তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। কথাসাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ। বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী মহিমায় অভিষিক্ত ঔপন্যাসিক। প্রথম জীবনে কাব্যচর্চা করলেও প্রধানত গল্প ও উপন্যাসে তাঁর সাহিত্য প্রতিভার পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে। সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে তিনি ঔপনিবেশিক ভারতের শৃঙ্খলমুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৮ সালের ২৩ জুলাই বীরভুমের লাভপুর গ্রামে।
১৯১৬ সালে স্বগ্রামের যাদবলাল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পাস করে তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে আইএ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কলকাতায় কলেজে পড়াকালীন মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক আদর্শ, বিশেষ করে অসহযোগ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হন। সেই আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯২১ সালে তিনি এক বছর অন্তরীণ থাকেন। ফলে তাঁর শিক্ষাজীবনের এখানেই সমাপ্তি ঘটে। সমাজ সেবার লক্ষ্যে তিনি জড়িয়ে পড়েন কংগ্রেসের রাজনীতিতে। রাজনৈতিক জীবনে তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবে আট বছর দায়িত্ব পালন করেন। কর্মজীবনে তিনি কিছুকাল কলকাতায় কয়লার ব্যবসা এবং কিছুকাল কানপুরে চাকরি করেন। ১৯৭০ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ-এর সভাপতি নির্বাচিত হন। বাংলা উপন্যাসের শ্রুতকীর্তি এই শিল্পীর রচনায় গান্ধীর আদর্শের প্রভাব লক্ষ করা যায়। তাঁর প্রধান কাহিনিগুলোর পটভূমিকা রাঢ় অঞ্চল, এখানকার অধিবাসীদের জীবন সংগ্রাম, দুঃখ-বেদনা প্রভৃতি। তাঁর সকল রচনারই প্রধান অনুষঙ্গ জীবন প্রত্যয়, মানুষের মহত্ব ও মানব জীবনের প্রতিষ্ঠা। সমাজের রূপ-রূপান্তর ও মানুষের শ্রেণিগত বিবর্তন, এসবের প্রতিক্রিয়া তাঁর সাহিত্যের বৈভব। ব্যক্তিজীবনের নানামুখী অভিজ্ঞতা তারাশঙ্করের রচনায় এনেছে বৈচিত্র্য। মাটি ও মানুষকে তিনি ভালোবেসেছেন অকৃপণভাবে। তারাশঙ্কর প্রায় দুশ গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাসমূহের মধ্যে রয়েছে : ‘রাইকমল’, ‘কবি’, ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’, ‘মন্বন্তর’, ‘হারানো সুর’, ‘সন্দীপন পাঠশালা’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘কীর্তিহাটের কড়চা’, ‘অরণ্য-বহ্নি’, ‘সপ্তপদী’, ‘অভিযান’ প্রভৃতি। তাঁর বেশ কিছু কাহিনি অবলম্বনে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র। ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর কালজয়ী এই সাহিত্যিক প্রয়াত হন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। এ সময় তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গঠিত ‘বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি’র সভাপতি ছিলেন আমৃত্যু। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শরৎস্মৃতি পুরস্কার’ (১৯৪৭) ও ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ (১৯৫৬) লাভ করেন। এছাড়া তিনি ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ (১৯৫৫), ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’ (১৯৫৬), ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার’ (১৯৬৭) এবং ‘পদ্মশ্রী’ (১৯৬২) ও ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।