সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের বৈকালিক চেম্বার পরীক্ষামূলক ভাবে (পাইলটিং) শুরু হচ্ছে আজ। এর আওতায় অফিস সময়ের পর নির্ধারিত ফি’র বিনিময়ে নিজের কর্মস্থলে (সরকারি হাসপাতালে) বসেই রোগী দেখবেন চিকিৎসকরা। বিকেল তিনটা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত হাসপাতালে এ সেবা পাওয়া যাবে। ডাক্তার দেখানোর পাশাপাশি এসময়ে হাসপাতালে বেশ কিছু পরীক্ষা–নিরীক্ষা করারও সুযোগ থাকছে। তবে এক্ষেত্রেও নির্ধারিত হারে ফি পরিশোধ করতে হবে রোগীদের।
প্রাথমিক ভাবে ৩০ মার্চ (আজ) থেকে সারাদেশের ১০টি জেলা সদর হাসপাতাল এবং ২০টি উপজেলা হাসপাতালে পরীক্ষামূলক এ সেবা চালু করার ঘোষণা দেন স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেক। মন্ত্রী গত সোমবার এ ঘোষণা দিলেও পাইলটিংয়ের জন্য নির্বাচিত হাসপাতালের তথ্য ওই সময় দিতে পারেনি মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ফলে স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন তথ্য দিতে পারেন নি। পরবর্তীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাইলটিংয়ের জন্য নির্বাচিত হাসপাতালগুলোর নাম প্রকাশ করা হয়। যা আজাদীর হাতে এসেছে। তালিকায় বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৫টি হাসপাতাল রয়েছে। এর মাঝে দুটি জেলা সদর হাসপাতাল এবং বাকি ৩টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ। জেলা হাসপাতাল দুুটির মধ্যে রয়েছে কঙবাজার ও খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতাল। আর উপজেলা হাসপাতালের মধ্যে চট্টগ্রামের পটিয়া, কক্সবাজারের পেকুয়া এবং বান্দরবানের লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে।
পাইলটিংয়ের আওতায় বৃহত্তর চট্টগ্রামের এই ৫ হাসপাতালে আজ থেকেই বৈকালিক চেম্বারের সেবা শুরু হচ্ছে। তবে মাত্র ১/২ দিন আগে জানতে পারায় এ সেবা চালুর প্রস্তুতিতে পর্যাপ্ত সময় পায়নি হাসপাতালগুলো। এরপরও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় হাসপাতালগুলো এ সেবা চালু করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচিত এসব হাসপাতালের মধ্যে বেশ কয়টিতে কনসালটেন্ট পদের চিকিৎসক সংকট রয়েছে। ফলে মেডিকেল অফিসার পদ মর্যাদার চিকিৎসকদের দিয়েই মূলত এ সেবা দিতে হবে হাসপাতালগুলোকে। কোন কোন হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার পদের চিকিৎসকের সংখ্যাও পর্যাপ্ত নয়। বৃহস্পতিবার (আজ) বৈকালিক সেবা কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের কথা জানিয়ে পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার–পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সব্য সাচী নাথ আজাদীকে বলেন, আমরা প্রস্তুতি মোটামুটি শেষ করেছি। প্রথম দিন দুজন কনসালটেন্ট এবং দুজন মেডিকেল অফিসার বৈকালিক এ সেবা দেবেন। কনসালটেন্টের মধ্যে একজন নাক–কান ও গলা বিভাগের এবং অপরজন চর্ম ও যৌন রোগের সেবা দেবেন। হাসপাতালে ৯ জন কনসালটেন্টসহ সবমিলিয়ে ৩১ জন চিকিৎসক রয়েছেন জানিয়ে ডা. সব্য সাচী বলেন, আমাদের চিকিৎসক পর্যাপ্ত রয়েছে। চক্ষু ছাড়া সব বিভাগেই কনসালটেন্ট রয়েছেন। তাই রোস্টার করে সব বিভাগে এ সেবা দেয়া সম্ভব হবে। যদিও বুধবার দুপুর পর্যন্ত রোস্টার করা হয়নি। মন্ত্রণালয়ের একটি লিখিত নির্দেশনা আসবে, সেটি পেলে পরবর্তীতে বসে সবকিছু চূড়ান্ত করা হবে বলে জানান এই চিকিৎসক।
চট্টগ্রাম জেলায় কেবল পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরীক্ষামূলক এ সেবা চালু হচ্ছে জানিয়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী আজাদীকে বলেন, সেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসক রয়েছে। তাই বৈকালিক এ সেবার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হবে না। আর কোন জটিলতা দেখা দিলে পরবর্তীতে তা শোধরানো হবে।
প্রায় ৬ মাস আগে থেকেই হাসপাতালে বৈকালিক কিছু সেবা চালু রয়েছে দাবি করে পেকুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার–পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মহিউদ্দিন মাজেদ চৌধুরী আজাদীকে বলেন, হাসপাতালে আগে থেকেই আলট্রাসনোগ্রাম ও এঙ–রেসহ প্যাথলজির অনেক পরীক্ষা–নিরীক্ষা রাত ৯টা পর্যন্ত চালু রেখেছি। যার কারণে বৈকালিক সেবায় আমাদের আগে থেকেই কিছুটা অভিজ্ঞতা রয়েছে। এখন চিকিৎসকরা রোগী দেখবেন। কনসালটেন্ট সংখ্যায় কম হলেও চিকিৎসক পর্যাপ্ত রয়েছে। তাই এই সেবায় কোন সমস্যা হবে না। বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিক ভাবে এ সেবা চালু করা হবে বলে জানান ডা. মহিউদ্দিন মাজেদ চৌধুরী।
এদিকে, তালিকায় থাকা বান্দরবানের লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কনসালটেন্ট রয়েছে মাত্র তিনজন। মেডিকেল অফিসারের সংখ্যাও দশ জনের কম। এ সংখ্যক জনবলে বৈকালিক এ সেবা কতটা নির্বিঘ্ন হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। তবে জনবল যা আছে, তা নিয়েই সর্বোচ্চ সেবা প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে জানিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার–পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. মাঈন উদ্দিন মোরশেদ বলেন, কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও আমাদের সর্বোচ্চ সেবাদানের চেষ্টা থাকবে। গাইনী, কার্ডিওলজি ও অ্যানেসথেসিয়ার কনসালটেন্ট রয়েছে। তবে আরো কয়েকজন কনসালটেন্ট পেলে ভালো হতো। বিশেষ করে শিশু ও সার্জারীর কনসালটেন্ট জরুরি। যদিও এসব বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে বলেও জানান লামা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার–পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. মাঈন উদ্দিন মোরশেদ।
এটি সরকারের অত্যন্ত ভালো একটি উদ্যোগ দাবি করে চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আজাদীকে বলেন, মানুষ এখন কম টাকায় বিশেষজ্ঞ সেবা পাবেন। যে ডাক্তারকে বাইরে চেম্বারে এক হাজার টাকায় দেখাতে হয়, এখন হাসপাতালে ৫০০ টাকায় দেখাতে পারবেন। হাসপাতালে কম খরচে পরীক্ষা–নিরীক্ষার সুবিধাও পাবেন। এটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ।
যদিও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্বল্পতা, জনবলসহ বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও তা পর্যায়ক্রমে সুরাহা করা হবে জানিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের এ কর্মকর্তা বলেন, সংকটের বিষয়গুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি মহোদয়কে আমরা জানিয়েছি। কনসালটেন্টসহ চিকিৎসক স্বল্পতা দূরকরণে তিনি ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন। এ সেবায় পরবর্তীতে জটিলতা থাকবে না বলেও জানান বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন।
ফি : স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী– এই সেবার জন্য একজন অধ্যাপকের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা। এর মধ্যে ৪০০ টাকা চিকিৎসক পাবেন, সেবার সহায়তাকারী পাবেন ৫০ টাকা এবং হাসপাতাল পাবে ৫০ টাকা। এছাড়া সহযোগী অধ্যাপক বা সিনিয়র কনসালটেন্টের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০০ টাকা। এর মাঝে চিকিৎসক পাবেন ৩০০ টাকা। সহকারী অধ্যাপক বা জুনিয়র কনসালটেন্ট, বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারী চিকিৎসকের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০০ টাকা, যার ২০০ টাকা চিকিৎসক পাবেন। এমবিবিএস বা বিডিএস বা সমমনা ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের ফি ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫০ টাকা চিকিৎসক পাবেন। বাকি টাকা সার্ভিস চার্জ বাবদ কাটা হবে এবং চিকিৎসকদের সহায়তাকারীরা পাবেন। এক্ষেত্রে নার্স ও টেকনিশিয়ানরাও সপ্তাহে দু’দিন করে কাজ করবেন।
চিকিৎসাসেবা পরামর্শের পাশাপাশি ছোটখাটো সার্জারি, ডায়াগনস্টিক/ক্লিনিক্যাল/ প্যারা–ক্লিনিক্যাল টেস্টসহ বিভিন্ন রকম পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে বৈকালিক এ সেবায়। সেগুলোর জন্যেও মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। এক্ষেত্রেও খরচের একটি অংশ পাবে হাসপাতাল।
সরকারি হাসপাতালে বৈকালিক এ সেবা চালুর বিষয়ে গত ২৭ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালে সেবা দেন। তারপর সিনিয়র চিকিৎসকরা হাসপাতালে থাকেন না। এরপরেও অনেক মানুষের চিকিৎসা পরামর্শ ও টেস্টের প্রয়োজন হয়। এতে বিকেলে বহু মানুষ চিকিৎসা নিতে না পেরে বাইরে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে দেখান। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের ‘ফি’ বেশি হওয়ায় দেশের মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। চিকিৎসক না থাকায় অনেক মানুষের কষ্ট হয়, আমরা সেই কষ্ট লাঘবের জন্য এই দ্বিতীয় শিফট চালু করছি।
সবার সঙ্গে আলোচনা করে ৩০ মার্চ থেকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস শুরু করতে যাচ্ছি। চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালে প্রাতিষ্ঠানিক প্র্যাকটিস করবেন। প্রথমে ১০টি জেলা হাসপাতালে এবং ২০টি উপজেলায় এই কার্যক্রম শুরু হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রী বলেন, পাইলট প্রকল্পের কার্যক্রম কেমন চলছে তা আমরা দেখব। সেখানে যদি কোনো ত্রুটি–বিচ্যুতি থাকে, আমরা সেটা সংশোধন করে পর্যায়ক্রমে ৫০০টি উপজেলা এবং ৬৪ জেলায় বাস্তবায়ন করব। বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালে চেম্বার করবেন। তাদের এই সেবা দেওয়ার জন্য সম্মানী নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সম্মানীর একটি অংশ চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী এবং আরেকটি অংশ হাসপাতাল পাবে।