বিদেশে প্রায় এক যুগ কাটিয়েছেন ফেনীর দাগনভূঞার আনিসুল হক মিলন; দীর্ঘদিন বাদে দেখা হবে প্রিয়জনদের সঙ্গে এমন আশা নিয়ে দেশের পথে রওনা করেছিলেন তিনি। তাকে ঘিরে বিদায়ের যে আনন্দ আয়োজন তা ভোরের এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় রূপ নিয়েছে শোকে।
মিলনকে কেপটাউন বিমানবন্দরে বিদায় দিতে গতকাল শুক্রবার ভোরের যাত্রায় সঙ্গী হয়েছিলেন আরও ছয়জন। কিন্তু তাদের বহনকারী প্রাইভেট কার লরি চাপায় পড়ে এক শিশুসহ প্রাণ গেছে পাঁচজনের; আর মিলন বাড়ি ফেরার বদলে হাসপাতালে লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে। শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল ৬টার দিকে দেশটির জোহানেসবার্গ থেকে কেপটাউনে যাওয়ার পথে
ওয়েস্টার্ন কেপ প্রদেশের বাফুটু ওয়েস্ট এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। খবর বিডিনিউজের।
গুরুতর আহত মিলন ও দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো পাঁচজনের বাড়িই ফেনীর বিভিন্ন উপজেলায়। আরেক আহত নাহিদ আহমেদের বাড়ি শুধু গোপালগঞ্জে। পাঁচ বাংলাদেশির এমন মর্মান্তিক বিদায়ের বর্ণনা দিয়েছেন আরেক প্রবাসী আনোয়ার হোসেন; তার বাড়িও ফেনীর দাগনভূঁইয়া উপজেলায়। নিহতরা হলেন ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের শরীয়ত উল্লাহর ছেলে ইসমাইল হোসেন (৩৮), দাগনভূঞা উপজেলার দক্ষিণ নেয়াজপুর গ্রামের রাজু আহমেদ (৩৪) ও মাতুভূঞা ইউনিয়নের মমারিজপুর গ্রামের মো. মোস্তফা কামাল (৪০), সোনাগাজী উপজেলার চর মজলিশপুর গ্রামের আবুল হোসেন (৩৫) ও তার ছেলে সন্তান নাদিম হোসেন (১০)।
দুর্ঘটনায় দূর সম্পর্কের মামা ইসমাইল হোসেনকে হারিয়েছেন আরেক প্রবাসী মশিউর রহমান; তিনি জোহানেসবার্গে থাকলেও একই এলাকার লোক হওয়ার সুবাদে সবার সঙ্গেই ছিল নিয়মিত যোগাযোগ। মশিউর বলেন, বিউফোর্ট ওয়েস্টের যে এলাকায় থেকে মিলনরা রওনা করেছিলেন, কেপটাউন বিমানবন্দর থেকে তার দূরত্ব সাড়ে চারশ কিলোমিটারের বেশি। বেলা ১২টা ৩৫ মিনিটে কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইট ছাড়ার কথা ছিল। তারা ভোর ৪টার দিকে রওনা করেছেন বলে শুনেছি। ১০০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার পথ গিয়ে দুর্ঘটনায় মুখে পড়েন তারা। ইসমাইল হাঙ্গেরির ভিসার আবেদন করেছিলেন কেপটাউন থেকে। পাসপোর্ট আনার জন্য সেখানে যাওয়ার কথা ছিল। সঙ্গে মিলনকে বিদায় দিয়ে আসবেন– এটা ছিল পরিকল্পনা। উনার বাসের টিকেট কাটা ছিল বৃহস্পতিবার রাতের। কিন্তু সবাই একসাথে যাবেন বলে তিনি বাসে না গিয়ে প্রাইভেট কারে রওনা হন।
আগে অন্য শহরে থাকলেও বছরখানেক হল বিউফোর্টে এসেছেন প্রবাসী আনোয়ার হোসেন; একই এলাকার লোক হওয়ার সূত্রে রাজু আহমেদ ও মোস্তফা কামালদের সঙ্গে নিয়মিত ওঠাবসা। মিলনের বাড়িফেরা ঘিরে গত বৃহস্পতিবার রাতেও নিহতদের কয়েকজনের সঙ্গে আড্ডা ও বাড়ির গল্প হয়েছিল বলে জানান তিনি। দুয়েকজনের অন্য কাজ থাকলেও মিলনের বাড়ি যাওয়াকে কেন্দ্র করে সবাই একই গাড়িতে রওনা করেছেন বলে জানান আনোয়ার। নিহত আবুল হোসেনের ছেলে নাদিম হোসেনও তাদের সঙ্গী হয়ে মাত্র ১০ বছর বয়সে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় চিরবিদায় নিয়েছে। জন্মসূত্রেই দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক ছিল সে। পাঁচ স্বদেশির বিদায়ে তাদের সঙ্গে কাটানো আনন্দ–বেদনার সময় বারবার চোখে ভাসছে আনোয়ারের। সপ্তাহখানেক আগেও তারা একটি ‘হাঁস পার্টি’ করেছিলেন, যাতে উপস্থিত ছিলেন নিহত রাজু ও মোস্তফা কামাল।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে আনোয়ার বলেন, যারা নিহত হয়েছেন, তাদের সঙ্গে কত সময় যে আমরা একসাথে কাটিয়েছি, তার হিসাব নাই। তাদের এই মর্মান্তিক বিদায় মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। কালরাতেও তো আমরা একসাথে আড্ডা দিয়েছি। আহতদের মধ্যে দেশের পথ ধরা মিলনের অবস্থা বেশ গুরুতর। নাহিদকেও হাসপাতালে চিকিৎসকরা পর্যবেক্ষণে রেখেছেন বলে জানান তিনি।
নিহত ইসমাইল হোসেনের পিতা শরীয়ত উল্লাহ জানান, আমার ছেলে ইসমাইল হোসেন অবিবাহিত। দুই মাস পরে দেশে ফিরলে তাকে বিয়ে করানোর প্রস্তুতি চলছিল। তিনি ১১ বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকেন। তিনি বলেন, আমার ছেলেকে হারিয়েছি তবে মরদেহটি দ্রুত চাই।