গত ২৭ মার্চ ২০২৩ তারিখে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদেরকে’ নিয়ন্ত্রণে আনতে বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনে কয়েকটি পরিবর্তন নিয়ে আসার জন্য একটি প্রস্তাবিত খসড়া অনুমোদিত হয়েছে, যে খসড়াটি বিল আকারে সংসদে উপস্থাপনের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। দেশের পত্র–পত্রিকায় এবং ব্রডকাস্ট মিডিয়ায় এই খসড়াটি সম্পর্কে ব্যাপক আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে যে বিলটি সংসদে পাশ হয়ে আইনে পরিণত হলে এবার ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ সমস্যার একটা ভাল সমাধান পাওয়া যেতে পারে। আমি কিন্তু আশাবাদী হতে পারছি না, কারণ প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলো নেহাতই কতগুলো ‘কসমেটিক পরিবর্তন’। কোন পরিবার থেকে পরিচালক তিনজনে নামিয়ে আনা, গাড়ি,বাড়ি ও কোম্পানির মালিকানা নেয়ায় বাধা, ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণ গ্রহণের সুযোগ কিছুটা সংকুচিত করা, কিছু রাজনৈতিক বিধিনিষেধ, বিদেশে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা, নূতন ঋণ নেয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, ইত্যকার পরিবর্তনগুলোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আমি মনে করি আসলে সমস্যার মূল জায়গাটায় হাতই দেওয়া হয়নি। সমস্যার মূলে রয়েছে দেশের বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে শত শত বা হাজার হাজার খেলাপিঋণ মামলা বছরের পর বছর অমীমাংসিতভাবে ঝুলিয়ে রেখে ঋণখেলাপিরা তাদের আর্থিক ক্ষমতা, ঘুষ–দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব–প্রতিপত্তি ব্যবহার করে ‘খেলাপিঋণ ফেরত না দেওয়ার সংস্কৃতি’ অব্যাহত রাখতে পারা। এই সমস্যাটিকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার কোন প্রস্তাবিত পরিবর্তন এই খসড়া বিলে আমি দেখতে পাইনি। অতএব, এই খসড়া বিলটিতে অন্তর্ভুক্ত প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলো আইনে পরিণত হলে ব্যাংকিং খাতের খেলাপিঋণ সমস্যার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই। এটা আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে চাই। দুঃখজনকভাবে সরকার এখনো খেলাপিঋণের ব্যাপারে জনগণের সাথে প্রতারণার খেলাই চালিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু আইএমএফ আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে খেলাপিঋণ আদায়ের ব্যাপারে কঠোর আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের শর্ত জুড়ে দিয়েছে তাই তাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য এই ‘কসমেটিক পরিবর্তনগুলো’ আনয়নের নাটক সাজিয়ে চলেছে সরকার। বিশ্ব ব্যাংকও ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর হওয়ার শর্ত দিয়েছে জানা যায়। কিন্তু, বর্তমান অর্থমন্ত্রী যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদেরকে সত্যিকারভাবে দমনের কোন কার্যকর ব্যবস্থা এই সরকার গ্রহণ করবে না, এটাই দুঃখজনক বাস্তবতা। কেন একথা বলছি তার ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:
জনাব মোস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন তাঁর আমলে খেলাপিঋণ এক টাকাও বাড়বে না, যদিও তিনি এই চ্যালেঞ্জ রাখতে পারেননি । এতদুদ্দেশ্যে অতি দ্রুত তিনি নিচের ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বাধ্য করেছিলেন:
১) দায়িত্ব নেয়ার পরপরই ২০১২ সাল থেকে প্রচলিত তিন ধরনের শ্রেণীকরণের নিয়ম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং খাতের অনাদায়ী ঋণকে শ্রেণীকরণের নূতন নিয়ম চালু করেছে: এক, পূর্বে নির্দিষ্ট মেয়াদের তিন মাস পর যেসব ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হত সেগুলোকে ‘সাব–স্ট্যান্ডার্ড ঋণ’ শ্রেণীকরণ করা হতো, নূতন নিয়মে তিন মাসের পরিবর্তে সময়টা ছয় মাস করা হয়েছে; দুই, পূর্বে নির্দিষ্ট মেয়াদের ছয় মাসের বেশি যেসব ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হত সেগুলোকে ‘ডাউটফুল ঋণ’ বলা হতো, নতুন নিয়মে নয় মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে ‘ডাউটফুল’ শ্রেণীকরণ হচ্ছে; এবং তিন, আগের নিয়মে নয় মাসের বেশি কোন ঋণ খেলাপি হলে ‘মন্দঋণ’ শ্রেণীকরণ করা হতো, এখন এক বছর বা তার বেশি সময়ের জন্যে ঋণ অনাদায়ী হলে ‘মন্দঋণ’ বা ‘লস’ শ্রেণীকরণ করা হচ্ছে। ২০১২ সালের নিয়মটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ছিল, কিন্তু অর্থমন্ত্রীর চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক পুরানো শ্রেণীকরণ পদ্ধতিতে ফিরে গেল।
২) এরপরই বাংলাদেশ ব্যাংক মন্দঋণ ‘রাইট অফ’ বা অবলোপনের নিয়মনীতি অনেকখানি শিথিল করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করল: আগের নিয়মে যেখানে পাঁচ বছরের খেলাপি মন্দঋণ ‘রাইট অফ’ করার যোগ্য বিবেচিত হত সেক্ষেত্রে নতুন নিয়মে দুই বা তিন বছরের মন্দঋণও ‘রাইট–অফ’ করায় কোন বাধা থাকবে না। পাঠকদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, মন্দঋণ ‘রাইট–অফ’ বা অবলোপন করার মানে হলো ঐ অবলোপনকৃত মন্দঋণের হিসাবটা ব্যাংকের মূল ব্যালেন্স শিট থেকে অপসারণ করে আরেকটি লেজারে হিসাবটা সংরক্ষণ করা। ‘রাইট–অফ’ করার দুটো শর্ত হলো: ১) ঐ ঋণ সুদাসলে আদায়ের জন্যে ব্যাংক মামলা দায়ের করবে, ২) যে পরিমাণ ঋণ ‘রাইট–অফ’ করা হয় তার সম–পরিমাণ অর্থ ‘প্রভিশনিং’ বা ‘সঞ্চিতি’ করতেই হবে। প্রভিশনিং মানে হলো, ঐ পরিমাণ অর্থ অন্য কাউকে ঋণ দেওয়া যাবে না। রাইট অফ করার ফলে ব্যাংকের ক্লাসিফাইড লোনের পরিমাণ ঠিক অতটুকু কম দেখানো যাবে। অতএব, নতুন নিয়ম চালু করে ক্লাসিফাইড লোন কমানোর হাতিয়ার ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হলো। আর একটা সুবিধে ঘোষিত হলো, মামলা করার বাধ্যবাধকতার জন্যে আগে যে সর্বনিম্ন সীমা (ফ্লোর) ছিল ৫০,০০০ টাকা ওটাকে বাড়িয়ে ২,০০,০০০ টাকা করা।
৩) তারপর ২৫ মার্চ ২০১৯ তারিখে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, মাত্র ২ শতাংশ খেলাপি ঋণ প্রথম কিস্তিতে শোধ করলে ঋণখেলাপিকে ১০ বছর সময় দেওয়া হবে, যার মধ্যে তিনমাসের কিস্তিতে মাত্র ৭ শতাংশ সুদে বাকি ঋণ শোধ করা যাবে। (পরে তিনি বললেন সুদের হার ৯ শতাংশ হবে)।
উপরের পদক্ষেপগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে, একজন ‘ব্যবসায়ী অর্থমন্ত্রী’ তাঁর ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী বন্ধুদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত দরদ দেখিয়ে চলেছেন। তাঁর এসব পদক্ষেপ খেলাপিঋণ সমস্যাকে কার্পেটের নিচে লুকিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যেই গৃহীত হয়েছে, যার মাধ্যমে সর্বশেষ প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্লাসিফাইড লোন ১,৩৪,০০০ কোটি টাকা থেকে ১,২০,০০০ কোটি টাকায় নেমে গেছে। গত মাসে দেশের শীর্ষ কুড়ি জন ঋণখেলাপির যে তালিকা অর্থমন্ত্রী সংসদে উপস্থাপন করেছেন তার মধ্যে দেশের পরিচিত রাঘববোয়াল ঋণখেলাপির একজনের নামও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা সবাই হয়তো দুই শতাংশ খেলাপিঋণ জমা দিয়ে নিজেদের নাম খেলাপি তালিকা থেকে গায়েব করে দিয়েছেন! অথচ, আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি দেশের প্রকৃত খেলাপিঋণ ইতোমধ্যে চার লক্ষ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। গত চার বছরে খেলাপিঋণ আদায়ে কোন গতিসঞ্চার করা যায়নি। এই বিপুল খেলাপিঋণের প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ অর্থঋণ আদালত, হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের ঝুলে থাকা মামলাগুলোর অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ওগুলোকে ক্লাসিফাইড লোনের হিসাবে প্রকাশ করা যায় না। দেশের ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা’ তাদের অর্থশক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব–প্রতিপত্তিকে ব্যবহার করে বছরের পর বছর মামলাগুলোকে ঝুলিয়ে রাখতে সমর্থ হচ্ছে, এবং এই খেলাপিঋণের বৃহদংশই তারা দেশের বাইরে পাচার করে বিদেশে ঘরবাড়ি, ব্যবসাপাতি কিনে বহাল তবিয়তে সপরিবার দেশে–বিদেশে দিনাতিপাত করছে এবং দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত বিচার ব্যবস্থার এই বেহাল অবস্থা ও দীর্ঘসূত্রিতার নিরসনের জন্যই প্রয়োজন সব ব্যাংকের শীর্ষ দশ ঋণখেলাপির বিচারকে ত্বরান্বিত করার জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে যেহেতু আপিল করা যায় না তাই মামলার বিচার দ্রুত সম্পন্ন করে তাদেরকে জেলের ভাত খাওয়াতে হলে এবং তাদের সম্পত্তি ক্রোক করতে হলে ট্রাইব্যুনাল ছাড়া গত্যন্তর নেই। ১৯৯৮ সালে প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দীন এই ট্রাইব্যুনাল গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরের বছর আবার বিচারপতি হাবিবুর রহমান একই আহ্বান জানানো সত্ত্বেও তদানীন্তন সরকার কর্ণপাত করেনি। অথচ, এই দুজনই ছিলেন এদেশের প্রধান বিচারপতি। ১৯৯৯ সালে দেশে দেউলিয়া আইন পাশ হওয়ার পর প্রথম দেউলিয়া ঘোষণা করা হয় এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীকে। তিনি তড়িঘড়ি করে শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে আবার আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা দেওয়ায় আমৃত্যু তাঁর বিরুদ্ধে আর কোন ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। ২০০১ সালে বিএনপি–জামায়াত জোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আর কাউকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়নি। গত ২৪ বছর ধরে দেউলিয়া আদালতটি ঘুমিয়ে রয়েছে। দেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত জনাব মুহিত অর্থঋণ আদালতের রায়ের আপিল মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে হাইকোর্টে কয়েকটি ‘ডেজিগনেটেড বেঞ্চ’ স্থাপনের জন্য কয়েকবার প্রয়াস চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে তাঁর ঐ সুপারিশে কোন সাড়া মেলেনি। এসব বাস্তবতা পর্যালোচনা করে বোঝা যাচ্ছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হয়তো বিচার ব্যবস্থার এহেন দুর্নীতি ও বেহাল অবস্থার নিরসন চান না। এখন দেশের জনগণের মধ্যে একটা বিষয়ে বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে যে খেলাপিঋণের বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ১০ এপ্রিল ২০২৩ তারিখের দৈনিক প্রথম আলোয় যে দশটি দেশে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে সেগুলোর নাম প্রকাশিত হয়েছে: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেম্যান আইল্যান্ড ও বৃটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড হচ্ছে এই দশটি দেশ। দেশের প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের অধিকাংশই যেহেতু হুন্ডি ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশে আসছে, তাই ব্যাংকঋণ হুন্ডি প্রক্রিয়ায় বিদেশে পাচার হওয়া এখন একেবারেই সহজ হয়ে গেছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের মধ্যে ব্যাংকের মালিক, পরিচালক, বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরাই যেহেতু সবচেয়ে বেশি ঋণ নেয়ার একচ্ছত্র সুবিধা ভোগ করে চলেছেন তাই তাদের সুবিধাগুলো কাটছাঁট করে খেলাপিঋণ কমানো যেতে পারে বলে নীতি–নির্ধারকদের মধ্যে ধারণা গড়ে ওঠাই স্বাভাবিক। সরকারের প্রস্তাবিত ‘কসমেটিক পরিবর্তনগুলো’ এতদুদ্দেশ্যেই করা হচ্ছে। কিন্তু, ট্রাইব্যুনাল করা হলে ‘যেমন বুনো ওল তেমন বাঘা তেঁতুল’ প্রক্রিয়ারই আশ্রয় নেয়া যেতো। এই ব্যাপারটি যে নীতি–প্রণেতাদের চিন্তা–চেতনায় আজো স্থান পেলো না সে দুঃখ কোথায় রাখি?
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়