মানুষ সামাজিক জীব বলে সমাজ ছাড়া সে চলতে পারে না, একথা শৈশবের শিক্ষা থেকে জেনে এসেছি এবং মেনে চলছি। আমাদের চারপাশে যা আছে, তা নিয়েই আমাদের পরিবেশ, পরিবেশের মাঝেই মানুষের বিচরণ তা সে সামাজিক হোক কিংবা প্রাকৃতিক। তবে পরিবেশের নির্মলতা, সমাজের পঙ্কিলতা স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আশরাফুল মাখলুকাতের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
যাপিত জীবনের সামপ্রতিক চিত্র-হোক লোডশেডিং, হোক রান্নায় গ্যাস ঘাটতি, তবু যতক্ষণ গৃহে অবস্থান করা যায়, ততক্ষণই যেন প্রশান্তি। বাইরে বেরুনো মাত্র দুশ্চিন্তার একটুকরো ভাঁজ কপালে ফুটে ওঠে অজান্তেই। কারণ, প্রচণ্ড যানজট রাস্তাঘাটে, সামনে পেছনে রিকশা-বাস-টেম্পু-ট্রাক-প্রাইভেট কারের দাপুটে বিচরণ আর বিকট হর্নের প্রতিযোগিতায় কান ঝালাপালা। কার আগে কে যাবে এমন হযবরল অবস্থা, নাকাল ট্রাফিক ব্যবস্থায় ত্রাহি চিত্র! কিছুক্ষণ জ্যামে বসে থাকলেই কান ফেটে চৌচির নানারকম হর্নের অনবরত বিকট শব্দে, মানুষের চেঁচামেচিতে।
কিছুদিন আগে রাতে পতেঙ্গা থেকে ফেরার পথে পোর্ট ফেলে ক্রসিং এ জ্যামে পড়ে দুই ঘণ্টা আটকে কান ঝালাপালা, চারপাশে অজস্র বিশাল ট্যাংক-লরি-গাড়ি। সামনেই অদ্ভুত বিকট এক হর্নের শব্দের উৎস খেয়াল করতে গিয়ে দেখি, উৎসটিকে ট্রেনের ইঞ্জিনের মত লাগছে! ভাবলাম রাজপথে রাত দেড়টার সময় ট্রেনের ইঞ্জিন আসবে কোত্থেকে? তার হর্নের তীব্র আওয়াজে ভিড়মি খাওয়ার দশা সবার। কিন্তু না, ভীষণ বিরক্তিতে মশার কামড় খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম, সত্যিই ওটি ট্রেনের ইঞ্জিন, কারণ ওটার নীচে চিকন রেল লাইন, পোর্টের মালগাড়ি আর পেট্রোলের বগি টানার জন্যই এই ব্যবস্থা। এই ইঞ্জিনকে কোথাও সংযুক্ত করা হবে ওদিকে কোথাও।
অদ্ভুত! রাত দুটোর সময় শত শত ট্রাক লরি ও গাড়ির সাথে নাকাল যানজটে মেইন রোডে চলে এসেছে ট্রেনের ইঞ্জিনও! শব্দদূষণে, বায়ুদূষণে একাকার চারিদিক।
শহরের কোথাও এক টুকরো খালি জায়গা নেই, নেই দুদণ্ড শ্বাস ফেলার অবকাশ কারো, জীবনধারণের ব্যস্ততায় দমবন্ধ করা শ্বাস নিয়ে ছুটছে সবাই যাপিত জীবনের গতির সাথে তাল মিলিয়ে। শহর ছেড়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে যেতে চাইলে বিমানবন্দেরের পথে ও তেলের ডিপো, তেলের গন্ধ ভেসে বেড়ায় বিশাল এলাকা জুড়ে, শ্বাস নেওয়া দায়। দূর সাগরের নীলাকাশ ধীরে ধীরে ছেয়ে যাচ্ছে নোঙর ফেলা জাহাজের কালো ধোঁয়ায়, ইট ভাঁটার কালো দূষিত ধোঁয়ায়!
দূষণের লহরীতে যখন একাকার চারিদিক, বিশাল শতবর্ষী বৃক্ষ নিধন করে স্রষ্টা প্রদত্ত প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করার কাজে উঠে পড়ে লেগেছে এই মানব সমাজেরই একটা অংশ। মানব দূষণই বাকি থাকে কেন তবে আর? শিক্ষকতা এক মহান পেশা আর বিদ্যাপীঠ থেকেই শুরু সেই কাজ। কোমলমতি শিশু কিশোর তরুণ যুবক শিক্ষার্থীদের মগজ ধোলাই করছে প্রতিযোগী কুচক্রী লোভী কতিপয় শিক্ষক নামধারী অমানুষ, পরিণামে ছাত্রদের হাতেই লাঞ্ছিত আজ শিক্ষাগুরুরা।
ছাত্র রাজনীতির নামে তথাকথিত ক্ষমতা দেখানোর দাপটে উচ্ছৃংখল অবুঝ কিছু আমাদের সন্তানদের বেপরোয়া জীবন যাপনের পরিণাম সন্তানের হাতে মায়ের মৃত্যু, বাবার মৃত্যু, এমন অবিশ্বাস্য সব ঘটনায় পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। যেখানে স্তম্ভিত পুলিশ প্রশাসন বলছে আপনার সন্তানকে খেয়াল রাখুন। ভয়ংকর এক দূষণে আক্রান্ত আজ মানব সমাজ। মুখোশধারীদের সাময়িক বিজয়োল্লাস প্রমাণ করে কচি হৃদয়ের কোমলতা পেরিয়ে দূষণের ধোঁয়া ছড়িয়েছে দুর্নীতির নাড়ি পেঁচিয়ে সমাজের প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে, যা থেকে নিস্তার পাওয়া অসাধ্য প্রায়!
স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও এই আধুনিক ডিজিটাল উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ দূষণমুক্ত নয়। আমার স্বদেশে কোথায় নেই দূষণ? প্রশ্নটি প্রত্যেক সচেতন নাগরিকদের ভাবিয়ে তুলবে।
দুর্নীতি যেমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে, দূষণ তেমনি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে। লোভের লকলকে বিষাক্ত জিভের ছোবলে জর্জরিত এই দেশে সামান্য একজন এসএসসি পাস তরুণকে সাত হাজার টাকা বেতনের চাকুরির জন্য যদি পাঁচ লক্ষ টাকা মরি বাঁচি খেয়ে না খেয়ে যোগাড় করে চাকরি পোক্ত করতে হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তার জীবনের লক্ষ্য কী থাকবে তা সহজেই অনুমেয়। সেই চাকুরিতে সে মাসে সাত হাজার টাকার পরিবর্তে সাত লক্ষ টাকা আয়ের সুযোগ কখনোই হাতছাড়া করবে না। এভাবেই দূষণ ধীরে ধীরে দুর্নীতির সাথে মিশে যায়, মিশে গেছে আমাদের সামাজিক শৃঙ্খলে।
হাইব্রিড তোষামোদের সীমা লংঘন করে যাচ্ছে আমাদের পরিমিতি বোধ, আমাদের অহং বোধ, আমাদের সংযম ও সহনশীলতা। দুর্নীতি নির্মূল করার প্রচেষ্টা করা যায়, দূষণ তো রক্তে মিশে যায়! সবুজ তো আর সেই নির্মল সবুজ নেই, নীল সাগর আর নিরাপদ নেই, ভেসে আসছে অগণিত মৃত ডলফিন, জেলিফিশ! হালদা নদীতে মৃত মা মাছ! হাইব্রিড সারের অস্তিত্বে আর লোভনীয় সব বৈদেশিক চুক্তির পরিকল্পনায় পারিপার্শ্বিক সবকিছু যেমন বদলে গেছে, তেমনি দুর্নীতি ও দূষণ চক্রের চোরাবালিতে আটকে গেছি আমরা, স্বীকার করতেই হয় নিদারুণভাবে আমাদের চারপাশটা বদলে গেছে।
এই দূষণ সেই দূষণ যাতে আটকে গেছে গোটা দেশের স্লুইচ গেইট! পরিত্রাণের কি কোনো উপায় নেই ? সমাধান আছে তবে তাতে করে আমাদের আমূল পাল্টে ফেলতে হবে নিজেদের, শেকড় থেকে শিখর পর্যন্ত শুদ্ধতার পরিবর্তন আনতে হবে, অংশীদারিত্বের নীতি ও ভাগের নৈতিকতা বিসর্জন দিতে হবে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার একার পক্ষে কতটা সম্ভব যদি সচেতন না হয় প্রশাসন, ঐক্যবদ্ধ না হয় সাধারণ জনগণ, সংযত না হন আমলাতন্ত্র।
বৈশ্বিক পরিস্থিতির সাথে তাল মিলাতে গিয়ে দেশ এখন বেসামাল, আরো বেসামাল দায়িত্বরত দলীয় নেতা কর্মীদের অসংলগ্ন কথা ও আচরণে, বানোয়াট কারণে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে, বন্যায় ডুবে যাওয়া দেশের বড় একটা অংশ, করোনার যানজটে আটকে যাওয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিপর্যস্ত শিক্ষাজীবন ও আতংকিত অভিভাবক।
এমনই সহস্র অযুত সমস্যায় জর্জরিত যখন আমাদের প্রিয় জন্মভূমি, আমাদের প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের উচিত দূষণমুক্ত পরিবেশ ও সমাজ গড়তে, দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রকে দুর্নীতিমুক্ত করতে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত দুর্নীতি বিরোধী শুদ্ধি অভিযানে দল-মত নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করে অহংকারবোধ ও লোভ- লালসার খোলস ছেড়ে দেশকে প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাবলম্বী করে তলিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করা।
আমরা দূষণমুক্ত পরিবেশ চাই, বিশুদ্ধ সমাজ চাই, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য, দুর্নীতিমুক্ত স্বদেশ চাই আমরা প্রকৃতির বুকে নির্ভার হয়ে দুদণ্ড শ্বাস ফেলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গর্বিত বাংলাদেশ দেখবো বলে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক