঙিনায় সাত সমুদ্দুর!
সমুদ্রের জলের গায়ে হাওয়ার নাচন ঢেউ! তাতে রোদ্দুরের এলিয়ে দেওয়া সোনারঙের চুল। মনে হয় যেন সোনার বিদ্যুতেরা খেলে যাচ্ছে জলের তালে–তালে! সমুদ্রের তলদেশও ভীষণ স্বচ্ছ। নামীদামী রিসোর্টের সুইমিং পুল যেন।
যেন রাজকন্যা সমুদ্রস্নান করবে বলে সমুদ্রের বুকও কংক্রিটে বাঁধিয়ে দিয়েছে কোনো রাজাধিরাজ!
সেই রোদ্দুরের সোনালু তরঙ্গের আলপনায় ভেসে আসতে থাকা আদর আদর ঢেউগুলো কি যে হিম বয়ে আনছিল! মনে হল যেন সে নিরস সন্ন্যাস জীবন ছেড়েছুঁড়ে হিমালয় থেকে ফিরছে তারা নিজের চিরচেনা বাড়িতে, নিশ্চিন্তে!
আমার ইচ্ছে হলো প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে, ভীষণ।
দুটো পায়ের পাতা সেই হিম জলে ভিজিয়ে দিয়ে আমি শামুক–ঝিনুকদের বাড়ির দাওয়ায় বসে রইলাম বেশকিছু সময় নীরবে। ক্রমশ সেই হিমকে আলিঙ্গন করার লোভ আনচান করে তুলছিল আমায়। বেশিক্ষণ আর তর সইল না। নেমে পড়লাম সেই নিবিড় বিশুদ্ধ হিমে!
আমায় দেখে এতক্ষণ ভয়ে ভয়ে নামতে না পারা আমার বড় কন্যাটিও ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছোট্টটি তীর থেকে শুধু দেখেই রইল। মায়ে–ঝিয়ে হারিয়ে গেলাম একেবারে। যেন দুজনই শিশু আমরা। কি সেই জলকেলি, হাত ধরে সুরে–সুরে নাচন এবং আলিঙ্গন।
দৈব হতে যেন সেই গান বেজে উঠল কোথাও…!
“আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে”
অুঃপর…ফেরা।
রূপকথার রাজ্যে থাকতে নেই। রাত নামতেই সেখানে রাক্ষস–খোক্কস আর নাম না জানা ডাইনিরা হানা দেয়।