–শোনো!
–হু বলো, চোখ তুলে তাকাই।
–তোমার বই কবে যেন আসবে মেলায়? হাতের আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে প্রশ্ন করে সে।
–জানি না, প্রথম দিন থেকেই থাকার কথা। যে কোনোদিন চলে আসবে।
–আচ্ছা, আসুক। যেদিনই আসুক প্রথম বইটি আমি নেব বুঝলা? হাসিমুখে তাকিয়েই থাকি।
–কী? হাসছ কেন? প্রথম বই আমি স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে নেব আর তুমি অটোগ্রাফ দিবা।
–আচ্ছা ঠিক আছে। আগে তো বই আসুক।
মাঝে মাঝেই আমাদের দেখা হলে সে একথা মন্ত্রী পরিষদের শপথ বাক্যের মতো রোজ বলে, আমি শুনি বা শুনি না। তবে হাসি।
বরাবরের মতো সেও বলে, ‘মানুষের হাসি এত অদ্ভুত সুন্দর হয় কি করে!’
একথা শুনে আমি নির্ধারিত পেগের চেয়ে বেশি পেগের হাসির মতো লুটিয়ে পড়ি। সে তখন বিড়বিড় করে বলে ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি’। মনে মনে বলি ‘একটা চার অক্ষরের শব্দ এত ক্ষমতা ধরে কি করে!’
আমাদের যাপিত কাজ, আমাদের দিবস–রাতি, আমাদের ব্যস্ততা, আমাদের একাকীত্বের টানাটানি সব সামলিয়ে আমরা দেখা করি, ফোনে কথা বলি আর টুকুরটুকুর মেসেজ চালাচালি করি।
ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন। লেখক, প্রকাশক, পাঠক– সকলের জন্য রমজানের ঈদের মতো আনন্দময়। সারামাস উপবাসের পর ঈদ আসে আনন্দের বন্যা নিয়ে। সারা বছরের পর লেখক, প্রকাশক, প্রচ্ছদশিল্পী, পাঠকের যেন এক মিলনমেলা বসে। ফোনে খোঁজ নিই,
–বই কি এসেছে?
একদিন, দুদিন, তিনদিন যাবার পর জানতে পারি বই এসেছে। পারলে উড়ে যাই ভার্জিন বইয়ের মলাট শুঁকতে। উড়ে না হোক, জ্যাম ঠেলে, হর্ণ বাজিয়ে, পৌঁছে যাই মেলার দোড় গোঁড়ায়। একদিকে একাডেমি প্রাঙ্গন আরেকদিকে সোহরাওয়ার্দী প্রাঙ্গন। রাস্তাজুড়ে একুশের স্তম্ভ, বায়ান্নর ভাষা শহীদদের ছবি, নাম, স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চিত্র। শাড়ির কুচি ধরে, স্যান্ডেলের খুটখুট আওয়াজ তুলে, রাস্তা পেরিয়ে ঢুকে যাই মেলাপ্রাঙ্গনে। ঢুকে একেবারে কাছেই ‘খনার বচন’ স্টল। আনন্দে খাবি খেতে খেতে স্টলে ঢুকি। সেলসে আছে পাপিয়া ও টিয়া নামে ভার্সিটিতে পড়ুয়া দুই ছাত্রী। ওদের সাথে পরিচয়ের পালা শেষ হলে সলজ্জে জানতে চাই,
–আমার বইটি কি এসেছে?
–হ্যাঁ আপু এসেছে। যদিও সামনে সাজিয়ে রাখা বইয়ের সারিতে আমার এতদিনের পরিশ্রম ও কঠোর সাধনার ফসলকে দেখেছি। জিজ্ঞেস করি কখন এসেছে? ওরা জানায়।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বইটি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখি,
–বই কি কেউ নিয়েছে, টিয়া?
–হ্যাঁ আপু, তুমি আসার আগে একজন দুটি আর একজন একটি নিয়ে গেছে। আমার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু মনে মনে একটু আহত হই। আমার প্রথম বই তো ‘ও’ নেবে। আহা ও জানলে খুব মন খারাপ করবে। মনটা সামান্য তেজপাতা হয়ে রইল। কিছু সময় পরে নিজেকে বোঝাই ঐ বইগুলি আমি মেলায় পৌঁছানোর আগেই চলে গেছে। আসার পর তো কেউ নেয়নি। তাহলে প্রথম বইটিই ও নেবে এবং আমার হাত থেকেই নেবে।
ডানে তাকাই, বামে তাকাই। লাল পিঁপড়ের সারির মতো হেঁটে হেঁটে সময় এগোয়। পাঠক আসে, বইয়ের নাম বলে, বই নেয়, পাপিয়া হাসতে হাসতে বলে রাইটার আছে অটোগ্রাফ নেবেন না?
ধীরে ধীরে আমি পাঠকদের সাথে একাত্ম হয়ে যাই। পাঠকরা আমার লাল গোলাপ। তারা সুগন্ধি ছড়িয়ে ফুটতে থাকে আমি গোলাপের সৌরভে মিশে যেতে থাকি বুকের ভেতরে একটা খচখচে কাঁটা নিয়ে।
পাঠকদের সাথে কিছুটা আলাপচারিতা হয়। তাদের নাম জেনে নিয়ে সে নামে বইয়ের পাতায় একলাইন দু’লাইন লিখে মসৃণ কলমে অটোগ্রাফ দিই।
এমন চলতেই থাকে। খ্যাতিমান লেখকরা অটোগ্রাফ দেয় না। আমি তো আর তা নই। কতগুলো অটোগ্রাফ দেবার পরও আঙুলের মাথা থাকে নির্মল ঝকঝকে। কোনো দাগ পড়ে না। আজকাল কি আর কেউ ঝরনা কলমে লিখে যে কালিতে মাখামাখি হবে! বা পকেটের নিচে দাগ পড়বে! কালি বা দাগের অপেক্ষায় কেটে যেতে থাকে সময়।
এদিকে মেজাজ বলছে এক দোয়াত কালি এনে ঢেলে দেই পুরো মেলার উপর। ভয়ে ঘড়ির দিকে তাকাই না। মোবাইল ফোন বের করে চেক করি, সেখানে ফুল চার্জ, ফুল নেটওয়ার্ক, ফুল ডাটা, কাজেই কোনো কল বা মেসেজ না আসার কোনো কারণ নেই, তাছাড়া আছি তো উৎকর্ণ হয়ে, এলে অন্যমনস্কতায় টের না পাওয়ারও কোনো কারণ নেই। ফোনে সময়ও দেখা যায়, না চাইলেও দেখা যায়। হাসি মুখে সবার সাথে কথা বলি, অনাবিল আচরণ করি কিন্তু বুকের ভেতরটা ভার লাগে। ফকফকে জোছনারাতের মরুভূমির মতো হু হু করে।
বিকেল সেই কখন সন্ধ্যার সাথে হাত মিলিয়েছে, আমারও পাঠকদের সাথে হাত মেলানো কমে এসেছে। কিছুতেই, কোনোভাবেই আর একে সন্ধ্যা বলা যায় না। অবশ্যই এখন রাত। স্বভাবমতো বাড়ি ফেরার তীব্র তাগিদ তাড়িত করে। ছবির মতো গোছানো আমার সংসার, নিভাঁজ পরিপাটিই থাকে, তারপরও সেই সংসারে ফেরার তীব্র তাগিদের কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না।
সোজা হয়ে দাঁড়াই। ওদের দিকে হাসিমুখে তাকাই,
–থাকো, আজকের মতো যাই।
–এখুনি কেন যাবা আপু? আরেকটু থাকো। কারো অনুরোধ ফেলা আমার জন্য শক্ত। আরও কিছু সময় থেকে বেরিয়ে আসি স্টলের বাইরে। বুক ভরে জোরে জোরে দম নিই ধুলোভর্তি বাতাসে। শেষ মাঘি বাতাসের মোকাবেলায় কারুকার্যময় শালটা গায়ে জড়িয়ে পা বাড়াই।
পাশেই দাঁড়ানো বেশ কয়েকটা পাম গাছ আকাশপানে ধাবমান। মনে মনে বলি দেখা হবে, কারো সাথে না হোক তোমাদের সাথে হবে।
মেলা তখনও সরগরম। জনতার সারি আসছে বা যাচ্ছে।
সেই জনপদে একাকী ইবনে বতুতা হয়ে শ্লথ পা বাড়াই।
এক জীবনে সব কি পূর্ণতা পায়! সে বলেছিল, ‘একটা কালির কলম আনব সেই কলমের দাগ আঙুলে লাগিয়ে তুমি আমাকে অটোগ্রাফ দেবে’।
ক্লান্ত পা দুটো এগিয়ে চলে…