শুকনো পাতার মতো টুপটুপ ঝরছে সময়ের এক একটা পাতা। বুকের কাঁপনে খসে খসে পড়ছে হারানো কতো ছবি।
সুনসান জনহীন মক্তবের পথে ঝিরঝির কুয়াশার আলিঙ্গন। তখনও বাঁশঝাড়ের কুঠরিতে আটকে থাকে রাতের ধূসর আঁধার। নিস্তব্ধতার জঠরে হঠাৎ পাখিদের গুঞ্জরণ। বুকে কায়েদা, আমপারা আর মাদুর জড়িয়ে ছুটতে ছুটতে আমাদের প্রভাত শুরু হতো। হুজুরের মায়াবী চিকন সুরের ছবক নিয়ে সুর করে দুলে দুলে সবাই পড়তাম। কনকনে শীতে কাঁপা কাঁপা কন্ঠের সুরলহরীতে মক্তবপাড়া মুখর হয়ে উঠত। তাদের কেউ এখন ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ব্যাংক কর্মকর্তা, কেউ শিক্ষক, কেউ বা ব্যবসায়ী, আবার কেউ দারিদ্র্যের ঘানিতে থেঁতলে গিয়ে অকাল বার্ধক্যে ঝিমিয়ে পড়া মানুষ।
মক্তবের পথখানা ধীরে ধীরে সোনারোদ গহনায় সেজে উঠলে, মাচাভর্তি কুমড়োর ফুলগুলো স্নান সেরে রোদে গা শুকাতে বসলে, ঘাসের পাড়া তারাফুল ও শিশিরের মুকুটে ঝলমল করলে আমাদের ছুটি হতো।লজ্জাবনত ভোরের সূর্য আলপথে ঘোমটা খুললে, চারু বুড়ি বিশাল মুড়ি মোয়ার ঝাঁকা মাথায় নিয়ে ধীরে ধীরে তার পথচলা শুরু করত। পরনে সাদা পুরোনো ময়লা থান। গলায় গেরুয়া মালা। গায়ে ছেড়া শাল। হিন্দু পাড়ার হতদরিদ্র বিধবা বৃদ্ধা। চোখজোড়া ছিল মরা মাছের চোখের মতো স্থির – বিধ্বস্ত। তার চোখের হতাশা ও বেদনার ভাষা সেদিনকার ছোট্ট বালিকার কাছে বড়ই দুর্বোধ্য ছিল। আমাদের উঠানে মুড়ি মোয়ার ঝাঁকা রেখে বিচালিতে বসতেই আমরা তাকে ঘিরে ধরতাম। তারপর চমন বাহার জরদার সুবাস কাঁপিয়ে দাদি আসতেন। টকটকে পানের রসে অধর ভিজিয়ে রাণীর মতো মোড়ার সিংহাসনে আসন গ্রহণ করতেন। দাদি মুড়ি কিনতেন। এক পট ধানে এক পট মুড়ি।
পৌষের সে দিনগুলো খুঁজতে আমি ছুটলাম। কোথাও কিছু নেই। নুরু কাক্কু নেই, খেজুরের রস নেই। চারু বুড়ি আসার সে আলপথ এখন প্রশস্ত পরিপাটি। মাথায় ঝাঁকা নিয়ে সে পথে কাউকেই দেখলাম না। আগুন পোহানোর উৎসবের আয়োজন নেই। বিলের মাঝখানে কচুরিপানার বেগুনি ফুলভর্তি আদুম্মা পুকুর এখন স্বচ্ছ অতল জলে টলমল করছে। তার চারপাশের নারকেল বনে এখন সুবেশী বাতাসের আলাপন।
নৈঃশব্দ্যের আঁধার ছাপিয়ে ঊষাকালে ডাহুকের জলকেলির গল্প, অদূরের কোনো আঙিনায় ঘন কুয়াশার ফাঁকে দাউ দাউ আগুনশিখার নাচন, চারু বুড়ির মুড়ির ঝাঁকা,নুরু কাক্কুর খেজুর গাছ কাটার টকটক শব্দ – সেসব পৌষের দিনগুলো আমি অধীর হয়ে খুঁজতে লাগলাম। সব কিছু যেন ঐ শস্যহীন ঊষর মাঠের মতো নির্জীব, মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ডানা ভাঙা পাখির মতো চলছে সব পায়ে পায়ে। এসবে ঐ সুললিত ছন্দ কই! আহা! আমাদের পৌষের দিনগুলো। আজ যেন সব অন্য পৃথিবীর গল্প।