অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলার নারী

ড. সেলিনা আখতার | মঙ্গলবার , ৮ মার্চ, ২০২২ at ৭:৫৫ পূর্বাহ্ণ

৮ মার্চ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২২। দিবসটি পালনের পিছনে রয়েছে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ইতিহাস। ১৮৫৭ সালে ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সুতা কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকরা মজুরী বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা এবং কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে নিউইয়র্কের রাস্তায় আন্দোলনে নেমেছিল। তারা দৈনিক শ্রমঘণ্টা ১২ থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টায় আনা, ন্যায্য মজুরী ও কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবীতে সোচ্চার হয়েছিল। সেদিনের মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিল ১৫,০০০ নারী শ্রমিক। সেই মিছিলে কারখানার মালিকরা এবং মদদপুষ্ট প্রশাসন নারী শ্রমিকদের উপর দমন নিপীড়ন, নির্যাতন চালায়। আন্দোলন করার অপরাধে গ্রেফতার হন বহু নারী। ৩ বৎসর পর ১৮৬০ সালে একই দিনে গঠন করা হয় নারী শ্রমিক ইউনিয়ন। ১৯০৮ সালে পোশাক ও বস্ত্রশিল্প কারখানার প্রায় দেড় হাজার নারী শ্রমিক একই দাবীতে আন্দোলন করেন। অবশেষে তারা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার অধিকার আদায় করে নেন।
১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চ দিবসটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা প্রদান করে। বাংলাদেশে তা ১৯৭১ সাল থেকেই পালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশেই আন্তর্জাতিক নারী দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি ছুটির দিন হিসাবে পালিত হয়। মাটি থেকে মহাকাশ সর্বত্রই নারীর রয়েছে বিচরণ ও বিকাশ। এই বিকশিত হবার পথে নারীরা প্রতিনিয়তই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। হার না-মানা অদম্য শক্তিতে এই বাধাকে অতিক্রম করেই নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। নিজের সর্বশক্তি আর সাহস দিয়ে অর্জন করছে সফলতা। সব জায়গায় পুরুষের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে টিকে থাকছে এবং বিজয় ছিনিয়ে আনছে।
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইণ্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আই এফ সি) এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন ক্ষুদ্র ও মাঝারী নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ২৩ লাখ। বর্তমানে জিডিপি-তে তাদের অবদান ২০ শতাংশ। দেশের ৯ লাখ নারী কর্মী বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখছে। সরকারি হিসাবে শ্রমশক্তিতে নারীর অবদান ৩৬ শতাংশ। কৃষিকাজেও রয়েছে নারীর অবদান। আই সি টিতে নারী অংশগ্রহণ ৩৪ শতাংশ।
নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। সৃষ্টিকর্তা সেভাবেই সৃষ্টি করেছেন। এক সময় ছিল পুরুষরা যে কাজ পারে নারীরা সে কাজ পারে না। এখন দেখা যায় নারী পুরুষ সবাই সব কাজ পারে। কাজেই নারীকে এগিয়ে যেতে হবে সমাজের অগ্রগতির জন্য দেশের অগ্রগতির জন্য। দেশের শান্তি রক্ষায় পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েরা কাজ করছে। তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী উপাচার্য রয়েছে। যারা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এদেশে ডাকসুর ভিপি ছিলেন একজন নারী। বাংলাদেশের একজন নারী আন্তর্জাতিক দাবায় গ্রান্ড মাস্টার খেতাব পেয়েছেন। এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন বাংলাদেশের নারী। মোট রপ্তানীর ৮৪ শতাংশই পোশাক খাত হওয়ার পিছনের কারিগর নারীরাই।
স্বাধীনতা অর্জনের ২৮ বছর পর অর্থাৎ ২০০০ সাল বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট সর্বপ্রথম একজন নারীকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। তাঁর প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও বিচারিক ক্ষমতা দেশের বিচার বিভাগ আরো নারীকে বিচারকের পদে নিয়োগের পথ প্রশস্ত করেছে। দেশের উচ্চ আদালতে বর্তমানে ৮ জন নারী বিচারপতি রয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা এখন ৮ নারীসহ ১০৪ জন। বর্তমানে নারী বিচারকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৩০ জন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সমীক্ষা অনুযায়ী কর্মজীবী পুরুষের তুলনায় কর্মজীবী নারী কাজ করেন ৩ গুণ। সমীক্ষা অনুযায়ী মূলধারার অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃত উৎপাদন আয়ের মোট কর্মীর প্রায় অর্ধেকই এখন নারী। পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৪০ লাখ কর্মীর মধ্যে ৮০ শতাংশ নারী। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৭ লক্ষ বাংলাদেশী নারী কর্মরত। সরকারি সংস্থা বিআইডিএস-এর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী জিডিপিতে কর্মজীবী নারীদের অবস্থান ২০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমানে ব্যংক খাতে ১৮ শতাংশ নারী কাজ করেন। রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমানের পরিচালনায় ২০ জন নারী পাইলট রয়েছেন। এছাড়াও নারীদের কাজের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতেও সহায়ক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মাতৃকালীন ছুটি তিনমাস থেকে দুই ধাপে বাড়িয়ে ছয়মাস করা, সন্তানের পরিচয়ে মায়ের নাম যুক্ত করা; ইউনিয়ন পর্যায়ে ছেলের পাশাপাশি একজন নারী উদ্যোক্তা নিশ্চিত করা; মেয়েদের তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে ‘তথ্য আপা’ প্রকল্প চালু, নগরভিত্তিক প্রান্তিক মহিলা উন্নয়ন প্রকল্প, নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ সাধন প্রকল্প, অতি দরিদ্র ১০ লাখ মহিলার দক্ষতা উন্নয়ন ও কারিগরি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া, নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা দেশে বিক্রয়ের জন্য নারী বান্ধব বিপণন নেটওয়ার্ক জয়িতা গড়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়াও তৃণমূল নারীদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশব্যাপী ১২ হাজার ৯৫৬ টি পল্লী মাতৃ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মা ও শিশুর যত্নসহ যাবতীয় বিষয়ে উদ্বুদ্ধকরণ, সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়া হয়েছে। এভাবে শতবাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাবে নারীরা। সরকারের পাশাপাশি নারীদের সহযোগিতা করতে হবে পুরুষদেরও।
বাংলার নারীরা যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে তা বিশ্বে বিরল। বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মাস্টার দা সূর্যসেন চট্টগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। তাতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল। মাষ্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি চট্টগ্রাম শাখা। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত এই দু’জন নারী নেত্রী চট্টগ্রামে বিপ্লবী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মাস্টারদা যখন তাদেরকে দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন তখন প্রীতিলতা জিজ্ঞেস করছিলেন ছেলেদের বাদ দিয়ে তিনি প্রীতিকে কেন দায়িত্ব দিচ্ছেন। মাস্টার দা উত্তরে বলেছিলেন বাংলায় ঘরে ঘরে বীর যুবকদের অভাব নেই। কিন্তু ইংরেজরা জানুক, জগৎ অবলোকন করুক এদেশে মেয়েরাও আজ পিছিয়ে নেই। অপারেশন সফল হয় নি। ধরা পড়ে নির্যাতন করে কথা বের করে নিতে পারে এই জন্য তিনি সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। অসীম সাহস আর বীরত্বগাথা নিয়ে মাস্টারদার দলে যোগ দিয়েছিল কল্পনা দত্ত। তিনি চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অগ্নিকন্যা নামে খ্যাত ছিলেন। পরবর্তীতে অন্য একটি বিষয়ে কল্পনা দত্ত তার দুই সহযোগী সহ ইংরেজদের হাতে ধরা পড়েন। দুই সহযোগীর ফাঁসির আদেশ হলেও মেয়ে বলে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তেভাগা আন্দোলনে নাচোলের রাণী ইলা মিত্রের ত্যাগের কথা আমরা সবাই জানি। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি পর্বেই মহিলারা অংশ নিয়েছিলন ব্যাপকভাবে। ভাষা আন্দোলনে মেয়েরা ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের পুরনো ছবিগুলো দেখলে সেখানে আমরা মেয়েদের উপস্থিতি দেখতে পাই। স্বাধীনতা যুদ্ধেও মেয়েরা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ৩০ লাখ শহীদের সঙ্গে ২ লাখ মা-বোনও তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি বীর প্রতীককেও স্মরণ করতে হয় এই দিনে।
প্রতিদিনই নারীর প্রতি নির্যাতন, হয়রানিসহ নানান ধরনের নেতিবাচক খবর আসে। কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেড়েছে। এর পরও নারী উপেক্ষার শিকার হচ্ছে। বেতন বৈষম্য থেকে নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। পরিবারে নারীর ভূমিকা কিংবা সন্তান পালনসহ গৃহস্থালি কাজকর্মে নারীর অবদানকে অর্থনৈতিক কর্ম হিসেবে স্বীকার করা হয় না। বিশ্বজুড়ে নারী অগ্রগতি ও মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্যে অনেক পথ পাড়ি দেওয়া এখনো বাকি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নির্বিশেষে মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবি তাই সার্বজনীন। নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য ও অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটিয়ে সম-অংশীদারিত্বের বিশ্ব গড়ার প্রত্যয় নিয়ে নারীর এগিয়ে চলা আরও বেগবান হবে, এটাই নারী দিবসের প্রত্যাশা।
নারী পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আজ সমাজে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। রাজনীতির ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। অদৃশ্য নারী এখন দৃশ্যমান। এই দৃশ্যমানতাকে সমাজের কাছে, রাষ্ট্রে কাছে তুলে ধরার দায়িত্ব আপনার আমার সবার। আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কেও ধারণা থাকতে হবে। নারীদেরকে নারী নয়, প্রার্থী ও প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়েও বেশি নেতা হিসেবে ভাবতে হবে। নেতা হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে এবং চরিত্রে নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন করতে হবে। কথায় নয়, কাজে-আচরণে সৎ ও স্বচ্ছ থাকতে হবে; জবাবদিহি করার মানসিকতা থাকতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। কারণ অংশীদারত্ব ছাড়া অংশগ্রহণ কার্যকর হয় না।
লেখক : প্রফেসর, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারী দিবস- একান্ত ভাবনায়
পরবর্তী নিবন্ধমনোরঞ্জন দে