নারী দিবস- একান্ত ভাবনায়

করবী চৌধুরী | মঙ্গলবার , ৮ মার্চ, ২০২২ at ৭:৫৫ পূর্বাহ্ণ

৮ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারীদিবস’। প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও আমাদের দেশে এই দিনে প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ বিভিন্নস্থানে সভা- সেমিনারে শোরগোল তুলে নারীসমাজের বিবিধ বঞ্চনা আর উন্নয়নের খতিয়ান তুলে ধরবেন সমাজের কিছু প্রতিষ্ঠিত নারীপুরুষ। কিন্তু সবকিছুই ঐ একদিনের জন্যই। ৯ মার্চের রাত পোহালেই আবার যে কে সেই!
ঘরে- বাইরে সর্বত্র ‘ছেলেরা যা পারে তোমরা মেয়েদের তা পারতে নেই, তোমাদের এই করতে নেই, ওই করতে নেই’… এসবের বেড়াজালে পিষ্ট যে নারীজীবন, চলনেবলনে যে প্রতিবন্ধকতা তার থেকে কি এতটুকু মুক্তি দিতে পারে এই নারীদিবস? উত্তর একটাই। ‘ না’ এবং ‘না’। প্রেমরসে হাবুডুবু খেলেন দুজনেই, কিন্তু ‘কলঙ্কিনী’ হলেন রাধা! অথবা পৌরাণিক মতে, রামচন্দ্রকে বনবাসে একা যেতে না দিয়ে পতিপ্রেমের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে সহগামিনী হলেন সীতাদেবী। এমনকি নিরপরাধ সীতাকে অপহরণ করলো রাবণ কিন্তু, রামের নির্দেশে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হলো সেই নিরপরাধ সীতাকেই! সেই মুহূর্তে কোথাও কি চরমভাবে অপমানিত হলোনা সীতার চরম আত্মত্যাগ? তাঁর প্রগাঢ় পতিপ্রেমকে ছাপিয়ে প্রকট হয়ে উঠলো শুধু কল্পিত কলংকটুকুই?
কৌরব রাজসভায় পাশাখেলায় হেরে গিয়ে পাণ্ডবেরা বাজি রাখলেন নিজেদের স্ত্রী দ্রৌপদীকে!এতেও কি নারীত্বের অপদস্ততার শেষ হলো? হয়নি মোটেও। আবারও বাজিতে হেরে গিয়ে ভরাসভায় স্ত্রীর বস্ত্রহরণের মতো নারীত্বের চরম লাঞ্চনা মাথানত করে আপন সহ্য করলেন কাপুরষ পাণ্ডবরা! অর্থাৎ কোনো ঘটনার পেছনে কার্যকারণ যাই থাকুক না কেন, বিনাদোষে বারবার দোষী হতে হয়েছে কিন্তু কোনো না কোনো নারীকেই! পৌরাণিক যুগের হলেও উদাহরণগুলো আজকের দিনেও হয়তো খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক নয়। নারীত্বের অবমাননা প্রতিনিয়ত হয়েই চলেছে সমাজে। হয়তো অন্যরূপে, অন্যভাবে। স্বামিহীনা কোনো নারীর যদি আয়নার সামনে নিজের বিবর্ণ রূপটা দেখে নিজেকে আবার একটু রঙিন করে সাজিয়ে নিতে ইচ্ছে হয়, আর তিনি যদি ভুলক্রমেও কোনোভাবে নিজের সেই ইচ্ছেটার মর্যাদা দিয়ে ফেলেন তাহলে সমাজের চোখে কিন্তু আর রক্ষা নেই! শুরু হয়ে যাবে তাকে নিয়ে ফিসফাস! ‘বিধবার আবার যে রঙের সখ জাগলো’! কোথাও কিছু করছে নিশ্চয়ই’! ‘চরিত্র ঠিক আছে তো’? ইত্যাদি ইত্যাদি নানারকমের কুৎসা রটে যাবে চারদিকে। অথচ আশ্চর্য কী দেখুন, যে পুরুষটি অল্পবয়সে বিপত্নীক হন, তাঁর জন্য কিন্তু নিয়মের কোনো বেড়াজাল চোখে পড়ে না কোথাও! না থাকে পোশাক-আশাকের উপর কোনো নিষেধাজ্ঞা, না কোনো সামাজিক কোনো আচার- বিচারের বালাই! যত নিয়ম শুধু মেয়েদের বেলাতেই। সমাজের জঞ্জালও যেন তারা, আবার সমাজের যত নিয়মকানুনের রক্ষাকারীও সেই তারাই!
একইভাবে কোনো মহিলা যদি কাজের জায়গায় আপনযোগ্যতা বলে একটু বেশি উন্নতি করে ফেলেন, তখন সাথেসাথেই শুরু হয়ে যায় তির্যক সব মন্তব্য! ‘রূপ আর গ্ল্যামারের জোরে বসের মন ভুলিয়ে প্রমোশন পেয়ে যাচ্ছে বারেবারে’!
অন্যদিকে একজন পুরুষের ক্ষেত্রে চাকরিতে উন্নতি করাটা সবসময় তাঁর যোগ্যতারই পরিচায়ক। গল্পচ্ছলে আরেকটা উদাহরণ দেই। মনে করুন জনৈক পিতা তাঁর শিক্ষা-দীক্ষায় শ্রেষ্ঠ মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজছেন, কিন্তু পাবেন কোত্থেকে? মেয়ে যে কৃষ্ণকলি! কোনো সহৃদয় ব্যক্তি যদি বা বলে বসেন, ‘বাহ! মেয়ে তো সর্বগুণেগুণান্বিতা’! তখন সাথে সাথে পালটা উত্তর আসবে, ‘সে যতই শিক্ষিতা, চাকরিজীবী হোক গায়ের রঙটা যে একেবারে ঘোর অমাবস্যার মতন! আমাদের ফর্সা বৌ-ই চাই’। ছেলেদের ক্ষেত্রে কিন্তু গায়ের রঙ কৃষ্ণবর্ণ হলে সে ‘টল, ডার্ক এন্ড হ্যান্ডসাম বলেই প্রশংসিত হয়। আর হ্যান্ডসাম না হলেই বা কি এসে যায়? সোনার আংটি আবার বাঁকা’! দেখুন, কতটা বৈষম্য সবখানে! কোনো বিবাহিত দম্পতির সন্তান না হলে অভিযোগের তীরটা কিন্তু সর্বদা তাক করা থাকে মেয়েটার দিকেই! এমনকি কোনো মেয়েকে চোখের সামনে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে দেখলেও কিছু মানুষ শ্লেষাত্মক মন্তব্য করতে ছাড়ে না! ‘দেখেন গিয়ে আবার, মেয়েটার নিজেরই কোনো চরিত্রের দোষ ছিল কিনা! ছেলেটার সাথে আগে কোনো সম্পর্কের গণ্ডগোল ছিল কিনা! তার উপর মেয়েটার পোশাক-আশাক কী রকম ছিল কে জানে? আজকালকার মেয়েরা যেসব উলটোপাল্টা পোশাক পরে! ছেলেদের আর কী দোষ বলেন’! নারী নির্যাতনের এরকম হাজারো উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমাদের চোখের সামনেই। খুবই দুঃখজনক হলেও স্বীকার করতেই হবে যে, অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের নিয়ে এসব কটুক্তিগুলো করে কিন্তু মেয়েরাই! ‘মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু’,এই আপ্তবাক্যটি সত্যি বলে প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর যেন তারা! অথচ একজন নারীই কিন্তু চাইলে সব থেকে ভালো বুঝতে পারেন আরেকজন নারীর কষ্ট, যন্ত্রণা, হতাশা আর অপ্রাপ্তিগুলোকে।
আসলে আমার মনে হয়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের সমাজ এখনো মেয়েদেরকে জনমদুখিনী রূপে দেখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। যতক্ষণ কোনো নারী লাঞ্ছিত, অবহেলিত, আর উপেক্ষিত ততক্ষণ তার প্রতি সমবেদনা জানিয়ে ‘আহারে বেচারি’ বলার প্রচুর লোক পাওয়া যায়। কিন্তু যখনই সে নিজের শক্তিতে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচার চেষ্টা করবে, অন্যকারো সাহায্য ছাড়াই ভালো থাকার চেষ্টা করবে, ঠিক তখনই তার দিকে সমবেদনার দৃষ্টিতে তাকানো আগের সেই চোখগুলো বদলে যাবে মুহূর্তেই! না, না, ভুলেও ভাববেন না যে, সেই দৃষ্টি কোনোরকম শ্রদ্ধা বা সম্মানের হবে, বরং মনের ঈর্ষা, বাক্যে বা আচরণে প্রতিফলিত হয়ে প্রতিমুহূর্তে চূর্ণ -বিচূর্ণ করার চেষ্টা করবে তাকে! নারী হয়ে অপর এক নারীকে সম্মান করতে না পারার অক্ষমতাটুকু ছাড়াও আরও একটা দুর্বলতা রয়ে গেছে নারীদের মধ্যে। আমরা নারীরা নিজেদেরকেই সঠিকভাবে সম্মান করতে শিখিনি আজও। তাই উদয়াস্ত পরিশ্রম করে সংসারটাকে নিখুঁতভাবে চালিয়ে নিয়ে যাবার পরেও বেশিরভাগ গৃহবধূ সারাজীবন অজ্ঞতার খোঁটা শুনেও মাথা নিচু করে থাকে। খেতে বসার সময় পরিবারের সবাইকে সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিবেশন করে খাইয়ে নিজে কোনো রকমে সেই এঁটোকাঁটার মধ্যেই দু’ মুঠো মুখে গুঁজে দিয়েই আজো অনেক মেয়েকে পরিতৃপ্ত হতে দেখা যায়। সবারটা খাওয়া হলেও তাদেরটা হয় গলাধঃকরণ। পরিবারের সদস্যগুলোও খুব সহজেই অভ্যস্ত হয়ে ওঠে এই দৃশ্যগুলোর সাথে। মেয়েটার কাছের মানুষগুলো কিন্তু একবারও এসে বলে না যে,‘তুমিও একটু গুছিয়ে খাও না! কেউ একটু খোঁজ নিয়েও বলে না যে, ‘এত সুস্বাদু ডিশ রান্না করে সব কি আমাদেরকেই খাওয়ালে? তুমি নিজে খেয়েছো তো? বলে না, আর বলবেও না। কারণ, সেটা পুরুষের কাজ নয়। একান্তই ঘরোয়া আর মেয়েলি ব্যাপার। সংসারের মূল চালিকাশক্তি নারীটি নিজে কেমন আছেন সেই খবরটা রাখাও বোধহয় পুরুষের কর্তব্যের মাঝে পড়ে না। আচ্ছা, আমার খবর অন্য কেউ রাখবে, আমার যত্ন অন্য কেউ নেবে, সেই আশাটাই বা করবো কেন আমরা? আমরা নারীরা যেখানে অন্য সকলের যত্ন নিতে, ভালোবাসতে এতটা পারদর্শী সেখানে আমরা কি পারিনা নিজেদের একটুখানি ভালোবাসতে? নিজেদেরকেও একটুখানি যত্নের ছোঁয়া দিতে? নিজেকে সম্মান দিতে?
আমরা নারীরা যদি নিজেরাই নিজেদেরকে সম্মান না করি, তাহলে সমাজের কী গরজ পড়েছে যে আমাদের সম্মান করার? আমরা মেয়েরা যদি একে অপরকে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা যুগিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবার পরিবর্তে, ঈর্ষা করে যদি পেছনে টেনে রাখার চেষ্টা করি, তাহলে সমাজের সর্বক্ষেত্রে চিরদিন দ্বিতীয়শ্রেণির নাগরিক হয়েই বেঁচে থাকতে হবে আমাদের। পরিশেষে এটাই বলতে চাই যে, চাইনা কোনো বিশেষ সুযোগ, চাইনা কোনো দয়া। প্রতিদিনই শুধু স্বপ্ন দেখি এমন একটা সমাজের, যেখানে কোনোক্ষেত্রেই নারী-পুরুষের কোনো বিভাজন থাকবে না। মানুষের একটাই পরিচয় হবে, সে ‘মানুষ’। সুস্থ, সুন্দর একটা সমাজ বিনির্মাণে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাবো সবাই। মাথা উঁচু করে বাঁচবো সকলে, একে অপরের পাশে থেকে, একে অপরকে ভালোবেসে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিল্প-সমালোচক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারীদের যাবতীয় অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধঅপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলার নারী