নববর্ষ তার মর্যাদায় অভিষিক্ত

সুপ্রতিম বড়ুয়া | সোমবার , ১৪ এপ্রিল, ২০২৫ at ৭:১০ পূর্বাহ্ণ

বসন্তের শুভাগমনের প্রাক্কালে বৈচিত্র্যিক আবহ আমাদের আবেগে আপ্লুত করে তোলে। ষড়ঋতুর পালাক্রমে নৈসর্গ নিজস্ব নিয়মে তার প্রতিবেশকে যে মাত্রায় রাঙিয়ে দেয় সেও আবহমান বাংলার নিরন্তর শোভাবর্ধন। ফাল্গুনচৈত্রের শেষ বিকেলের মর্মরধ্বনিতে বাতাসের যে আকুলতা সেটাই বর্ষ বিদায়ের সকরুণ বেদনা। আবার নতুন বছরের নব উদ্দীপনায় নিজেদের তৈরি করে নেওয়াও আনন্দঘন মূর্ছনা। আমরা যেন বিভোর বিমুগ্ধ হয়ে নববর্ষকে স্বাগত জানাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিবেদিত হই। আমরা উৎসব প্রিয় জাতি। আবহমান কালের বাঙালির ষড়ঋতুর আবাহন যেন তাদের নিত্য জীবনচেতনা, চিরস্থায়ী মঙ্গলযোগ। এই অবিমিশ্র সাংস্কৃতিক বাতাবরণ যেন বাংলা ও বাঙালিকে এক সুতায় গেঁথে রেখেছে। সঙ্গত কারণে ঋতু পরিবর্তনের নানা মাত্রিক আড়ম্বরে শাশ্বত বাংলার পরিশীলিত মননও যেন ভিন্ন মাত্রার জীবন যাপন। ঋতুরাজ বসন্ত যেভাবে তার সামগ্রিক আবেদনের পসরা সাজিয়ে ফাল্গুন চৈত্র মাসকে ফুলেল সজ্জা এবং ঝরাপাতার মর্মর ধ্বনির ব্যাকুলতায় মাতিয়ে দেয় সেখানেই যেন প্রচ্ছন্ন থাকে নতুন বছরের নব সম্ভাবনা। এবারের নতুন বছর অন্যরকমভাবে তার সন্তানদের মাতিয়ে রাখবে। রৌদ্রের খরতাপে জনজীবন এখন অবধি অতিষ্ঠের পর্যায়ে যায়নি। বরং বাতাসে এখনো সহনীয় প্রতিবেশ মৃদু মন্দ হাওয়ায় যেন ঋতুরাজ বসন্তের সর্বশেষ স্পর্শ। নতুন বছরের বৈশাখ এখনো প্রকৃতিতে তার আবহ তৈরি করেনি। নিয়মমাফিক পুরনো বছর বিদায় নিয়েছে। নৈসর্গও নব আঙ্গিকে প্রকৃতিতে সাড়া জাগাচ্ছে। নববর্ষের উন্মাদনায় নতুনকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতির কোলের সন্তানরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। নতুন বছরই শুধু নয়, প্রথম মাস বৈশাখকেও নব আনন্দে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানানো হবে। সঙ্গত কারণে বৈশাখকে তার মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে চিরায়ত বাংলা যেন সাজানো ফুলের ডালায় অপেক্ষমাণ। নতুন বছরকে ফুলেল শুভেচ্ছায় ভরিয়ে তুলতে হরেক কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশ। উন্নয়নের অভিগামিতায় সামনের দিকে ছুটে চলেছে। নিত্যনতুন কর্মপরিকল্পনা দৃশ্যমান হতেও সময় লাগছে না। আমাদের সাংস্কৃতিক উৎসবের সিংহভাগ জুড়ে থাকে বাংলার নববর্ষের সার্বিক আয়োজন। এমন উৎসব নগরে, শহরে কিংবা বন্দরে নয়, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মানুষের জীবনকে যেন মাতিয়ে রাখে। বাংলার মাটি আর মানুষের শিকড়ের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো আমাদের ঐতিহ্যিক ও শৈল্পিক বৈভব। নান্দনিক চেতনায় সাংস্কৃতিক বোধকে জাগিয়ে তোলাও যেন আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য। তেমন স্বাজাত্যবোধ থেকেই মাতৃভূমি আর মাতৃভাষার প্রতি আমাদের সহজাত অভিব্যক্তি। আবহমান বাংলার সমৃদ্ধ বৈভব এবং অনন্য সাংস্কৃতিক শৌর্য এই অস্ট্রিক জাতিসত্তার রক্তে মাংসে যেন জিইয়ে আছে। নববর্ষের আয়োজনে বৈশাখের নতুন প্রহরে সাঙ্গীতিক ঝর্ণাধারায় নতুন বছরের আবাহনী পর্ব শৈল্পিক দ্যোতনায় মহীয়ান করে তোলে। খাবারেও থাকে গ্রামবাংলা নিত্যনৈমিত্তিক ঐতিহ্য। পান্তা ইলিশসহ মুখরোচক, সুস্বাদু ভর্তা বাংলার সাধারণ মানুষের নিয়মিত খাদ্য। সেখানে ক্ষেত্রবিশেষে রুপালি ইলিশের বাড়তি স্বাদের জায়গায় নদীনালাপুকুর, ঘেরে যেসব সহজলভ্য মাছ পাওয়া যায় তাই যেন সই। যা ‘মাছে ভাতে বাঙালি’শাশ্বত এই প্রবাদ বাক্যেরও অনুষঙ্গ। কৃষিনির্ভর গ্রাম বাংলার এটাই তো চিরাচরিত সম্ভার। গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের আহারে পান্তাভাত অতি প্রয়োজনীয় খাবার। যা পহেলা বৈশাখের জৌলুসে ঢেকে যায়। আর পল্লী বাংলায় থাকে নিত্যদিনের আয়োজন। বেগুন, আলু, শুঁটকিসহ যাবতীয় ভর্তা শুকনো লঙ্কা পুড়িয়ে পেঁয়াজের সঙ্গে মেশানোর পর যে উপাদেয় খাবারটি তৈরি করা হয় সেটাও চিরায়ত বাংলার শাশ্বত সম্ভার। অর্থাৎ এই দেশের সার্বিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনে প্রতিদিনের আহারের যে নিত্য সামগ্রী সেটাই নববর্ষে নতুন আঙিকে সাজিয়ে তোলা হয় যা বাংলার ধনী, মধ্যবিত্ত, দরিদ্র সব মানুষের মধ্যেই সাড়া জাগায়। সঙ্গত কারণে নববর্ষের আনন্দযজ্ঞ একদিনের আবেদন নয়। সেটা প্রতিদিনের জীবনাচরণ, নিত্য খাদ্যাভ্যাস, দৈনন্দিন কর্মযোগ ছাড়াও চিরকালের অনমনীয় চেতনা। যার জন্য আমরা প্রায় প্রতিদিনই বরণের ডালা সাজাই। একই আঙ্গিকে নববর্ষকে নতুনভাবে সাজিয়ে অন্যমাত্রার উৎসব আয়োজনে মেতে উঠি। নববর্ষের শুভাগমনে প্রকৃতিও ক্রমান্বয়ে রুদ্র রূপে নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছে। যার উষ্ণ আবহ ইতোমধ্যে প্রতিবেশকে আলতো ছোঁয়া দিতে দেরি করছে না। দাবদাহে প্রকৃতির খরতাপে ঝরা পাতার মর্মরধ্বনি তো পুরো আবহকে অন্যমাত্রায় মাতিয়ে তোলে। এরই মধ্যে ফেলে আসা দিনের আবর্জনা যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে এমন অভিব্যক্তি প্রকৃতির কোলের সন্তানদের। যার কাব্যিক অনুরণনে তেমন অভিব্যক্তি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে হৃদয় মাঝে সৃষ্টি হয় নতুনত্বের আবাহন। আমরাও আমাদের নানামাত্রিক অর্জন ও অনাকাঙ্ক্ষিত বিসর্জনের পালাক্রমে নতুন বছরকে সম্ভাবনার সার্বিক প্রত্যাশায় ভরে তুলতে চাই। কোথাও কোনো ব্যবচ্ছেদ তো হয়ই নাবরং সব কিছু মিলে মিশে আমাদের সার্বিক চেতনায় একাত্ম হয়ে যায়। সুখদুঃখ, আনন্দবেদনা নিয়েই যাপিত জীবনের সময় পার করতে হয় মানুষকে। এসব মানুষের জীবনকে পরিপক্ব করে তোলে। চলমান জীবনে থেমে থাকার কোনো সুযোগই নেই। প্রাপ্তিঅপ্রাপ্তিকে পেছনে ফেলে সময়ের সঙ্গে অবগাহনে নিজেকে চালিত করাও এক প্রকার বিধি। এক কথায় বলতে চাই, নতুন বছরকে স্বাগত জানানো, সকল উৎসবে মেতে ওঠা সবই যেন জীবন যাপনের উৎসবমুখর ঘটনাক্রম।

লেখক: অধ্যক্ষ, রামু সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুলাই বিপ্লবের স্বপ্ন বাস্তবায়নে গণতন্ত্রে ফিরতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধযাত্রায় পহেলা বৈশাখ এবং তার দ্রোহচেতনা