দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:২০ পূর্বাহ্ণ

পড়েছি মোগলের হাতে

নাহ চায়নিজরা দেখছি এক্কেবারে ব্যক্তিপর্যায়েও ভালভাবেই আত্মস্থ করেছে বিপননের ব্র্যান্ডিংয়ের মাজেজা! আর সে ব্যক্তিরা যে নামকরা পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাবসা প্রশাসনের বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে, দামি ব্রান্ডের স্যুট টাই পড়ে বসে আছেন নানা চায়নিজ কর্পোরেট হাউজের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে, তাই নয় শুধু। নেমে এসেছেন তারা চায়নার রাস্তায়, এক্কেবারে শোফারের ভূমিকায়ও !
ভাবতে ভাবতে মিস ইনাকে ধন্যবাদ দিয়ে বা দিকে ঘুরে হাঁটা দিতেই ফের পেছন থেকে সে একটু গলা উঁচু করে জানাল যে, যেকোন সমস্যায় পড়লে যেন দ্বিধাহীনভাবে ফোন করা হয় তাকে ! বুঝলাম শুধু এই আমি বেকুব বাংগালই না, নানান দেশের তালেবররাই এই চায়না মুল্লুকের রাজধানী ঘুরতে বেড়িয়ে অহরহই পড়ে যে নানান বেমক্কায় সমস্যায়; সে খবর খুব ভাল জানা আছে হোটেলের এই কন্সিয়ার্জ ডেস্কের লোকজনদের।
বা দিকে ঘুরে হাটা শুরু করতেই হোটেলের স্বয়ংক্রিয় বৃত্তাকার দরজার প্রধান প্রবেশপথের অদূরে অপেক্ষমান পরিবারের বাকীদের দিকে চোখ পড়তেই বোঝা গেল পরিষ্কার যে, বাইরের হিমের দমকে পুত্ররা , তাদের ফেরারিদর্শন সংক্ষিপ্ত করে দ্রুতই ফিরে এসেছে এরই মধ্যে। দলের কাছে এসে সবাইকে হোটেলের সেই দ্বিভাষিক ঠিকানাকার্ড একটা করে দিয়ে বললাম, খুব ভাল করে রাখে যেন তা তারা যার যার সাথে। আপাতত এই কার্ডই আমাদের বেইজিং ট্যুরকালীন রক্ষাকবচ। কোন অঘটনঘটনজাতীয় কারণে কেউ যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দল থেকে , তবে সে বা তারা যেন একটা ট্যাঙি ধরে ট্যাঙিওয়ালাকে এই কার্ডের চায়নিজ অংশ দেখিয়ে সোজা চলে আসে হোটেলে। এ কথা বলতে বলতেই মনে হল , আরে ট্যাঙি ধরে যে আসবে এখানে, তার জন্য তো রেন মেন বি লাগবে। লাজু আর হেলেন কে কিছু রেন মেন বি তো দিয়েছিলাম, তা কি আছে সাথে তাদের? কিন্তু দীপ্র অভ্রর কাছে তো তা নাই। অতএব কাঁধে ঝোলানো পাশব্যাগ থেকে মানিব্যাগ বের করে দীপ্র অভ্রকে পঞ্চাশ করে রেন মেন বি দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম স্ত্রী বা বোনের সাথে আছে কি না চায়নিজ কড়ি। না থাকলে তাদেরও দিতে পারি।
সাথে সাথে দুজনেই নিজ নিজ হাতব্যাগ পরীক্ষা করে নিশ্চিত করল যে লাগবে না এ মুহূর্তে কোন রেন মেন বি তাদের আর। আছে যথেষ্ট তা তাদের ব্যাগে।
এদিকে নিজ হাতে যখন অভ্রর জ্যাকেটের দুই ভিন্ন পকেটে সেই রক্ষাকবচ ঠিকানাকার্ড আর হাতের পাঁচ হিসাবে পঞ্চাশ রেন মেন বি ঢুকিয়ে দিচ্ছিলাম, তখনই শুরু হল আবার দুভাইয়ের দ্বৈরথ, যার শুরুটা করেছে দীপ্র।
হঠাত করেই সে বড় ভাইয়ের ভূমিকা ধারন করে মুরুব্বিয়ানা স্বরে অভ্রকে ঐ টাকা আর কার্ড যাতে সে হারিয়ে না ফেলে বা আমাদের থেকে দলছুট হয়ে না পড়ে, সে ব্যাপারে উপদেশ দিতে শুরু করতেই, ফোঁস করে প্রতিবাদ করে উঠল অভ্র। দ্রুত দুজনকে নিবৃত করে, দু হাতে দুজনকে ধরে, গেইটের দিকে এগুতে এগুতে জিজ্ঞেস করলাম, বাইরে গিয়ে কি তারা আমাদের কে নিতে আসা ছাইরঙ্গয়ের ভ্যানটি দেখেছিল কি ? আর দেখেই যদি থাকে তবে ওটা কোন ব্র্যান্ডের গাড়ি?
যুগপৎ দু জনেরই না বোধক উত্তরে ঠাহর করতে পারলাম না, এমনটা ঘটল কেন? এ তো হওয়ার কথা নয় ! তবে কি শোরুমের ঐ দুই ফেরারি সুন্দরী তাদের মন এমনই আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে অন্য কোন গাড়ীর দিকে চোখ দেবার কোন ফুসরতই পায় নি নাকি ওরা? নাকি অতো ঠাণ্ডায় অন্যদিকে মন দেবার মতো সময় পায়নি দুজন।
ইতোমধ্যে সবাইকে নিয়ে গেইটের বাইরে এসে তুমুল হিমে দাঁড়াতেই, পেছন থেকে আসা যুগল নারীকণ্ঠের অস্ফুট হাহাকার আর হঠাৎ আসা একটা হিমতর বাতাসের ঝাপটা মুখে এসে লাগতেই প্রমাদ গুনলাম মনে মনে । পরিষ্কার বোজা গেল গত সন্ধ্যার চেয়ে ঠাণ্ডার প্রকোপ বেড়েছে বেশ আজ। এগুলাম তাই দ্রুত ডান দিকে, মিটার বিশেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের শকটের দিকে, যার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমাগো মিস্টার লি। যদিও একটু আগে তার নাম শুনেতই মনের আয়নায় ভেসে উঠেছিল ব্রুস লি র চেহারা, এ মুহূর্তে তার থুতনি এক মুঠো চায়নিজ দাড়ি, যাকে নাকি আমাদের দেশে বলে ছাগলা দাড়ি; তা থেকে মুক্ত থাকার পরও তার বদন মোবারক দূর থেকে দেখেই কেন জানি , মনের আয়নায় এবার, নানান সময়ে নানান জায়গায় দেখা মঙ্গোলিয়ান সম্রাট কুবলাই খানের চেহারাটাই ভেসে উঠলো। অতএব প্রাচীন চিনের ইয়ুয়ান রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা মহামান্য কুবলাই খানের স্মৃতি ভাস্বর করার উদ্দেশ্যে আমাদের শোফারকে লি খান বলেই ডাকব বলে স্থির করলাম । যদিও নিশ্চিত আমি তার নামের খান নিয়ে আমাদের শোফার কে তা দিয়ে দেবার অপরাধে, কুবলাই খাঁ বেঁচে থাকলে আমার হয়তো কল্লা নিতেন, কিন্তু এখন তো তার সেই সুযোগ নেই আর!
দ্রুত পায়ে গাড়ীর দিকে সবাইকে নিয়ে এগুতেই, গাড়িটি দু ভাইয়ের নজরে পড়তেই একসাথে দুজনেই কিছুটা হতাশ হয়ে বলল আহ, “এটা তো দেখছি টয়োটা !” এ মুহূর্তে তাদের এই হতাশা কি কারনে তা নিয়ে ভাববার অবকাশ আর কই, ফলে তাদের সে কথায় গ্রাহ্য করেই এগুলাম সামনে।
আমাদের দেখার পর এতোক্ষণ সম্ভাব্য শোফার লি খানের দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে কোন পরিবর্তন না আসলেও, যেই না তার সামনে এসে দাঁড়ালাম, সাথে সাথে সে এটেনশন ভঙ্গিতে সোজা গেল। মুখে সে কিছু বলল কি বলল না তা বুঝতে পারলাম না, তবে মাথার মৃদু নড করার ভঙ্গিতে বুঝলাম, আমাদের সম্ভবত সে অভিবাদন জানিয়েছে, কিন্তু এখনো সে নিশ্চিত না যে আমরাই তার আজকের যাত্রি কি না?
এসময় দ্রুত ওকে রুমের নম্বর বলতেই, আবারো একটু জোরেই নড করে ঝটপট গাড়ীর মাঝামাঝি থাকা পাশ দরজাটি খুলে দিয়ে আমাদের গাড়িতে উঠার পথ সুগম করার জন্য। লি খান কে ধন্যবাদ দিয়ে, খোলা দরজা দিয়ে রুম থেকে বয়ে আনা হাতের বড় পানির বোতলগুলো মাঝের সিটের উপর ফেলে দিয়ে, সবাইকে গাড়িতে উঠার তাড়া দিতেই, বাইরের হিমের ধাক্কাতেই সম্ভবত হুড়মুড় করে উঠে পড়ল ওরা। মোটামুটি জনা আট / দশ লোক অনায়াসে যেতে ঘুরতে পারে এই ভ্যানের পেছন দিককার সিটগুলোতে বসে। অতএব দ্রুত সামনের আর মাঝের সিটে কিছুটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে গেল ওরা চারজন ।
এদিকে লি খানের মুখের দিকে তাকিয়ে ঠাহর করতে পারছি না যে এ হাড়হিম করা ঠাণ্ডায় তার গোটা চেহারাই জমে বরফ হয়ে গেছে, না কি এমনিতেই তার মুখ এরকম ভাবলেসহীন ? জিন্সের প্যান্টের উপর কালোহুড তোলা জবরজং ফোলা ফোলা জ্যাকেটের হুডের নীচের পাথুরে সেই মুখের দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করার উপায় নেই বয়স কি তার চল্লিশ, পঞ্চাশ নাকি ষাট? হাত দিয়ে সামনে ইশারা করে বোঝালাম ওকে যে, আমি পেছনে যতই জায়গা থাকুক না কেন, বসছি আমি তার সাথেই সামনে, ড্রাইভিং সিটের পাশে।
ফের সসস্মানে মাথা নড করে এই প্রথমবারের মতো মুখ খুললেন লি খান সাহেব। তবে খুব বেশী কিছু বললেন না। “ওকে, ওকে” বলে দ্রুত সামনের দরজা খুলে দিলেন আমার জন্য। সিটে উঠে বসতে বসতে ভাবলাম, ব্যাপার কি, এই বেইজিং এসে হোটেলের বাইরে এই পর্যন্ত যে দু’জনের সাথে টুকটাক বাৎচিত করার সুযোগ হয়েছে, তার মধ্যে ইনি হলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি। প্রথমজন তো ছিলেন সেই কাল রাতের খাম্বাবৎ দোকানদার। সে যেমন গতরাতে কেনাবেচা করেছে আমার সাথে বিনাবাক্‌য়ব্যয়ে, তেমনি কি লি খানের সাথেও আজ সারা দিন চলতে হবে বিনাবাক্যব্যয়ে, মূকাভিনয় করে করেই। এ গ্রহের অন্যতম প্রধান শহর বেইজিং আজো কি অন্তত ভাষাগতভাবেও কসমোপলিটান হয়ে উঠেনি !
এরই মধ্যে গাড়ীর সামনে দিয়ে হেঁটে, লি খান ঐ পাশে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসে, একহাত স্টিয়ারিং ফেলে, অন্যহাত হ্যান্ডব্র্যাকের উপর রেখে, পাশ ফিরে ভাবলেসহীন চেহারায় তার চায়নিজ ব্র্যান্ডের চোখে পিটপিট করে আমার দিকে তাকাতেই, বুজলাম অপেক্ষা করছে সে আমার হুকুমের। মানে হুকুম পাওয়া মাত্রই সে ছুটিয়ে দেবে তার শকট।
হাত দিয়ে ইশারা করার সাথে সাথে খুব সন্তর্পণে প্রতিটা শব্দ আলাদা আলাদা করে বললাম, দাড়াও লি খান। তুমি কোন পরিকল্পনা এঁটে রেখেছ মনে তা তো জানি না, আর যা ই থাকুক তা, আমারটা শুনে নাও আগে।
এতটুকু বলতেই লি খান দ্রুত গাড়ীর ডেশবোডের্র যে জায়গাটি দিয়ে এয়ারকন্ডিশনার থেকে বের হয় আবহাওয়া বুঝে ঠাণ্ডা বা গরম হাওয়া, ওখানটায় ঝুলিয়ে রাখা একটা শিকাকৃতির প্লাস্টিক নেটের তৈরি ছোট্ট থলে থেকে বেশ বড়সড় পর্দার একটা হাতফোন বের করে আমার সামনে ধরে, ঐটির পর্দার নীচের দিকের ইংরেজি কি বোর্ডের অক্ষরগুলোর দিকে আঙ্‌গুল দিয়ে দেখিয়ে, দেহ ভঙ্গিতে কিছু বোঝাতে বোঝাতে মুখেও কিছু বলছিল, যার মধ্যে আমি শুধু বুঝতে পারলাম একটা শব্দ আর তা হল “প্লিজ”-নাহ এতে এক্কেবারে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হইনি যদিও, তবে বেশ ভির্মি যে খেয়েছি তা স্বীকার করতেই হয়। ফলে শুরুতে ফ্যালফ্যাল করে একবার সেই ছোঁয়া ফোনের পর্দায় নজর দিয়ে, লি খানের মুখনিঃসৃত শব্দরাজির দিকে তোয়াক্কা না করে তার ভাবলেশহীন মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বুঝতে পারলাম না । কিন্তু দ্বিতীয় বার ঐ দুটোর দিকে তাকিয়ে কিভাবে যেন বুঝে গেলাম যে লি খান আমাকে বলছেন, আমি যা বলছি, তা যেন তার ঐ হাতফোনে ইংরেজিতে লিখে দেই।
আন্দাজে এটুকু বোধগম্য হতেই সাথে সাথে, তার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে, লিখলাম যে আজ আমরা প্রথমে যেতে চাই তিয়েন আন মেন স্কয়ার। তিয়েন আন মেন স্কয়ার দেখে আমরা লাঞ্চ করবো। তারপর দেখতে যেতে চাই বেইজিংয়ের পাখির বাসাখ্যাত অলিম্পিক স্টেডিয়ামে।
এতোটুকু লেখা হতেই, লি খান আমার কাছে থেকে ফোনটি নিয়ে, কি একটা বোতামে চাপ দিতেই দেখি সব লেখাগুলো হয়ে গেছে চায়নিজ! আর তা দেখে লি খানের ভাবলেশহীন মুখের একটু ভাবের পরিবর্তন হল। দেখা গেল ওখানে সামান্য হাসি রেখা। ততোক্ষণে সে মুখেও বলেছে ‘ইয়েস, ইয়েস ওকে ওকে।’
ভোজবাজির মতো ছোয়াফনের ইংরেজি বদন চায়নিজে রূপান্তরিত হতেই মনে মনে ভাবলাম, বাহ ! ভালই তো। ব্যবসা ধরার জন্য চায়নিজরা ভালই ব্যবস্থা করেছে তো! আমজনতাকে তো আর রাতারাতি ইংরেজি শিখিয়ে ফেলা যাবে না, তাই তারা এর বের করেছে ডিজিটাল সমাধান। এই ডিজিটাল ট্রান্সলেটর থাকলে কারো ক অক্ষর গো মাংস ইংরেজি জ্ঞান থাকলেও ব্যবসা তার আটকাবে না। সাথে সাথে এও হৃদয়ঙ্গম করলাম যে মিস ইনা আসলেই আমাদের তুলে দিয়েছেন আক্ষরিক অর্থেই কুবলাই খানের হাতে। মানে, পড়েছি আসলেই আক্ষরিক অর্থেই এক মোগলের হাতে, কারণ তাকে দেখেই তো মোঙ্গলিয়ান সম্রাট কুবলাই খানের চেহারা ভেসে উঠেছিল মানসচক্ষে। এখন খানা খাই আর না খাই তার সাথে ঘুরতে ঠিকই হবে একসাথে সারাদিন আজ তারই সাথে!
এ ভাবনা মনে আসতেই ফের মনে হল, আচ্ছা এই যে আমি লিখলাম যা ইংরেজিতে গ্রামার মেনে পরিপূর্ণ বাক্য হিসাবে, তার অনুবাদ এই যন্ত্র কি করেছে? আর সেটি পড়েই বা লি খান কি বুঝে ইয়েস ইয়েস করল তা তো বুঝতে পারছি না । নিজের অভিজ্ঞতায় ডিজিটাল গুরু গুগুল কে যে রকম অনুবাদকর্ম করতে দেখেছি নানা সময়ে, তাতে তো অনেক সময় নিজেই বুঝি না কি লিখেছিলাম আর পেলাম তার কি অনুবাদ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধম্যাজিস্ট্রেট মুনীর চৌধুরীর মতো চাই আইনের নির্মোহ প্রয়োগ
পরবর্তী নিবন্ধকোরবানীগঞ্জের লেখকত্রয়ী