নারী দিবসের প্রথম প্রহরে সফল নারীদের জীবনগাঁথায় ভরা খবরের কাগজ । প্রথম পাতায় রাজনীতির প্যাঁকে পড়ে মাত্র বিশ বছর বয়সে ছাত্রনেতা বনে যাওয়া যুবক পুত্রের মৃত্যুতে এক প্রান্তিক মায়ের আহাজারির ছবিটা তাই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়।
ঐতিহাসিক আট মার্চের আগের দিন, ৭ মার্চ ২০২১। ভাড়া দিতে না পারায় বাক প্রতিবন্ধী নারীকে বাস থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয় কেরানিগঞ্জের সড়কে। তাঁর আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস কেঁপে ওঠে। ঝকঝকে বাসটি চোখের নিমিষেই মিলিয়ে যায় পর্দার অন্তরালে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবশ্য চালক ও তার সহকারীকে দ্রুতই গ্রেপ্তার করে ফেলেছে।
নরসিংদীতে পাওনা আদায়ের দাবিতে অবস্থান ধর্মঘট করছে পাটকল শ্রমিকরা। নারীরা আছেন এখানেও, শেষ ফাল্গুনের তপ্ত দুপুরে।
গাজীপুরে বিশ বছর বয়সী পোশাক কর্মী রেহেনাকে মেরে মাছ মাংস কাটার বটি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে রেখে সকালবেলায় ভাল মানুষের মতো কাজে যায় পঁচিশ বছর বয়সী স্বামী জুয়েল আহমেদ। এক বছরের বিবাহিত জীবনে এতোটা নৃশংসতা কি করে অর্জন করে যুবক জুয়েল!
কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার পালপাড়া’র দুই সন্তানের মা রোকসানার রক্তাক্ত মৃতদেহ ঘরের ভেতর, স্বামী পলাতক। এটা মার্চের বার তারিখের খবর। একই দিনে হবিগঞ্জ থেকে খবরে আসে বিক্রির জন্য গয়না দিতে রাজি না হওয়ায় স্ত্রীর কবজি কেটে দেয় স্বামী। হবিগঞ্জের মাধবপুর থেকে এই দিনের আরও খবর- কুকুরের মুখে দুর্গন্ধযুক্ত মাংসের টুকরো দেখে উৎসের সন্ধান করতে গিয়ে ছেঁড়া বস্তায় তরুণীর টুকরো টুকরো মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়।
শিউরে ওঠার মতো খবরগুলো তরতাজা, একটুও বাসি হয়নি। আর তাই অতি সমপ্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তা রচনা করার আগে উপরিউক্ত তথ্যউপাত্ত সংযুক্ত হওয়ার কথা নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষার ফলাফল বলছে স্ত্রী নির্যাতনে আমাদের বাংলাদেশ চতুর্থ স্থান অধিকার করেছে (দৈনিক প্রথম আলো, ১১/৩/২০২১)। এই প্রতিবেদন তৈরির সময় এবারের নারী দিবসের অব্যবহিত আগে পরের তথ্যগুলো সন্নেবেশিত করা গেলে বোধ করি প্রথম স্থানটা আমরা পেয়েই যেতাম। অতশত না ভেবে বরং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় স্ত্রী নির্যাতনে শীর্ষস্থান অধিকারকারী দেশগুলোর দিকে তাকানো যাক।
তালিকায় দেখা যাচ্ছে চতুর্থ হলেও প্রকৃতপক্ষে প্রথম থেকে তৃতীয় স্থান অধিকারীর সঙ্গে নম্বরের ব্যবধান সামান্যই। বলে গেলে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা!। কিরিবিতি, ফিজি, পাপুয়া নিউগিনি- প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের এই দ্বীপগুলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর হলেও উন্নয়ন ও আধুনিকতায় আমাদের বাংলাদেশের ধারেকাছে নেই কেউ। তালিকায় বাংলাদেশের আগে ও পরে যে দেশগুলোর নাম আছে তারা সবাই পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশ। উপরন্ত সার্বভৌম নয় কোন জাতিগোষ্ঠী। আফ্রিকা মহাদেশের চরম অনুন্নত দেশ সুদান, সোমালিয়া, নাইজেরিয়ার অবস্থানও আমাদের পরে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান আছে তালিকার ষষ্ঠস্থানে, পাকিস্তান আরও পরে। সিরিয়ার অবস্থান কততম জানা হয়নি।
নারীদিবস উদযাপন শুরুর ঠিক তিনদিনের মাথায় প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই প্রতিবেদন দেখে আমাদের উৎসব আয়োজনে ভাটা পড়ে যাবে মনে করার কোন কারণ নেই। বেগুনি রঙের পোশাক আর অলংকারে ঠাঁসা বিপণী বিতানের তাকগুলো খালি করে দিতে না পারলে নিজেকে সফল নারী দাবী করি কেমন করে! বড় কিছু উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আসনে সমাসীন নারীদের দেখে আত্মতৃপ্তিতে ভোগা নারী সমাজ আনন্দ উৎসবে মেতে না উঠলে সব আয়োজন যে মাঠে মারা যাবে। ক্লারা জেটকিন হয়তো আমাদের অভিশাপই দেবেন। আর তাই মহাসমারোহে রঙিন সাজ পোশাক নিয়ে নারীমুক্তির জয়গান গেয়ে যাওয়া নারীদের ভাবনার জগতে খুব একটা প্রভাব বিস্তার করেনা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই প্রতিবেদন।
মজার ব্যাপার, সবকিছু ছাপিয়ে মেগান মার্কেলের দুঃখই আমাদেরকে বেশী স্পর্শ করেছে। আমাদের কাগজেও যথারীতি মেগান হ্যারি’র গল্প ও বহুমূল্যের সাক্ষাৎকার ও তা নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনাই বেশী প্রাধান্য পেয়েছে। অনেকটা এই কারণেই যে আমাদের এসব সমস্যাতো ইহকালে মিটবে না। তাই এসব নিয়ে অযথা ভেবে মরে কাজ নেই।
বেগম রোকেয়া চোখ বুজেছেন নয় দশক হতে চলল। তাঁর দর্শন, তাঁর স্বপ্নের কিছুমাত্র অর্জিত হয়নি তা বলা যাবে না। তবে উচ্চপদে সমাসীন কোন নারী যখন নিজের যোগ্যতা নয়, বরং সরকারী অনুগ্রহই তাঁকে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে বলে অকপটে স্বীকার করে নেন, তখন তথাকথিত নারীর ক্ষমতায়ন একটা প্রহসনের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়।
নারীদিবসের বিশেষ ক্রোড়পত্রে শিক্ষা, বিনোদন, ব্যবসায়সহ নানা অঙ্গনে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখা নারীদের যুদ্ধজয়ের গল্প প্রকাশিত হয়েছে রঙবেরঙের ছবিসহ। সন্দেহ নেই আগামীদিনের নারীদের অনুপ্রাণিত করবে এই গল্পগুলো। তবে সমাজের উঁচুতলার চেয়ে নিচুতলার নারীদের হার না মানা গল্পগুলোই প্রণোদনা যোগাতে পারে পিছিয়ে পড়া মেয়েদের, যদিও রোকেয়ার নাম হয়তো কোনদিন তাঁরা শোনেননাই।
করোনাকালে ভোলার মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ হলে জেলে পরিবারগুলোর না খেয়ে মরার অবস্থায় পড়ে যায়। এমন দুঃসময়ে সংসারের হাল ধরেন নারীরা। ঘর গৃহস্থালি সামাল দেওয়ার পাশাপাশি হাঁস-মুরগি, ছাগল পালন করে পরিবারের অন্ন সংস্থান করে চলেছেন সেইসব হার না মানা নারীগণ।
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বড়হড় গ্রামের বিমলা রানীর রেশম গুটি চাষ করে ভাগ্য বদলের কথা জানাতে হবে আমাদের মেয়েদেরকে। হাসিতে তাঁর আত্মপ্রত্যয়।
পিরোজপুর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের স্নাতক (সম্মান) চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী চন্দ্রিকা মণ্ডল করোনাকালে বিকল্প কাজ খুঁজে নিয়েছেন। টিউশনি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় মেয়েদের স্কুটি চালানো শেখাতে শুরু করেন। এই বিদ্যা জানা মেয়েদের জন্য কত জরুরী দুঃসময় এলেই তা উপলব্ধি করা যায়। স্কুটি হতে পারে একটা মেয়ের আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার অস্ত্র নয়।
ঠাকুরগাঁও শহরের নিশ্চিন্তপুরে পনির উৎপাদন করে নিজের অভাব দূর করার পাশাপাশি অন্য অনেক মেয়ের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন গৃহবধূ মাসুমা খানম। জেলার ‘শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা’ র স্বীকৃতি লাভ অনুপ্রাণিত করবে হাজার মেয়েকে।
রাজবাড়ী শহরের বড়পুল এলাকায় ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে সাইকেল নিয়ে খবরের কাগজ সরবরাহ করে বিলি করতে নেমে যান ঝুমুর দাস। তাঁর আয়েই চলে পুরো পরিবারের ভরনপোষণ।
করোনার প্রকোপ, আম্পানের ছোবল দমিয়ে রাখতে পারেনি যশোরের ঝিকরগাছার গদখালীর ফুলচাষী সাজেদাকে। স্বামীর সহযোগিতায় আরও কিছু কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে ঝলমল করছে তাঁর ব্যবসা।
কুমিল্লা শহরের নজরুল এভিনিউতে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হাসিমুখের নাজমা একজন স্বপ্নচারী। স্বামীর সহযোগিতায় তিনিও এগিয়ে চলেছেন গুটি গুটি পায়ে।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বড় বাইশদিয়া ইউনিয়নের দাড়ছিড়া নদীর তীরে খোলা আকাশের নিচে চিংড়ি মাছের মাথা ফেলে দেওয়ার কাজ করছেন নারী শ্রমিকেরা। শোভা রানীরা পুরুষদের চেয়ে বেশী শ্রম দিয়েও কম মজুরী নিয়ে ঘরে ফেরেন। কাজের ফাঁকে নদীর পাড়েই তোলা ছবি দেখে অসহায় মনে হয়না শোভা রানীকে। শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত নারীদের শোভা রানী মনে করিয়ে দেন— আমি কারও ধার ধারি না।
এরাই জীবনে রঙ ছড়ায়, আলোকিত করে সমাজকে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবী কিছুই দেয় না ওদের। নিরাপত্তাটুকুও না। তবু কোন অভিযোগ না করে ওরা কাজ করে যায় দিন বদলাতে। তাই উৎসবের মঞ্চে রঙ মাখানো রূপসীরা নয়, সফল নারী এরাই— বিমলা, চন্দ্রিকা, মাসুমা, ঝুমুর সাজেদা, নাজমা, শোভা রানীরা। সমতার লড়াই-এ নেমে কিছু নারী কিংবা অনেক নারী ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে গেলেই কি মোক্ষলাভ নিশ্চিত? ঘরে বাইরে সকল নারীর সম্মান ও স্বীকৃতিই কি প্রধান বিষয় নয়?