ফুটপাত ভ্রমণলব্ধ জ্ঞান
চারদিকে চোখ জরীপ করে আন্দাজে যতোটা বুঝলাম , তাতে মনে হচ্ছে এ এলাকাটা আমাদের মতো ছা পোষা পরিবারের শপিংয়ের জন্য এক্কেবারে যথোপযুক্ত জায়গা। এখানে কমদামি জিনিষপত্রও যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি আছে এখানটায় যাকে বলে মোটামুটি উচ্চ দামের মধ্যবিত্ত ব্র্যান্ডের পশরাও। তবে অবশ্যই এই এলাকার দোকানগুলো ঐ অ্যাপেলস্টোর এলাকার শপগুলোর মতো আকাশচুম্বি দামের বিশ্বের সব খানবাহাদুর রায়বাহাদুর লাট বেলাট ব্র্যান্ডের নয়। বেইজিং সম্পর্কে তেমন না জেনে অনলাইনে হোটেল বুক করেছিলাম যখন, সিদ্ধান্ত তো মোটামুটি ভালই হয়েছে দেখছি। এ কৃতিত্বের দাবীদার অবশ্য অফিসে আমার সার্বক্ষণিক সহযোগী সায়মাও। কারণ অনলাইন ঘেঁটে নানান হোটেলের রেইটিং দেখার সাথে, ঐ হোটেল সম্পর্কে নানান জন দু চার পাঁচ বাক্যে হোটেল আর তার আশপাশ সম্পর্কে যে সব মতামত লিখেছিল, ও সেগুলো গভীর মনোযোগে পড়ে আমাকে জানিয়েছিল। আচ্ছা এই এলাকাটার নাম যেন কী?
নামটা তো জানি। কারণ পড়েছি তো বেশ কয়েকবার, কিন্তু মনে করতে পারছি না। না বুঝতে পারছি আমার বাঙ্গাল মগজ এই চায়নিজ নামকে তার নিউরনের দেরাজে জমা রাখার সময় তা খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে রাখেনি। যেমন তেমন ভাবে ছুঁড়ে দিয়েছে ঐ দেরাজে, ফলে প্রয়োজনের সময় আর সেটিকে খুঁজে পাচ্ছে না এখন। এসব ভাবতে ভাবতে জ্যাকেটের নানান পকেট হাতড়ে হাতড়ে অবশেষে বুক পকেটে হাত দিতেই টের পেলাম আছে ওখানে কার্ড মতো কিছু একটা। সেই কার্ড পকেট থেকে বের করতে করতেই চট করেই মনে পড়ল, এ হল বেইজিং এর ডংচেং ডিসট্রিক্ট এলাকা।
একই সাথে মনে পড়ল ঢাকায় বসে হোটেল রুম রিজার্ভেশনের সময়ে এই ডং চেং ডিসট্রিক্ট নামটা পড়ার পর, প্রথমেই মনে হয়েছিল, আচ্ছা বেইজিং কি তাহলে চায়নার কোন প্রদেশ বা স্টেট নাকি? না হয় তার আবার ডিসট্রিক্ট থাকবে কেন? অতএব নিয়েছিলাম আজকালকার সর্বজ্ঞ সর্বজ্ঞানী না হলেও মুখস্থবিদ্যার অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক, গুগুল মামার সাহায্য। তাতেই বুঝেছিলাম চায়নিজ ডিসট্রিক্ট আর আমাদের ডিসট্রিক্টের ফারাকটা। এছাড়া জেনেছিলাম বেইজিং শহরের, এই ডং চেং ডিসট্রিক্টটি, আদি মানে আমাদের পুরান ঢাকার মতোই পুরান বেইজিং এর পূর্বাংশের অর্ধেক আর নতুন বেইজিং শহরের পূর্বাংশের অর্ধেক নিয়ে বিস্তৃত । তিয়েন আন মেন স্কয়ার , ফরবিডেন সিটি, টেম্পল অব হেভেন এসবই এই ডিসট্রিক্টের অন্তুভুক্ত। টুরিস্টের আনাগোনাও তাই এখনাটায় বেশী। ফলে এই এলাকায় শপিং মলও যে বেশী থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক। এসব ভাবতে ভাবতে গোটা এলাকাটা এই প্রথমবারের মতো বেশ মনোযোগের সাথে চোখজরীপ করা আপাতত শেষ হয়েছে ভেবে, সামনের দিকে এগোবার উদ্যোগ নিবো নিবো করতেই, নজরে এলো ঐ যে ঐ সরু রাস্তাটা । হ্যাঁ , এখন যেখনাটায় দাঁড়িয়ে আছি তার উল্টা দিকে মানে, এই চত্বরটার বা দিকের প্রায় শ তিনেক মিটার দূরের রাস্তাটা চোখে পড়লো এইমাত্রই। অথচ এটি তো সরাসরিই দেখতে পাওয়ার কথা পেছনে ফেলে আসা সেই ম্যাক স্টোর থেকে বেরুবার পর , যেখানে এ পর্যন্ত বারকয়েকই গিয়েছিলাম সপরিবারে খেতে। সে সব সময়ে অবশ্য ম্যাকস্টোর থেকে বেরিয়ে নাক বরাবর ঠিক উল্টা দিকে চত্বরটার ওপাশে একটা ঝলমলে শপিংমল যে আছে, সেটা কিন্তু চোখে পড়েছিল প্রতিবারই। দেখেছি মলটির বা পাশে দাঁড়ানো কিছুটা পুরাতন গোছের হলদেটে রঙ্গয়ের আরকেটা দালান যে আছে, সেটিও। কিন্তু নতুন আর পুরাতন এই দুই দালানের ফাঁক দিয়ে পেছনের দিকে চলে যাওয়া, সরু এই রাস্তাটা কেন জানি চোখে পড়েনি একবারও , পড়লো যা এখন ।
দেখছি ঐ এখন পথ দিয়ে পেছনের কোন অংশ থেকে বেরিয়ে আসছে দু চারজন , যাদের মধ্যে দুজনের চেহারার গড়নে আর চলনে বলনে এখান থেকেও মনে হচ্ছে যে তারা নিশ্চিত ইউরোপিয়ান বা আমেরিকান । যাক অবশেষে মিলল দেখা চায়নিজ রাজ্যে আমাদের ছাড়াও ভিনদেশী মানুষ দুজন ফের। ওদের দুজনের হাতেই দেখছি আকাশী রঙয়ের পলিথিনের শপিংব্যাগ। কথা বলতে বলতে এগুচ্ছে দুজন ম্যাকস্টোরের দিকে। আচ্ছা ওখানেও কি আছে নাকি আরও কোন শপিং করার জায়গা? তারা কি শপিং করে আসলো নাকি ওখান থেকে? একটু দেখে আসবো নাকি ঐ রাস্তা ধরে এগিয়ে গিয়ে কী আছে ওখানে?
একথা মনে হতেই সাথে সাথে মনের ভেতরে থেকে জোর নিষেধাজ্ঞা জারী হল। বলল সে, নাহ আর নয় দেরী। যা বোঝার দরকার ছিল, তা তো বোঝা হয়েই গেছে। ফিরে আসবে যখন, তখন যেও সবাইকে নিয়ে ঐ পথ ধরে । আপাতত হোম মিনিস্টারের উষ্মার মিটারকে আর উপরের দিকে চড়ার সুযোগ দিয়ে কপালে খারাবি ডেকে আনা উচিৎ হবে না। অতি বাস্তবএকথা। অতএব এ নিয়ে মনের দ্বিতীয়জন আর তর্ক না করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অতএব পা বাড়ালাম সামনের দিকে।
নাহ সামনে দেখতে পাচ্ছি না ওদের। অবশ্য এখান থেকে শ খানেক মিটার এগুলেই অনেকটা গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এখানকার দালানগুলোর একটা ফাঁকে এই চত্বর থেকে বেরিয়ে ফুটপাতে উঠার একটা পথ আছে। ওরা সম্ভবত আছে ঐ পথে। তাই চোখের সামনের দালানগুলোর আড়ালের জন্য দেখতে পাচ্ছি না ওদের। বুঝতে পারছি না, ওরা কি জোরে হেঁটে চলে গেল? নাকি আমিই অনেকক্ষণ ধরে চোখ জরীপ করছিলাম। নাহ ওসব আর ভাবাভাবি করে লাভ নাই, এগোই সামনে দ্রুত।
ঠিক দৌড়ে বা জগিং করে নয় অবশ্যই, তারপরও নিজের স্বাভাবিক গতির চেয়ে ঢের বেশী জোরে পা চালিয়ে , দুই দালানের ফাঁকের সেই রাস্তায় এসে ডান দিকে মোড় নিতেই চোখে পড়লো, এই রাস্তাটি যেখানে গিয়ে মিশেছে ফুটপাতের সাথে , সেখানটায় দাঁড়িয়ে আছে লাজু আর দীপ্র। কিন্তু হেলেন আর অভ্র গেল কোথায়? ওরা কি আবার ফুটপাতের কোন দোকানে টোকানে ঢুকল নাকি?
হাঁটা বাদ দিয়ে এবার জগিংয়ের ভঙ্গিতেই গতি বাড়িয়ে দ্রুত ওদের কাছে এসে, অভ্র আর হেলেনের হদিস জিজ্ঞেস করতেই,দীপ্র বলল-“ঐ যে ওরা দেখছ না? অভ্রর নাকি টয়লেট পেয়েছে তাই এন ওকে নিয়ে আগে আগে যাচ্ছে হোটেলের দিকে।’
দীপ্রর তর্জনী অনুসরণ করে বা দিকে চোখ যেতেই দেখা গেল দুজনকে। এরই মধ্যে প্রায় এক কি দেড়শ কি দুইশ মিটার সামনে এগিয়ে গেছে ওরা। হাঁটছেও দ্রুত দুজনেই। আমাদের এই ছোট পুত্রটির প্রাকৃতিক ঘর বিষয়ক পছন্দ অপছন্দ বেজায় চড়া। অতএব বুঝতেই পারছি ম্যাকস্টোরে টয়লেট থাকলেও এবং ওখানে আমরা কেউ কেউ তা ব্যবহার করলেও, ও সম্ভবত তা করেনি।
ঠিক আছে আমারও এগোই চল । তোমরাই বা আমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?
আমার এই প্রশ্নের উত্তরে, বেইজিংয়ের তীব্রহিমের চেয়েও হিমতর চোখে তাকাল লাজু , যার মুখোমুখি হতে আমাকে প্রায়ই। এ জীবনে নারীদের চোখের ভাষা পড়তে পারার ব্যাপারে চূড়ান্ত ব্যর্থ আমার ভেতরের স্বামী নামক জীবটি তার জীবনরক্ষার তুমুল তাগিদে বিবাহিত হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই, স্ত্রীর চোখের অন্তত এই ভাষাটি অনুবাদ করতে শিখে ফেলেছিল দ্রুত। তাতেই রক্ষা। এর অনুবাদ একটাই, তবে স্থান কাল পাত্র ভেদে এতে আমার জন্য নির্ধারিত বিশেষণটি বদলায় শুধু, আর তা হল-“হুম তোমার মতো অপগন্ড / আমড়া কাঠের ঢেঁকি / মিচকা শয়তান/ ইত্যাদি ইত্যাদি কে আস্কারা দেব, এমনই বোকা নাকি আমি ?”
এদিকে চোখের ঐ নিরব ভাষার সাথে যোগ হয়েছে এরই মধ্যে সরব গজ গজ “আমাদেরকে এই রকম ঠাণ্ডায় এভাবে দাঁড় করিয়ে রেখে, কী করছিলে তুমি এতোক্ষণ?”
ভাবলাম বলি তোমাদের তো অপেক্ষা করতে বলিনি। কিম্বা কই খুব বেশী তো দেরী করিনি। বা আরে বলেছিলাম না তোমাদের সুবিধার জন্যই তো দেখছিলাম একটু দাঁড়িয়ে সব শপিংমল গুলো। কিন্তু নাহ কথায় কথা বাড়ে। এ কথা অন্য আর কারো ক্ষেত্রে অবশ্য পালনিয় কোন আপ্তবাক্য হিসেবে আমি না নিলেও, স্ত্রীর ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম কিছু করি না পারতপক্ষে । করলাম না ব্যতিক্রম এক্ষনেও বেইজিং এর এই হিম ফুটপাতেও।
চুপচাপ হাঁটছি তিনজন বেশ দ্রুতই। টুকটাক চলছে লোকজন ফুটপাতে, পদব্রজে। তবে তার চেয়ে বেশী লোক দেখছি আছে ফুটপাত সংলগ্ন ছোট ছোট নানান রেস্টুরেন্ট আর চা কিম্বা কফি শপে। আজকের দিনটা যদিও শপিং ডে হিসেবে ঘোষণা করা হলেও , এই পর্যন্ত যা করেছি , তা তো হল ফুটপাত ভ্রমণ!
পাঁড় ভ্রামনিকরা কী মতামত জানি না। আমার কাছে কেন জানি মনে হয় যে কোন দেশে বা জায়গায় গেলে, ঐ জায়গাটিকে বোঝার জন্য জানার জন্য ফুটপাত ভ্রমণ মানে পদব্রজে হাঁটাহাঁটির বিকল্প নাই । গাইড ভাড়া করে কোন শহরের নানান দর্শনীয় জায়গা দেখার চেয়ে, ঢের ভাল জ্ঞান লাভ করা যায় হাঁটতে হাঁটতে দেখতে দেখেত , আর ট্যাঙিতে ওঠে ড্রাইভারদের সাথে বাৎচিত করে। নাহ তারা হয়তো বেশীরভাগ সময়েই তাদের শহরের ইতিহাস ভূগোল সম্পর্কে তেমন কোন জ্ঞানের কথা বলতে পারে না। ওরা যা বলতে পারে তা হল সমসাময়িক সময়ের শহরের যাপিত জীবনের হালচাল । বলে যা তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে। যার দাম অমূল্য এবং পাওয়া যায় তা বিনা পয়সায়। সে জায়গায় পয়সা খরচ করে নেয়া গাইডরা বলে নানান মুখরোচক চটকদার কাহিনী, অনেক সময়ই যার কোন সত্যতা থাকে না। অতএব ফুটপাত ভ্রমণলব্ধ জ্ঞানের বিকল্প নাই!
এই যেমন আজকের এই ফুটপাত ভ্রমণে যে দেখতে পেলাম , এখানেও আমাদের দেশের মতোই মানুষ মিষ্টি আলু পুড়িয়ে খায়। কিম্বা আছে এখানেও ইটালিয়ান সেলুন। মানে খোলা রাস্তায় চেয়ার, টুল বা ইট বিছিয়ে এখানেও যে ক্ষৌরকর্ম হয়, তা কি জানতাম নাকি? কিম্বা ঐ যে পাতাল স্টেশনের মুখে চায়নিজ দোতারা নাকি গিটার জাতীয় বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ভিক্ষা করা লোকটিকে যে দেখলাম, যাকে দেখে এমনকি অভ্রও তুমুল বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করেছিল, বেইজিং এর মতো বিশ্বের অন্যতম ধনী শহরে কী করে ওর ভাষায় এরকম একজন “হোমলেস” মানুষ থাকতে পারে ? আবার এই তীব্রহিমে একদম হাত পা হীন বিকলাঙ্গ একটা লোককে উদোম শরীরে কান্না করতে করতে ভিক্ষা করতে দেখে সবাইতো আমার হয়েছিলাম প্রবল মর্মাহত!
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।