অফিসে কাজের ফাঁকেই জেনে নিলো তরুলতা পাশে বসা সহকর্মী পলির কাছ থেকে কিভাবে বানিয়েছেন চপ আর কাটলেটটা? খুব মজা হয়েছিলো। পলি বলে,আপা আমি রেসিপি বলছি আপনি শুনেন। তরুলতা মন দিয়ে শুনে ঠিক করে নিলো ইফতারির জন্য এই কাটলেট বানাবে। সবাই খেতে পছন্দ করবে।
আবার কাজে মন দেয়। কাজের ফাঁকে–ফাঁকে চলে সংসারের টুকিটাকি কথা আর চলে এই রোজাতে স্বামী কি খেতে পছন্দ করে, শ্বশুর–শাশুড়ি কি ভালোবাসে খেতে, বাচ্চাটা কি পছন্দ করে এসব কথাবার্তা।
আসলে মেয়েদের সবদিকে নজর দিতে হয়। আর রোজা রেখে সবাই একটু ভাল খাবার খেতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। তরুলতা এত গোছানো ছিলো না। সংসার করতে করতে এখন অনেক গোছানো হয়েছে।
পিয়ন: আপা আপনাকে বস ডাকছে এক্ষুণি।
কেন? জানতে চাইলো তরুলতা পিয়ন থেকে।
পিয়ন: জানি না আপা,তবে তাড়াতাড়ি যেতে বলেছেন।
তাড়াতাড়ি টেবিলের কাগজপত্র গুছিয়ে বসের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো।
তরুলতা: স্যার আসবো?
বস: আসুন, এই ফাইলটা আপনি চেক করেছেন?
তরুলতা : ফাইলটা হাতে নিয়ে দেখে বললো জ্বি স্যার।
বস : এখানে দেখুন তো সব ঠিক আছে কিনা? অনেকগুলো লেখা ঠিক হয়নি এক্ষুনি ঠিক করে আবার নতুন করে প্রিন্ট আনুন।
তরুলতা: ওকে স্যার।
তাড়াতাড়ি ফাইলটা নিয়ে এসে দেখতে বসলো ভুলগুলো কোথায় কোথায় হয়েছে?
হ্যাঁ, বেশকিছু ভুল রয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ঠিক করে নিলো।
সবকাজ শেষ করতে আজকে একটু দেরিই হলো। এখন গাড়ি পাওয়া খুব মুশকিল হবে। অনেক ভিড় হবে বাসে। তবু ঠেলে উঠে যখন বাসায় পৌঁছাল তখনই শাশুড়ি বলে উঠলো এত দেরি হলো আজ? কাজের চাপ বেশি ছিলো?
হ্যাঁ মা। তার ওপর গাড়িতে উঠা খুব কষ্টের, অনেক ভিড় থাকে এই সময়ে।
শাশুড়ি বললো, তুমি আস্তেধীরে হাতমুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম করে এসো আমি কিছু ইফতার রেডি করেছি আর বাকি কিছু লাগলে তুমি করে নিও।
তরুলতার খুব ভালো লাগে তার শাশুড়িকে। তিনি সহনশীল মানুষ। অনেক সাহায্য করেন সংসারে। আবার কোনো কিছুতে প্রেসার দেন না। নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করেন।
তরুলতার মাঝে মাঝে স্বামীর সাথে ঝগড়া হয়। তখন শাশুড়ি তরুলতার হয়ে ছেলেকেই বকা দেন। বলেন,বউমা কত কষ্ট করে সারাদিন। ওকে সাহায্য করবি কোনো বকাবকি বা দোষ ধরবি না।তরুলতাকে খুব ভালোবাসে ও সম্মান করে কথা বলে শ্বশুর–শাশুড়ি। শ্বশুর তো বলেন ঘরের বউমার মন যদি ভালো থাকে তাহলে সবকিছুই ভালো থাকবে।
তরুলতা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে গেলো। গিয়ে দেখে সব রেডি। অনেক খাবার বানিয়ে রেখেছে শাশুড়ি। তবু কাটলেট বানানোর প্রস্ততি নিলো ও মনে করে যত্ন সহকারে কাটলেট বানিয়ে টেবিলে এনে রাখলো।
স্বামী অনি ফিরে এসেছে চাকরি থেকে। ফিরে সেও ফ্রেশ হয়ে টেবিলে খাবার সাজাতে সাহায্য করলো।
কাটলেট দেখে বললো এতকিছু করার কি দরকার ছিলো?
ইফতারে বসে আযানের সাথে সাথে সবাই খাওয়া শুরু করলো। তরুলতা সবাইকে খেতে দিয়ে সে নিজেও খেতে বসলো, নতুন রেসিপি, তাড়াহুড়ার কারণে ভালো হয়নি। স্বামী অনি মুখে কাটলেট নিয়েই খুব বাজেভাবে বললো ‘এসব কি বানিয়েছো? শুধু শুধু কতগুলো জিনিসপত্র নষ্ট হলো। এগুলো খাবারের যোগ্য হয়েছে? ওয়াক থু…!’
তরুলতার খুব খারাপ লাগলো এত বাজেভাবে অনি কথাগুলো বলার জন্য। চোখে কেমন জল চলে এলো। তবু কষ্ট করে বললো আমি প্রথম বানিয়েছি, আর আজই রেসিপি জেনে এসেছিলাম ভুল তো হতেই পারে।
তরুলতার শাশুড়ি বুঝতে পেরে তিনি বললেন, শোন অনি ভালো না লাগলে খেতে হবে না। কিন্তু তাই বলে কাউকে এভাবে বলে? আমি তো খাচ্ছি, তিনি একটা কাটলেট মুখে নিয়ে বললেন কই তেমন খারাপ তো হয়নি। তুই বেশি কথা বলিস। মেয়েটা কত কষ্ট করে চাকরি করে এসে এত পরিশ্রান্ত থাকার পরও রান্না করলো।
তুই তো শুধু খাবারের স্বাদ দেখছিস, কিন্তু খেয়াল করে দেখতো এই খাবার বানানোর পেছনে কত ভালোবাসা জড়িয়ে আছে আমাদের প্রতি? তুইই তো চাকরি করে এসেছিস, তোর কি ইচ্ছে হয়েছে কোনো খাবার বানাতে?
সকলকে খুশি করার জন্য, সকলকে ভালো রাখার জন্য, সকলকে মজার খাবার মুখে তুলে দেয়ার জন্য মেয়েদের যে পরিশ্রম করতে হয় তার প্রশংসা করবি সবসময়। কখনো কোনো কিছুকে ছোট করে দেখবি না। তুই নিজে সম্মান দিবি তোর সন্তানের মা–কে তবেই তো তোর ছেলেও মাকে সম্মান দিতে শিখবে ।
সবাই চুপচাপ ইফতার শেষ করলেন আর কোনো কথা হলো না। তরুলতার মন ভরে গেলো শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে। মনে মনে ভাবতে লাগলো সব ঘরে ঘরে যদি এরকম শাশুড়ি থাকতো তাহলে সুন্দর সমাজ গড়ে উঠতো।
রাতে রান্না করতে করতে শাশুড়ি তরুলতাকে বললো, শোন বৌমা কারো কথায় কান্না করবে না, ভেঙে পড়বে না, মনে রাখবে মেয়েদের নিজেকে নিজেই সম্মান দিতে হয় ও নিজেকে সম্মান করতে হয়। তুমি যখন তোমাকে সম্মানিত করবে তখন কেউ তোমাকে অপমান করলেও তোমার সম্মান তোমার কাছে ঠিকই অক্ষুণ্ন থাকবে।
একজন নারীর পাশে যদি এরকম একজন প্রেরণার কেউ থাকে তবে সফলতার চূড়ায় অবস্থান করতে পারবে সকল নারী। সম্মান সত্যিই নিজেকে নিজেই দিতে হয়, তবেই সম্মানিত থাকবে সকল নারী।
মিতা দাশ, সিনিয়র শিক্ষক, বি এ এফ শাহীন কলেজ চট্টগ্রাম।