তবে তারচেয়ে বড় ব্যাপার হল গত তিন চারদিনে বেইজিংয়ের যে অভিজ্ঞতা হলো, তাতে বুঝতে পারছি এখানকার তীব্র হিমের কারণে এই শহরকে এ সময়ে সুয্যিমামাও সম্ভবত এড়িয়ে চলেন সসভ্রমে। ফলে এই যে এখন প্রায় দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে ঘড়িতে, তার কোন চিহ্নও দেখতে পাচ্ছি না চারপাশে। সেই প্রথমদিনকার মতো আজো চারদিক ঢেকে রেখেছে ছাই রঙ্গয়ের ধোঁয়াশার চাদর। মধ্য দুপুরেও দেখছি চারদিকে সান্ধ্যআবহ। তবে হ্যাঁ ফুটপাতে লোকজনের চলাচল বেড়েছে দেখছি বেশ। ঐদিকে ফুটপাতের শেষ হবার পর, ডান দিকে যে চওড়া বুক চিতিয়ে একমুখী যে রাজপথ গড়িয়ে চলে গেছে সামনের দিকে কোথাও, তাতে সাই সাই করে যাচ্ছে নানান আকারের নানান জাতের গাড়ীসমূহ। এই সময়টায় সম্ভবত এদিকটায় ট্রাফিক জ্যামও লাগে না এ এলাকায়।
“বাবা, মা, এই যে দেখো, ঐখানে ছিল না ঐ লোকটা ? এখন কিন্তু নাই সে ? গেল কোথায় লোকটা ?”
সামনের দিক থেকে পিছু দৌড়ে আমাদের কাছে এসে বলা দীপ্রর এই কথায়, দেখতে পেলাম সম্ভাব্য যে জায়গাটিতে ঐ হাত পা হীন পঙ্গু লোকটি খালিগায়ে তার ঊর্ধ্বাঙ্গ অদ্ভুত রকমে ডানে বাঁয়ে নাড়িয়ে একটানা চিৎকার করে যে ভিক্ষা করছিল সকালে, যখন যাচ্ছিলাম আমরা এদিক দিয়ে, মনে হচ্ছে ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে হেলেন আর অভ্র।
জায়গাটার আশেপাশে নানান ধরনের অস্থায়ী হকারেরা তাদের পসরা নিয়ে এখনো বসে থাকলেও সেই লোকটি নেই। কে জানে কোথায় গেছে লোকটি ! হয়তো আজকের দিন চলার মতো যা টাকা দরকার, হয়ে গেছে তা তার এরই মধ্যে, তাই আর এই হিমে খালি গায়ে ভিক্ষা করা বাদ দিয়ে চলে গেছে সে ঘরে। কিম্বা হতে পারে গেছে সে অন্য কোথাও ভিক্ষা করতে। লাজু যদিও তাকে কিছু সাহায্য করতে চেয়েছিল, আমি কিন্তু চেয়েছিলাম ফাঁকতালে ঐ লোকটির একটি ছবি তুলতে। যদিও নিজের কাছেই আমার ঐ ছবি তোলার ব্যাপারটিকে প্রথম থেকে কেমন যেন নির্দয় একটা ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছিল, তারপরও তুলতাম ছবি ভেবে রেখেছিলাম। ঐ ছবি দিয়ে একদিকে যেমনি আমাদের দেশের চায়নাপ্রেমীদের থোতা মুখ ভোতা করা যাবে, তেমনি ঐ ছবি হবে আজকের পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতি যে তার সকল নাগরিকের জন্য নুন্যতম অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ তার একটা অকাট্য দলিল !
নাহ এখানে এখন আর অকারন সময় ক্ষেপণ করার কোন মানে নাই। এগুনো যাক সামনের দিকেই। এগিয়ে দেখি গিয়ে ঐ যে লাল বাজারটি বসেছে ফুটপাতে, তার পাশে যে মল আছে ঐখানে পাওয়া যায় কি না, কোন ভ্যান। না হয় ফের হেঁটে চলে যাবো সামনের সেই মেট্রো স্টেশনে। তাতে সদলবলে সবাই বরং নিতে পারবো বেইজিঙয়ের মেট্রো চড়ার অভিজ্ঞতা। অতএব ফের হাঁটা শুরু করার জন্য সবাইকে চাঙ্গা করার মানসে, দলের নাকের সামনে ঐ মেট্রো চড়ার মূলা ঝুলিয়ে চালালাম জোর কদম সামনে।
জানি না, চেনা পথে হাঁটলে রাস্তা দ্রুত ফুরায়, এমন কোন নিয়ম আছে কী না। তা সে নিয়ম থাকুক আর না থাকুক, তাতে কিছু যায় আসে না। আশার কথা হল বেশ দ্রুতই চলে এলাম ফুটপাতের সেই লাল বাজারে। এরই মধ্যে বেশ ক্রেতা সমাগম হয়েছে এখানে। আসন্ন চায়নিজ নতুন বান্দর বছরকে কেন্দ্র করে চলছে এখন দেখছি ধুন্দুমার বেচাকেনা। জিজ্ঞেস করলাম লাজু আর হেলেনকে, থামতে চায় কি না ওরা এখানে। সকালে এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় ওদেরকে কেনাকাটা করতে বলে, পিতাপুত্র তিনজন মূল মলে পেটশপ খোঁজার জন্য ঢুকে যাওয়াতে, ভাষা বিভ্রাটের সাথে এখানকার বিক্রয়কন্যাদের দুই বঙ্গনারীর প্রতি তাদের স্বভাবগত নিরাসক্তভাব যুক্ত হওয়া, কেনাকাটা তো করেই নি ওরা, বরং হয়েছিল তুমুল বিরক্ত। যদিও কেনার মতো কিছু জিনিষ তাদের পছন্দ হয়েছিল বলেই জানি।
কিন্তু নাহ, দুজনেই দেখছি সমস্বরে নাকচ করে দিল ব্যাপারটা। অতএব না থেমে বজায় রাখলাম সম্মুখ হ্নটন। ভেতরে ভেতরে তুমুল আশংকা মনে, এই বুঝি কেউ বেঁকে বসলো হাঁটার ব্যাপারে। কিন্তু কী যে করি ? এদিকটার কোথাও ট্যাক্সি স্ট্যান্ড জাতীয় কিছু দেখছি না। আবার ট্যাক্সি পেলেও তো কাজ হবে না,কারন ঐ যে এক ট্যাক্সিতে এখানে তিন জনের বেশী উঠা যায় না। আমাদের চায়না ভ্রমণের এই একদম শেষ দিকে এসে ভাগাভাগি করে দুই ট্যাঙি তো উঠে, নিজেরা নিজেদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে পড়তে চাই না উটকো ঝামেলায়। তীরে এসে তরি ডোবানোর কোন মানে তো নাই।
“আচ্ছা বাবা, এখানে কি গুগুল ঠিক মতো কাজ করে না নাকি ?”
জ্যাকেটের বা দিকের পেছনের অংশ আঁকড়ে ধরে পেছন থেকে এগিয়ে এসে পাশে হাঁটতে হাঁটতে ফিস ফিস করে বলা অভ্রর এ প্রশ্নে মনে পড়লো, হায়রে দলের বাকি সবার মনে নিজেদের জন্য কেনাকাঁটা করার ব্যাপারটি থাকলেও, আমাদের এই ছোটপুত্রটির মনে ঘুরছে এখনো দেশে ফেলে আসা তার পোষা কুকুরের জন্য খেলনা কেনার ভাবনাটি। যার কারনে সেই গতরাত থেকে শুরু করে আজ সকাল পর্যন্ত গুগুল ঘেঁটে বের করেছিল এখনাকার সম্ভাব্য পেটশপের ঠিকানা। সে মোতাবেক সকাল থেকেই যে আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম তা, ও সেটা ভাল করেই জানে। এতক্ষণ সে চুপচাপ থাকলেও, এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে সবাইকে এরকম অনর্থক খাটিয়ে বেড়ানোর ব্যাপারে ভুগছে ও মনোবেদনায়। ওকে তাই জড়িয়ে ধরে বললাম
হ্যাঁ বাবা, চায়নায় আসলে ইন্টারনেট গুগুল এসব চলে এখানকার চায়নিজ নিয়মে। অসুবিধা নাই, হোটেলের কাছের যে মার্কেটগুলো আছে ওখানে কোন পেটশপ না পাওয়া গেলেও, কোন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে প্লুটোর জন্য খাবার কিনে নেব। চল যাই ঐ মেট্রোস্টেশনে এখন বলতে বলতে সেই ভূগর্ভস্থ মেট্রোস্টেশনের সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়াতেই দেখি, ঐ লোকটি আছে এখনো। মানে সকালে এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় প্রথম দেখেছিলাম যে লোকটিকে, সেই লোকটি। আছে সে এখনো বাদ্যযন্ত্র হাতে নিয়ে নীচে নামার সিঁড়ি মাঝামাঝি অংশে বসে। একে দেখেই অভ্র তুমুল অবাক হয়েছিল, ফেরারি লাম্বারঘুনির শহরে ওর ভাষায় একজন হোমলেস মানুষের দেখা পেয়ে !
এবার আর দেরী না করে হাতফোন বের করে ঝটপট ছবি তুলতে তুলতে নীচের দিকে নামতে শুরু করতেই লাজু বলে উঠলো– “দেখো এই আন্ডারগ্রাউন্ডে ঢুকে আবার পথ না হারিয়ে ফেল। মনে নাই যেমন হয়েছিল তিয়েন আন মেনে।”
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণসাহিত্যিক।