সংসারে টানাপোড়েন লেগেই আছে ।
ভোরে বিছানা ছেড়েই শুনতে পেলো বউয়ের উচ্চকণ্ঠ, ‘উইঠ্যা পড়… ভাঁড়ে তেল–লবণ, আলু–পেঁয়াজের টান পড়ছে। সামান্য কটা চাইল–ডাইল আছে তা দিয়া একটু খিচুড়ি পাকায়য়া ছেলে দুইডারে টিফিনে দিমু। বউয়ের কথায় সুজন তেমন কিছু মনে করে না ! সেও জানে সেঁজুতি কিভাবে সংসার সামাল দেয়।
সুজন সদাগরি আপিসের কেরানি। মাস শেষে মাইনে সাকুল্যে যা পায় তাতে বাড়ি ভাড়া আর পোলা–পাইনের পড়ালেখার খরচ করে হাতে সামান্য কিছু থাকে। বউ–ছাওয়াল মিলে ওরা চারজনায় মফস্বল শহরের এঁদো গলিতে একটি কাঁচা ঘরে ভাড়া থাকে সুজন। ওর গ্রামের এক চিলতে ভিটেয় মাটির দেয়ালের বাড়ি। আশেপাশের ছোট্ট আঙিনায় শাল–পিয়ালের গাছ। সামনের উঠোনে আম–কাঁঠাল আর কলাগাছের ঝোঁপ। সুজনের ঘুম জড়ানো চোখে ভাসে গাঁয়ের সেই ভিটেবাড়ি আর বার্ধক্যের অচলায়তনে ঝুঁকে পড়া বাবা–মাকে ! অনেক দিন গাঁয়ের বাড়ি যেতে পারেনি সুজন। এবারের বাংলা নববর্ষে স্ত্রী–পুত্র নিয়ে ও দেশের বাড়ি যাবেই! গাঁয়ের সোঁদা মাটির গন্ধে ও যেন এখনই মাতাল হয়ে পড়েছে!
সদাগরি অফিসে কাজ শেষে সাঁঝবেলায় স্কুল স্তরের দু–তিনটি ছেলেমেয়ে পড়িয়ে সংসারের ঘাটতিটা পুষিয়ে নেয় সুজন । আজ আপিস যাওয়ার আগেই স্বামীকে এজন্য তাগাদা দেয়। সুজন আর দেরী করে না। বউয়ের হাতের চা–বিস্কুট খেয়ে থলে হাতে বেরিয়ে যায়। ওয়ার্ড অফিসের সামনেই সাশ্রয়ী মূল্যের চাল–ডাল–আটা– তেল সামগ্রীর ট্রাক এসে পৌঁছনোর আগেই লাইন হয়ে যায়।
সুজন সেখানটায় পৌঁছেই অসংখ্য মানুষের সারিতে দাঁড়িয়ে পড়ে। পুরুষ আর মহিলার দু‘টি ভিন্ন সারি। লাইনে দাঁড়ানো সবাই যে এই সাশ্রয়ী মূল্যের পণ্য পাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবুও সবাই আশায় বসতি বাঁধে!
ট্রাকের পেছন দিকে হিসাবরক্ষক বসে একেএকে ভোক্তাদের কাছ হতে টাকা বুঝে নিলে পরিবেশক ছেলেটি পণ্য বুঝিয়ে
দেয়। চৈত্রের তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে সুজন এদিক–ওদিক তাকায়। সেখানে নিম্নবিত্ত–মধ্যবিত্ত অনেক চেনা মানুষ দেখতে পায়।
বাড়িতে সেঁজুতি ছেলেদের পড়ালেখার খাতাগুলো দেখে নেয়, বাড়িতে স্কুলের পড়ালেখা ঠিকভাবে হলো কিনা। তারপর ওদের টিফিন বক্সে সামান্য খিচুড়ি আর আলুভর্তা দিয়ে স্কুলে রওনা করায়।
ছেলে দুটি বেরিয়ে যাওয়ার পরেই সেঁজুতির মনে হয় স্বামীর কথা। এখনও ফিরলোনা তো! মোবাইলে যোগাযোগ হলে সুজন জানায়, ‘এহনো আমি লাইনের মাঝামাঝি আছি। জানা নাই সদাই–পাতি পামু কি–না। মানুষের দীর্ঘ লাইন। উত্তাপে মাথা ঘোরতাছে। ’
এপ্রান্তে সেঁজুতি বলে, ‘আর দরকার নাই। তুমি বাসায় আইস্যা পড় !’ এরপরই সেঁজুতি ভাবতে থাকে । কতোদিন বাবা–মা, শ্বশুর–শাশুড়ির সাথে দেখা হয়নি। বছরতো ঘুরে এলো প্রায়। আগামী চৈত্র সংক্রান্তি ছুটি হলে ওরা সবাই বর্ষ বিদায় আর বর্ষবরণ করতে এবার গ্রামে যাবে। মধুমতী খালের ধারেই ওদের গ্রাম বাবুইপাড়া।
এতোসব ভাবতে ভাবতে সেঁজুতি একটু ঝিমিয়ে পড়ে। কিন্তু ঝিমনোটা গভীর হবার আগেই বাড়ির সামনেই কিছু শোরগোল শোনা যায় যেন। সেঁজুতি এসব কিছু আমলেই নিল না।
লোকজনের হৈ–হল্লা ক্রমশ সেঁজুতির বাড়ির সামনেই বৈশাখী প্রচন্ড ঝড়ের মতোই আঘাত হানলো যেন। ঝিমনো ভাবটা
কাটিয়ে উঠতেই সেঁজুতি অনেকটা ঝাঁপিয়ে এসে সামনের উঠোনে এসে দেখে….সুজন অচেতন অবস্থায়।
সেঁজুতির যেন মাথা ঘোরে । ও উপস্থিত সবার কাছে জানতে চায়, সুজন এমন কাতর হলো কেন ?
ভীড়ের মাঝে একজন সেঁজুতির কাছে এগিয়ে আসে। বলে, ‘উনি দীর্ঘ সময় রৌদ্রতাপে দাঁড়িয়ে থেকে ঠিক যখন ট্রাকের পেছনে বসা ব্যক্তিটির হাতে পণ্যের টাকা দিয়ে সব পণ্যগুলো বুঝে নিয়ে বাসায় ফেরার জন্য একটা রিকশার খোঁজ করছিলেন তখনই উনি রাস্তায় শুয়ে পড়লেন। অচেতন অবস্থায় আমরা কজন ওনার কেনা পণ্যসহ নিয়ে এসেছি। ”
সেঁজুতি যেন চারপাশে অন্ধকার দেখলো। কয়েকজন প্রতিবেশীর সাহায্যে সুজনকে ততক্ষণে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করানো হলো। কর্তব্যরত ডাক্তার প্রাথমিক চেক্আপ করে রোগীর উচ্চ রক্তচাপ পেলেন। তাৎক্ষণিক কিছু টেস্টের নির্দেশ দিলেন। সুজন–সেঁজুতির দুই পুত্র বাড়ি ফিরে এসব শুনে কান্না শুরু করলো।
সন্ধ্যায় বড়ো ডাক্তার রিপোর্ট দেখে রোগীকে কয়েক দিন হাসপাতালে থাকতে হবে বললেন। নির্দেশ অমান্য করলে বিপদ আরো গভীর হতে পারে।
সুজনের অচেতন অবস্থা কেটে গেছে। ও বুঝতে পারেনা কি হতে কী হয়ে গেল!
এভাবেই ক‘দিন পরে সুজন কিছু সুস্থ হয়। ওর কেবলই মনে হচ্ছিল ও বুঝি নতুন জীবন পেয়েছে । ডাক্তার সাহেব বলেছেন, সামনের দিনে আরো দীর্ঘ জীবন এই ভুবনের আলো–হাওয়া উপভোগ করুন।
সেঁজুতি বিপদ কাটিয়ে ওঠার জন্যে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানায়।
ওই দুর্ঘটনার পর দশদিন কেটে গেছে। সকালে ওদের ছেলে দুটি খুশির মেজাজ নিয়ে স্কুলে গেছে। ওদের চারজনার পরিবার এখন দুশ্চিন্তামুক্ত।
সুজন ঘরেই বিশ্রামে আছে। ওর মনে হলো আজই ও সেঁজুতিকে বলবে, ওরা আগামী নববর্ষ ওদের গাঁয়ের বাড়ি যাবে
এবং সেখানেই কয়েক দিন থাকবে।
আর সেঁজুতি পাকের ঘরে রান্না সেরে সুজনের কাছে আসলো। সুজন তখনো বসে, বাবুইপাড়া গ্রামের মধুর স্মৃতি রোমন্থন করছিলো। ঘরে ঢোকার আলতো শব্দ পেয়ে সুজন, সেঁজুতির মুখপানে তাকালো। সুজনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সেঁজুতি বললো, “ হুইন্যা রাইখো, আগামী নববর্ষ আমরা হক্কলে মধুমতী খালের ধারে বাবুইপাড়া যাইয়্যা থাকুম্।”
সুজন অবাক হয়ে বলে, “আমিও তা–ই ভাবতেছি ! ”