(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ছুটছে আমাদের গাড়ি। বিপুল গতিতে যেন উড়ে উড়ে যাচ্ছে ছোট্ট গাড়িটি। দিল্লী থেকে আগ্রার পথে ছুটছি আমরা। আগ্রা যাওয়ার আরো পথ আছে। তবে ওসব রোডে দূরত্ব বেশি, গাড়িও বেশি। টোলের টাকা বাঁচানোর জন্য বহু মানুষই ওই রাস্তা ব্যবহার করেন। বাসসহ লোকাল পরিবহনও ওসব রাস্তায় গিজগিজ করে। আবার স্বল্প দূরত্বের নানা বাহনও চলাচল করে রাস্তাগুলোতে। ওসব রাস্তা ধরে দিল্লী থেকে আগ্রা যেতে পাড়ি দিতে হয় প্রায় তিনশ’ কিলোমিটার পথ। রাস্তাগুলোও সরু। বিভিন্ন পয়েন্টে যানজটও লেগে থাকে। অপরদিকে এঙপ্রেসওয়ে দূরত্ব অনেক কম, ১৭০ কিলোমিটারের মতো। তেমন কোন বাঁক নেই। আঁকাবাকা সব পথই সোজা করে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। ধূ ধূ মাঠের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তাটি একেবারে সোজা করে নির্মিত হয়েছে। বিভিন্ন জনপদে তৈরি করা হয়েছে বাইপাস। এতে এঙপ্রেসওয়ে জুড়ে শুধু ঝড় উঠে, গতির ঝড়। টোল পরিশোধ করতে হলেও দূরপাল্লার অধিকাংশ গাড়িই মুলতঃ এই টোল রোড ব্যবহার করে। আমাদের চালকই দিল্লী আগ্রার রাস্তা সম্পর্কে এসব তথ্য জানাচ্ছিলেন। গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে তিনি বেশ গল্পও করছিলেন আমাদের সাথে। রেস্টুরেন্ট থেকে চা খেয়ে পুনরায় যাত্রা করেছি আমরা। আবারো গল্প হচ্ছে। হচ্ছে লো ভলিউমে হিন্দি গান। কথায় গল্পে এগিয়ে চলছিলাম আমরা।
আমাদের গাড়ি ছুটছিল। একেবারে আচমকা ড্রাইভার বললেন, তাজ দেখুন। তাজমহলকে আদর করে ‘তাজ’ ডাকা হয়। গতবারও আমি বহু মানুষের মুখে ‘তাজ’ কথাটি শুনেছি। এবারও ড্রাইভারের মুখ থেকে কথাটি শুনলাম। ড্রাইভার আমাদের তাজমহলের মিনার দেখালেন। তাজমহলের চার কোনায় চারটি মিনার রয়েছে। ১৩০ ফুটেরও বেশি উচ্চতার মিনারগুলো বহুদূর থেকে দেখা যায়। যমুনা এঙপ্রেসওয়ের ঠিক কোন জায়গা থেকে মিনারগুলো দেখা যায় তা প্রত্যেক টেঙি চালকই জানেন। আমাদের যেভাবে দেখানো হয়েছে এভাবে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষকে তাজ দেখানো হয়। প্রথম তাজমহল দেখার অনুভূতি অন্যরকম। বাসররাতে প্রিয়তমা স্ত্রীর চোখে চোখ রাখার মতো রোমাঞ্চিত হন অনেকেই। প্রথম যেবার তাজমহল দেখতে এসেছিলাম সেবার আমার ভিতরে বাইরে অন্যরকমের এক অনুভূতি কাজ করেছিল। সূর্যের আলোতে চকচক করা তাজের সাদা মার্বেল আমার শরীর-মন কি পরিমান উতলা করেছিল তা ভাবলে আজো শিহরিত হই। আমার সেই শিহরণ লিখে বুঝানোর সাধ্যি আমার নেই। বিশ্বের প্রেমের এবং ভালোবাসার প্রতীক হয়ে উঠা তাজের মতো একটি অনন্য স্থাপনা চোখের সামনে! আমার ভিতরটি কেমন যেন করছিল!
ছুটছিল আমাদের গাড়ি। তাজের দিকে দ্রুত এগুচ্ছি আমরা। ক্রমে তাজের মিনার স্পষ্ট হচ্ছিল। নিজেকে মেলে ধরছিল। তাজমহলের গম্ভুজ দেখা যাচ্ছিল। দেখা যাচ্ছিল তাজের বিভিন্ন অংশ। আমাদের ট্যুর অপারেটর লায়ন আনোয়ারুল আজীম ভাইয়ের দেয়া নম্বরে গাইডকে ফোন করলাম। আমরা কাছাকাছি চলে আসার খবর জানিয়ে উনাকে কোনদিকে পাবো জানতে চাইলাম। উনি রেডিসন হোটেলের সামনে থাকবেন বলে জানালেন। চালকের সাথেও তিনি কথা বললেন। আগ্রা শহরে বেশ কয়েকটি ফাইভ স্টার হোটেলসহ অসংখ্য আবাসিক হোটেল রয়েছে। বিভিন্ন মানের হোটেল। এককালের মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী আগ্রা বর্তমানে একটি ট্যুরিস্ট স্পর্টকে ঘিরে কী করে যে প্রতিদিনই জনারণ্যে পরিণত হয় তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। তাজমহল কিংবা আগ্রা ফোর্টকে কেন্দ্র করে দিল্লী শহরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। রাজধানী হিসেবে জৌলুশ হারালেও পৃথিবীর সেরা একটি ট্যুরিস্ট স্পর্ট হিসেবে আগ্রা জৌলুশ ছড়াচ্ছে।
হোটেল রেডিসনের সামনে আগে থেকেই দাঁড়ানো ছিলেন আমাদের গাইড। তিনি গাড়ির ফ্রন্ট সিটে উঠে বসলেন এবং গদগদ হয়ে আমাদের স্বাগত জানালেন। মাঝবয়সী ভদ্রলোক বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাজ, ফোর্ট এবং ফতেহপুর সিক্রি এলাকায় গাইডের কাজ করেন বলে জানালেন। তিনি বললেন, সবই আমার নখদর্পণে। আমার মতো করে আমি বলবো, আপনাদের বাড়তি কিছু জানার থাকলে প্রশ্ন করবেন। আমি যতটুকু জানি আপনাদের জানানোর চেষ্টা করবো। ছবি তোলার পয়েন্টগুলোও আমি চিনি। আপনাদের প্রয়োজনীয় ছবি আমি তুলে দেবো। আপনাদের নিজেদের পছন্দের কোন জায়গা থাকলেও বলবেন। ছবি তুলে দেবো। ক্যামেরাম্যানও ভাড়া পাওয়া যায়। আপনারা ইচ্ছে করলে নিতে পারেন। তবে না নিলেও অসুবিধা হবে না। আমি ভালো ছবি তুলি বলে তিনি হাসলেন। তিনি আমার ফোনের মডেল এবং ক্যামেরার ধরণটাও মোটামুটি জেনে নিলেন। বললেন, ছবি ভালো হবে।
আমাদের গাইড তাজমহলের গেটে গিয়ে পকেট থেকে আইডি কার্ড বের করে গলায় ঝুলালেন। নিজের টিকেট লাগবে না। এই কার্ডই উনার ভিতরে ঢোকার প্রবেশপত্র। তিনি আমাদের টিকেট নেয়ার জন্য টাকা চাইলেন। আমরা বিদেশী হিসেবে টিকেট নেবো, নাকি পশ্চিম বাংলার মানুষের নামে টিকেট নেবো জানতে চাইলেন তিনি। আমি পাসপোর্ট এগিয়ে দিয়ে ‘ফরেনার’ হিসেবে টিকেট নেয়ার জন্য টাকা দিলাম। বিদেশীদের জন্য এখানে টিকেটের দাম অনেক। অনেক মানে অনেক। ভারতীয়দের জন্য তাজমহলের টিকেট ৪০ রুপী থেকে বাড়িয়ে ৫০ রুপী করা হয়েছে। আগে এক টিকেট কেটেই পুরো তাজমহল থেকে শুরু করে সম্রাট শাহজাহান এবং মমতাজের সমাধিও ঘুরে দেখা যেতো। এখন নাকি নতুন নিয়ম করে দেয়া হয়েছে। সমাধি দেখতে হলে ভারতীয়দেরই বাড়তি দুইশ’ রুপী দিয়ে আলাদা টিকেট করতে হবে। আর বিদেশীদের ক্ষেত্রে প্রতিজনকে গুনতে হবে ১২৫০ রুপী। সার্কভুক্ত দেশসমূহের নাগরিকদের জন্য টিকেটের দাম আগেকার ৫৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭৪০ টাকা। আমরা সার্কভুক্ত দেশের নাগরিক হিসেবে কিছুটা বাড়তি সুবিধা পেলাম। আগেরবার আমি বিদেশী হিসেবেই টিকেট করেছিলাম। তাজমহলে পর্যটকের চাপ কমাতেই টিকেটের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলেও গাইড জানালেন। তিনি বললেন, দৈনিক ত্রিশ হাজার টিকেট বিক্রি করা হয়। এর বাইরে কোন টিকেট বিক্রি করা হচ্ছে না। ত্রিশ হাজারের পরে বহু লোককে তাজ না দেখেই ফেরত যেতে হয় অথবা রাতে হোটেলে থেকে পরদিন সকালে এসে আবারো লাইন ধরতে হয়। বলে কি! আমরা ত্রিশ হাজারের বাইরে পড়িনিতো! গাইডকে দ্রুত গিয়ে সার্কভুক্ত দেশের নাগরিক হিসেবে টিকেট কাটতে অনুরোধ করলাম। এই ধরনের টিকেটের বাড়তি সুবিধা হচ্ছে আলাদা লাইনে ভিতরে ঢোকা যায়, হাজার হাজার মানুষের পেছনে পড়তে হয়না। মোটামুটি দ্রুতই গেট পার হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। আর তাড়াতাড়ি ভিতরে ঢুকতে পারলে দেখার সময় ও পরিধিও বৃদ্ধি পায়।
আমাদের গাইড বেশ স্মার্ট, চটপটে। বেশ দ্রুতই তিনি ফিরলেন। হাতে টিকেট। দুটো টিকেট। প্রচুর লাইন কাউন্টারের সামনে। আর উনি টিকেট নিয়ে হাসিমুখে ফিরে আসলেন। সার্কভুক্ত দেশের নাগরিক হিসেবে বাড়তি দামে টিকেট কেনার প্রথম সুফল হাতে হাতে পেয়ে গেলাম। কয়েক হাজার মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেও আমরা টিকেট নিয়ে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছি। কিছুটা ভিআইপি মর্যাদাও। তবে এই ভিআইপি মর্যাদার ব্যাপারটি আমার কাছে ফেলো কড়ি মাখো তেল বলে মনে হচ্ছিল। এর সাথে ব্যক্তির কোন গুরুত্ব নেই, বাড়তি দামে টিকেট কেনার সুফল আছে। আমাদেরকে ভিতরে ঢোকার জন্য লাইন ধরতে হলো না। কোন ধরনের জটলায় না গিয়ে আমরা ভিতরে ঢোকার পথে গেলাম। আমাদের পুরো শরীর স্কেনিং করা হলো। মেটাল ডিটেকটর দিয়েও চেক করা হলো। আমার স্ত্রীকে ঘের দেয়া একটি স্থানে নিয়ে গিয়েও চেক করা হলো। অতপর আমরা ভিতরে ঢোকার অনুমোদন পেলাম। প্রতিটি মানুষকে তল্লাশীর মুখোমুখি হয়ে ভিতরে ঢুকতে হচ্ছে। এজন্য বিরাট লাইন সাধারণ দর্শনার্থীদের ক্ষেত্রে। বাড়তি টাকা দিয়ে টিকেট কেনা ফরেনারদের এসব ঝামেলায় যেতে হয় না। তারা সরাসরি বডি স্ক্যানিং করিয়ে ভিতরে ঢোকার সুযোগ পাচ্ছে। অবশ্য বিদেশী বেড়ে গেলে সেখানে হালকা লাইন হচ্ছে। বিদেশী কম হওয়ায় আমাদের কোন লাইন ধরতে হলো না। গাইড সাহেব আমাদের পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিলেন। তাজমহলের প্রধান গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। আহা, এই গেট পার হতে একদিন কত লোককেই কত কাঠখড় পোড়াতে হতো! সময় কী করে সবকিছু পাল্টে দিল, বদলে দিল! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।