(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ছুটছিল আমাদের গাড়ি। সেভেন সিটার চীনা গাড়িটি বেশ নতুন। ড্রাইভারও অভিজ্ঞ। কাউকে পাশে রেখে, কাউকে পেছনে ফেলে বা কাউকে ডান দিকে রেখে ছলকে ছলকে চলছিল আমাদের বাহন। ছয় লেনের বিশাল রাস্তা। বিশাল মানে এখানেও বিশাল। রাস্তাটি ফুটবল খেলার মাঠের মতো প্রশস্ত। মাঝখানে ফুলে ফুলে ঢাকা ডিভাইডার। ও হ্যাঁ, চীনের শেনজেনের রাস্তাটি আসলেই যেনো একটি ফুলের বাগান। গুয়াংজু-শেনজেন মহাসড়কের দু’পাশ ঢেকে আছে ফুলে। রকমারি ফুল। কত রঙের এবং ঢঙের ফুল যে রাস্তার পাশে শোভা পাচ্ছে!
শুধু কী ফুল! কত ধরনের স্থাপনা যে দেখা যাচ্ছে চারদিকে। এক একটি ভবন যেনো আকাশ ফুটো করবে। কত ডিজাইন যে ছড়িয়ে রয়েছে এক একটি সুউচ্চ ভবনে! নান্দনিকতার ষোলকলা পূর্ণ করতে যা যা করা দরকার তার সবই যেনো চীনের শেনজেনের রাস্তা থেকে দেখা যাচ্ছিল।
শেনজেন চীনের একটি সীমান্ত শহর। চীনের এই সমৃদ্ধ শহরটির পাশেই হংকং। বাস ট্রেন এবং নৌ যোগাযোগ রয়েছে দেশ দুইটির মধ্যে। হংকং এবং চীনের সাথে শত্রুতা থাকলেও দু’দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে তার কোন রেশ বা জের নেই। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ চীন-হংকং যাতায়ত করেন। আমার বন্ধু ইউছুপ আলী ভাইও হংকং এর নাগরিক। অথচ তিনি ইচ্ছে করলেই ট্রেনে চড়ে গুয়াংজু কিংবা চীনের যে কোন স্থানে যেতে পারেন।
শহরের যত কাছাকাছি পৌঁছছিলাম ততই আমার মুখের হা বড় হচ্ছিল। চীন উন্নত, বিশাল এদের অর্থনীতি, দেড়শ’ কোটি মানুষের দেশ এসব কোনটিই অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু একটি সীমান্ত শহর এত উন্নত হবে! কথাটি বলতে ইউছুপ আলী ভাই লুফে নিলেন। বললেন, শেনজেন সম্পর্কে তো কিছু জানেন বলে মনে হচ্ছে না। আমি মাথা নাড়লাম, সত্যিই কিছু জানি না।
ইউছুপ আলী ভাই নিজের অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে বসলেন। বললেন, শেনজেনকে আপনি কুমিল্লা ভেবেছেন মনে হয়! কিন্তু বাস্তবে এটা চীনের রাজধানী বেইজিং এর মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর। কখনো কখনো এটিকে রাজধানীর চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। শেনজেন একটি মেগাসিটি। দুই কোটিরও বেশি মানুষ বসবাস করে এই শহরে । শুধু বসবাসই নয়, উন্নত জীবনধারণের মাধ্যমে বসবাস করে। শেনজেনকে চীনের ‘সিলিকন ভ্যালি’ বলা হয়। এটিকে আদর করে স্মার্ট সিটি, মেগাসিটি, হাইটেক সিটিসহ নানা নামেও অভিহিত করা হয়।
আমার চোখ মুখ একই সাথে যেনো কপালের দিকে উঠছিল। শেনজেনে এত কিছু! তাহলে এই শহর না দেখে চলে যাচ্ছিলাম কেন!
ইউছুপ আলী ভাই হাসলেন। বললেন, এজন্যই তো আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি। নাহয় আমি তো গুয়াংজু থেকেও ট্রেনে চড়তে পারতাম। এখান থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে আমাদের হংকং এর স্টেশন। আধা ঘন্টার মধ্যে আমি পৌঁছে যাবো। পরে ওখান থেকে বাসায় পৌঁছতে হয়তো আর আধাঘন্টা লাগবে। আপানারা গুয়াংজু ফেরার আগেই আমি হংকং এর বাসায় গিয়ে ঘুমাবো।
শেনজেন থেকে হংকং দূরত্ব আকাশপথে মাত্র ২৯ কিলোমিটার, সড়কপথে ৪৫ কিলোমিটার! ট্রেনে ৪০ কিলোমিটার। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ হংকং থেকে শেনজেন আসা যাওয়া করে।
ইউছুপ আলী ভাইর কাছ থেকে শেনজেনের বর্ণনা শুনার পর নিজ থেকে একটু খোঁজ খবর নিলাম। নেট দুনিয়ায় ঘুরে যা জানা গেল তাতে মনে হলো ইউছুপ ভাই কমই বলেছেন। এটিই নাকি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যক আকাশচুম্বী ভবনওয়ালা শহর! বলে কি! এজন্যই তো আকাশ ফুটো করতে চাওয়া শত শত ভবন উপরের দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আরো কাহিনী আছে। বলছি সব। বছর কয়েক আগেও শেনজেন চীনের গোয়াংডং প্রদেশের একটি অবহেলিত টাইপের মফস্বল শহর ছিল। ইউছুপ আলী ভাই যা বললেন, সরকারের বিশেষ উদ্যোগ, পৃষ্ঠপোষকতা এবং নেতৃত্বের গুণে মাত্র বছর কয়েকের মধ্যে শেনজেন পৃথিবীর সেরা শহরগুলোর একটি হয়ে উঠে। শেনজেনের উত্থান যেনো চোখের সামনে বলে মন্তব্য করে ইউছুপ আলী ভাই বললেন, আশির দশকের গোড়ার দিকে শুরু হয় এই শহরটির অগ্রযাত্রা। এরপর থেকে প্রতিদিনই শহরটির চেহারা পাল্টে গেছে, সমৃদ্ধ হয়েছে। ইউছুপ আলী ভাই বলেন, হংকং ছিল এই অঞ্চলের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল। চীন হংকং এর সাথে নানাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছিল। এক পর্যায়ে সরকার হংকং এর জয়জয়কার ঠেকানোর পাশাপাশি নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ একটি অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় হংকং এর অদূরে সীমান্তবর্তী শেনজেনে চীন প্রথম বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে। আর এর পর থেকে এই অঞ্চলে দলে দলে আসতে থাকেন নানাদেশের বিনিয়োগকারী। তারা প্রচুর বিনিয়োগ করতে থাকেন এখানে। দেশি বিদেশী বিনিয়োগে শেনজেন টেক্কা দিতে থাকে হংকং কে। মাত্র বছর কয়েকের ব্যবধানে এসে শেনজেন হংকং কে ছাড়িয়ে গেছে। একই সাথে বহু পেছনে ফেলে দিয়েছে নিজের প্রতিবেশী গুয়াংজুকে। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দশটি শহরের মধ্যে একটি শেনজেন! এই শহরে বিশ্বের পঞ্চম সর্বোচ্চ সংখ্যক বিলয়নিয়ার বসবাস করেন। একটি শহরের এত দ্রুত বিকাশ এবং সমৃদ্ধ হয়ে উঠার মুলমন্ত্রকে চীন সরকার উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তাই শেনজেনকে অন্যান্য শহরের জন্য রোল মডেল হিসেবেও সরকার ঘোষণা করে।
চীনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর একটি হচ্ছে এই শেনজেন। হংকং সীমান্তে অবস্থিত এই শহরটি চীনের চতুর্থ বৃহত্তম জনবহুল শহর। তথ্য প্রযুক্তি, গবেষণা, উৎপাদন, ব্যবসা, পর্যটনসহ বিভিন্ন কারনে বিশ্বের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর। শিপিং বাণিজ্যের নানা খবরাখবর নিয়ে বহুদিন ধরে লেখালেখি করলেও সেনজেন যে বিশ্বের চতুর্থ ব্যস্ততম কন্টেনার পোর্ট সেটি আমার জানা ছিল না। এই তথ্যটি দেখার সাথে সাথে আমার শরীরের লোমকূপগুলো যেনো খাড়া হয়ে গেল। পর্যটন নির্দেশিকা ‘লোনলি প্ল্যানেট’ শেনজেনকে ২০১৯ সালের বিশ্বের পরিদর্শনযোগ্য ১০টি সেরা শহরের মধ্যে ২য় স্থান দান করেছে শেনজেনকে। অথচ আমি জানতামই না যে ইউছুপ আলী ভাইর ঘরের পাশে এমন একটি দর্শনযোগ্য শহর রয়েছে! এত সমৃদ্ধ একটি শহর না দেখে ফিরে যাচ্ছিলাম!!
মজার ব্যাপার হচ্ছে মাত্র ত্রিশ বছরে এই শহরের জনসংখ্যা এবং অর্থনীতি এমন একটি পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যা চীনের নীতি নির্ধারকদেরও কল্পনার বাইরে ছিল। বর্তমানে এই শহরটি তথ্যপ্রযুক্তি এবং বিশ্ব অর্থনীতির অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। গ্লোবালাইজেশন এবং ওয়ার্ল্ড সিটি রিসার্চ নেটওয়ার্ক শেনজেনকে একটি গ্লোবাল ফার্স্ট-টায়ার বা আলফা শহর হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
যাক, ছুটছিল আমাদের গাড়ি। আমাকে শহর দেখানোর জন্য এখানে ওখানে অনাহুত ঘোরাঘুরি চলছিল। আমি মনে মনে ইউছুপ আলী ভাইকে আবারো ধন্যবাদ দিলাম। এমন একটি অচিন শহর দেখার সুযোগ পাওয়ায় মনটি ভরে যাচ্ছিল। অনেকক্ষণ ধরে আমরা ঘুরলাম। ইউছুপ ভাইর ট্রেনের সময় হওয়ায় এক সময় আমাদেরকে স্টেশনে পৌঁছাতে হলো। এখান থেকেই ইউছুপ ভাই হংকং এর ট্রেনে চড়বেন এবং আধাঘন্টার মধ্যে হংকং চলে যাবেন। এটি কাওলুন-ক্যান্টন রেলপথের শেষ স্টেশন। এরপর আর চীন নেই। যদি হংকংকেও চীনের অংশ হিসেবে দাবি করা হয়।
ইউছুপ আলী ভাই এবং ভাবীকে স্টেশনে নামিয়ে একটি নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। এরপর আর যাত্রী ছাড়া কারো যাওয়ার সুযোগ নেই। আমরা যেহেতু যাত্রী নই এবং পাসপোর্ট ভিসাও হংকং পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ নেই তাই স্টেশনের নির্দিষ্ট স্থানটি থেকে পিছু হটতে হলো। ইউছুপ ভাই চলে যাচ্ছিলেন, বার বার ফিরে দেখছিলেন পেছনে, আমাকে। হাত নাড়ছিলেন।
চীন এবং হংকং সীমান্তে কাঁটা তারের বেড়া। ইচ্ছে করলেও সেই বেড়া ডিঙ্গানোর সুযোগ নেই। কেউ ডিঙ্গায়ও না। এটি এমন এক সীমান্ত যেখানে কোন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে, আছে প্রতিহিংসাও। তবে কোন খুনোখুনি নেই। প্রতিদিনই দেশ দুইটির হাজার হাজার মানুষ এই সীমান্ত অতিক্রম করে। তারা সম্মান নিয়ে করে এপাড়-ওপাড়। সম্মান পাওয়ারও বুঝি কপাল লাগে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।