সাত বছরের জান্নাত মাইমুন ও আড়াই বছরের সান বাবু। বাবা সোহেল রানার (৩৭) চেয়ে মা সুমিতা খাতুনের (২৭) সঙ্গে তাদের সময় কাটত বেশি। কারণ মা-ই তাদের ভালোবাসতেন বেশি। সেই মা সুমিতা খাতুনই তার আদরের দুই সন্তানকে হত্যা করেন এবং নিজেও নাইলনের দঁড়িতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন মোহাম্মদপুর এলাকার ইসমাইল কলোনির একটি ভবনে এ ঘটনা ঘটে। এসএস হাউজ নামের ৮ তলা বিল্ডিংয়ের ৪ তলার একটি ফ্ল্যাটে ওই দম্পতি ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকতেন।
পরে খবর পেয়ে গতকাল শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে ওই ফ্ল্যাটের মূল দরজা ও একটি বেডরুমের দরজা ভেঙে মা ও দুই শিশু সন্তানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এসময় মা ও জান্নাত মাইমুন ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় এবং আড়াই বছরের সান বাবুর নিথর দেহ খাটে শুয়া অবস্থায় পড়ে ছিল। পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে লাশ তিনটি ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের ধারণা, এটি হত্যাকাণ্ড নয়। পারিবারিক কলহের জেরে দুই সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেছেন মা।
পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহেদুল কবির গতকাল সন্ধায় আজাদীকে বলেন, এসএস হাউজের ওই ফ্ল্যাটের মূল দরজা ও বেডরুমের দরজা ভেঙেই মা ও দুই শিশু সন্তানের লাশ উদ্ধার করা হয়। সুমিতা খাতুন তার দুই শিশু সন্তানকে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করেছেন। এখন পর্যন্ত আমরা সেটিই পর্যবেক্ষণ করেছি। এরপরও আমরা সুমিতার স্বামী সোহেল রানাকে হেফাজতে নিয়েছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, যেহেতু সুমিতা খাতুন তার দুই সন্তানকে হত্যা করেছেন, আমরা তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দেব। আর সোহেল রানার বিরুদ্ধে সুমিতার পরিবার যদি আত্মহত্যার প্ররোচনা মামলা দেন সেটিও আমরা আমলে নিব। সুমিতার পরিবারের সদস্যরা এখনো এসে পৌঁছায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা সিরাজগঞ্জ থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। এসে পৌঁছাতে রাত ১২টা বাজতে পারে।
সোহেল রানাকে জিজ্ঞাসাবাদে কী জানতে পেরেছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, তিনি নেশা করতেন। সুমিতাকে হয়ত ঠিকমতো সময় দিতেন না। প্রায় তাদের মধ্যে ঝগড়া হত। নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে স্ত্রীকে তিনি ধমকাতেন। এমনকি বিয়ে বিচ্ছেদ করবে এমন কথাও তিনি সুমিতাকে শুনাতেন। তিনি বলেন, আপাত দৃষ্টিতে এটিকে হত্যাকাণ্ড মনে না হলেও আমরা তদন্ত করে যাব এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
এদিকে গতকাল ঘটনাস্থলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, থানা পুলিশের পাশাপাশি সিআইডি ও পিবিআইও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সুমিতার স্বামী সোহেল রানার ভাতিজা, বোন ও বোনের জামাই সেখানে ছিলেন। ঘটনার বিষয় জানতে পেরে তারা সেখানে ছুটে এসেছেন। সোহেল রানার বোন লিপি আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, সুমিতা ও সোহেল রানার মধ্যে তেমন কোনো বিষয়ে সমস্যা ছিল না। তারা সুখী ছিলেন। কী থেকে কী হয়ে গেল বুঝতে পারছি না। সোহেল রানার ভাতিজা নুরুল ইসলাম বলেন, রাত ৯টার দিকে কর্মক্ষেত্র থেকে চাচা ফিরে ঘরের দরজা বন্ধ পান। ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়াশব্দ মিলছিল না। চাচার ফোন পেয়ে মধ্যরাতে কয়েকজন বন্ধুসহ আমি ঘটনাস্থলে আসি। বাসার দারোয়ানসহ তখন অনেকে ছিল। সবাই মিলে ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না। শেষে বাধ্য হয়ে রাত ৩টার দিকে ৯৯৯ এ কল করে থানা পুলিশকে খবর দেয়া হয়। সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায়। সকাল ৭টার দিকে পুলিশ দরজা ভেঙে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে লাশ উদ্ধার করে।
ঘটনাস্থলে ভবনের দারোয়ান মো. খোরশেদ আলম, মো. ফোরকান এবং মালিক সিরাজুল হক কর্তৃক ভবনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আহমেদ রেজার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, তারা কিছু জানেন না। ঘটনার আগে পরে ওই দম্পতির ঘরে তারা অস্বাভাবিক কিছু দেখেননি।
সুমিতা ও সোহেল রানার ওই ফ্ল্যাটে ধোয়ামুছার কাজ করতেন পাশের একটি কলোনির বাসিন্দা জোসনা আক্তার। তিনি জানান, ১৫ দিন হচ্ছে তিনি এ বাসায় কাজ করছেন। কখনো তেমন কিছু চোখে পড়েনি। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে সময় কাটাতেন সুমিতা। তবে বৃহস্পতিবার তাকে কিছুটা বিষণ্ন দেখাচ্ছিল। অন্যদিন হাসি মুখে কথা বললেও সেদিন আমার সঙ্গে তেমন কোনো কথা বলেননি। বাসায় অবস্থানকালীন বেলা ১টার দিকে স্বামী সোহেল রানা ঘরে এসে কিছুক্ষণ থেকে আবার বেরিয়ে যান। এসময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি বলে জানান জোসনা আক্তার।
এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় পিবিআই চট্টমেট্রোর পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা বলেন, সুমিতা প্রথমে তার দুই সন্তানকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। পরে তিনিও আত্মহত্যা করেন। সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ধারালো নাইলনের দঁড়ি ব্যবহার করা হয়।
উল্লেখ্য, সোহেল রানা ও সুমিতা দুজনই সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা। ১০ বছর আগে তারা একে অপরকে পছন্দ করে বিয়ে করেন। পরে পরিবারও তা মেনে নেন। একপর্যায়ে সোহেল রানা সুমিতাকে চট্টগ্রাম নিয়ে আসেন। প্রথমে তারা নগরীর ইপিজেড এবং পরে মুরাদপুর এলাকায় বসবাস শুরু করেন। ঘটনাস্থলের ওই বাসায় আড়াই বছর আগে উঠেছিলেন। এর আগে পাশের অপর একটি ভবনে থাকতেন। সোহেল রানা নগরীর মুরাদপুর মোড়ে দ্রব্য শক্তি ইউনানি রিসার্চ সেন্টার নামের একটি ওষুধের দোকান পরিচালনা করেন।