ট্যানারির বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে করতে হবে বৈজ্ঞানিক ও পরিবেশবান্ধব

রেজাউল করিম স্বপন | শনিবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

কথায় আছে নিজের ভালো পাগলেও বুঝে, অথচ আমরা বুঝি না। যদি বুঝতাম তাহলে দেশে চামড়া শিল্প নিয়ে এতো অবহেলা কখনো করতাম না। বিশ্বে যে দেশে যে পণ্যের কাঁচামাল সহজলভ্য, সে দেশ সেই পণ্য তৈরিতে এগিয়ে থাকে। কারণ এতে লাভের পরিমাণ বেশি অথচ আমরা এর ব্যতিক্রম। শুধু মানসম্মত ও কার্যকর সিইটিপি ও বর্জ্য পরিশোধনাগার না থাকায় সে সুযোগটি আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। আগে দেশের প্রধান তিনটি রপ্তানি পণ্যের একটি ছিলো চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। কালের বিবর্তনে ও আমাদের ভুল পদক্ষেপে সেই অবস্থানটি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। শুধুমাত্র ট্যানারির বর্জ্য ব্যবস্থাপনাটি বৈজ্ঞানিক ও পরিবেশ বান্ধবভাবে করতে পারলে সেই হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাওয়া সম্ভব। এক সময় বিশ্বে পরিবেশ নিয়ে এতো চিন্তা করতো না। কিন্তু বৈশ্বিক ঊষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তন হয়ে পরিবেশ বির্পযয় হওয়ায় পৃথিবীর সব দেশ এখন পরিবেশ নিয়ে চিন্তিত। সেজন্য বিশ্বে যে কোনো পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিতে ইকো ফ্যান্ডলি পরিবেশ নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
বাংলাদেশে মানসম্মত কাঁচাচামড়া সহজ লভ্য। চামড়াকে ব্যবহার করে একসময় দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। তখন দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিলো চা, চামড়া ও পাঁ। চামড়া দিয়ে তৈরি হতো জুতা, ব্যাগ, বেল্ট, ওয়ালেট, জ্যাকেট ইত্যাদি। কিন্তু এখন দেশের বাজারে দেশিয় চামড়াজাত পণ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। বড় কোম্পানিগুলো দেশে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন না করে বিদেশ থেকে আমদানি করাকে বেশি সাশ্রয়ী মনে করে। অথচ প্রতিবছর দেশে হাজার হাজার চামড়া নষ্ট হয়ে যায় ও চামড়ার ন্যায্য দাম পাওয়া যায় না। কিন্তু কেন এই অবস্থা হলো কর্তৃপক্ষ কি কখনো ভেবে দেখেছেন? অথচ এই পণ্যটিকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা দেওয়া দরকার ছিলো।
বৃটিশ আমলে সারা দেশে ট্যানারিগুলো ছিলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে, এতে সারাদেশে পরিবেশ দূষণ হতো। পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে ১৯৫১ সালে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ট্যানারিগুলোকে ঢাকার হাজারীবাগে আনা হয়। এগুলো থেকে দিনে ২১,৬০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য বুড়িগঙ্গা নদীতে পড়তো। এছাড়া চামড়ার উচ্ছিষ্ট বেড়িবাঁধের পাশে খালে, জলাধারে ও রাস্তার পাশে ফেলা হতো। এ সমস্যা সামাধানের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় ২০০৩ সালে সাভারে চামড়াশিল্প নগর প্রকল্প হাতে নেয়। শুরুতে এই প্রকল্পের ব্যয় ছিলো ১৭৬ কোটি টাকা। পরে তা ১,০৭৯ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এ প্রকল্পের অধীনে সাভারের হেমায়েতপুরে ১৯৯ একর জমি অধিগ্রহণ করে ১৫৪টি ট্যানারিকে প্লট দেয়া হয়। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে ট্যানারিগুলোকে হাজারীবাগ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। বিচ্ছিন্ন করা হয় কারখানার সেবা সংযোগ। তবে সাভারে ট্যানারিশিল্প নগরে ট্যানারি চালু হতেই পরিবেশ দূষণের অভিযোগ ওঠে। চামড়া শিল্প নগর প্রকল্পের ডিপিপি অনুযায়ী ২৫০ কোটি টাকা ট্যানারি মালিকদের ক্ষতিপূরণ, বর্জ্য পরিশোধনাগার ও চামড়া উচ্ছিষ্ট ফেলার জায়গার জন্য ব্যয় করা হয়। অন্যান্য কাজের জন্য রাখা হয়েছিল ৬৫০ কোটি টাকা। শিল্পনগরে বিসিকের দায়িত্ব ছিলো জমি অধিগ্রহণ করে কারখানার উপযোগী করা। বর্জ্য পরিশোধাগার নির্মাণ করা, কেউ পরিবেশ দূষণ করলে ব্যবস্থা নেওয়া ইত্যাদি। প্রকল্পের সিইটিপি নির্মাণের জন্য ২০১২ সালের মার্চে একটি চীনা কোম্পানিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। যার দরপত্র মূল্য ছিলো ৬ কোটি ৪৪ লাখ ডলার, মেয়াদ ছিলো ১৮ মাস। কিন্তু চীনা ঠিকাদার সিইটিপি তৈরিতে সময় নেয় ৯ বছরের বেশি। যদিও সিইটিপি যথাযথ মান সম্পন্ন হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। শেষমেশ গত জুন’২১ এ ঠিকাদার সিইটিপি বিসিককে হস্তান্তর করে। এরপর এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যাওয়ার কথা ঢাকা ট্যানারী ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কোম্পানির কাছে। এই কোম্পানি বিসিক ও ট্যানারি মালিকদের সমন্বয়ে গঠিত হওয়ার কথা। বিসিক দায়িত্ব বুঝে নিয়ে ট্যানারিগুলোকে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের বাধ্য বাধকতার কথা বলে। যদিও ট্যানারি শিল্পনগরীর ১৪৪টি ট্যানারির একটিরও পরিবেশ ছাড়পত্র নেই।
অন্যদিকে স্থাপিত সিইটিপির ক্যাপাসিটি ২৫,০০০ ঘন মিটার বর্জ্য। কিন্তু সিইটিপি সেই ২৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্যও ঠিক মত পরিশোধন করতে পারে না। বর্তমানে প্রতিদিন বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে ৩৫ হতে ৪০ হাজার টন ঘন মিটার। ফলে স্থাপিত সিইটিপি অকার্যকর হয়ে পড়েছে, তাই রাতের আধারে অপরিশোধিত বর্জ্য নালা দিয়ে ধলেশ্বরী নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে নদীর জলজ জীব বৈচিত্র্যসহ পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সর্ম্পকিত সংসদীয় কমিটি গত ২৩ শে অগাস্ট’২১ পরিবেশ দূষণের দায়ে চামড়াশিল্প নগরের ট্যানারি সাময়িক বন্ধ রাখার সুপারিশ করেছে। সেই প্রেক্ষিতে পরিবেশ অধিদপ্তর ৯ সেপ্টেম্বর বিসিকের চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো ট্যানারিগুলো বন্ধ হলে দেশে উৎপাদিত কাঁচা চামড়ার কি হবে? এতে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারী বেকার হবে। ট্যানারিগুলোকে দেওয়া ব্যাংক ঋণ খেলাপি হবে। দেশের চামড়া রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে। দেশীয় বাজারে পাদুকা ও চামড়াজাত শিল্প সংকটে পড়বে।
আগেই বলেছি একসময় দেশের রপ্তানি আয়ে চামড়া ছিল ২য় স্থানে। ২০১৬-১৭ তে রপ্তানি আয় ছিলো ১২৩ কোটি ডলারের বেশি। ২০২০-২১ সালে কমে ৯৪ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। অথচ পরিবেশসম্মত শিল্পনগরের প্রক্রিয়াজাত চামড়ার পণ্য বিশ্বের বড় বড় ব্রান্ডগুলো কেনার কথা ছিলো। ট্যানারিগুলো বৈশ্বিক জোট লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) পরিবেশ সম্মত কারখানার সনদ পাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু সিইটিপি যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়ায় নিয়মিত ক্রেতারাই চলে গেছে। অথচ সিইটিপি নির্মাণের দায়িত্ব ছিলো বিসিকের। তাদের গাফিলতির জন্য মান সম্পন্ন সিইটিপি নির্মিত হয়নি যেখানে লবণ পরিশোধনের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। কঠিন বর্জ্য ফেলার জায়গাও গত ১৮ বছরে নির্মিত হয়নি। ফলে ভুগতে হচ্ছে দেশের চামড়া শিল্পকে। শুধু এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় প্রতিমিটার বাংলাদেশের চামড়া আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি হয় ৪০ সেন্ট হতে ১ ডলারের মধ্যে আর সনদ প্রাপ্ত দেশের চামড়া বিক্রি হয় প্রতিমিটার ৩.৫-৪.৬ ডলার। এই সনদ থাকলে বিশ্বের সব ক্রেতার কাছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করা যেতো। এই সনদ পেতে হলে দরকার সিইটিপি। গত ১৮ বছরে এই একটি জিনিস আমরা ঠিকমত করতে পারি নি।
অন্যদিকে দেশের ১৮ কোটি মানুষের জন্য বছরে অন্তত ১৮ কোটি জুতা বা সেন্ডেল লাগে। যাতে চামড়া লাগে ৪৫ কোটি বর্গফুট (প্রতি জোড়ায় ২.৫ বর্গফুট চামড়া হিসাবে)। তার সাথে বছরে প্রায় ১ কোটি বেল্ট, মানিব্যাগ, জ্যাকেট, সোফা ও গাড়ির সিট কভার তৈরিসহ দেশের চাহিদা অনুযায়ী চামড়াজাত পণ্যের জন্য লাগে প্রায় ১ কোটি ৭৫ লাখ গরুর চামড়া। অথচ আমরা সারাবছরে ১ কোটি ৭৫ লাখ গরু জবাই করি না। তাহলে প্রশ্ন হলো কেন আমরা চামড়া ন্যায্যদাম পাই না? তাই চামড়া শিল্পকে রক্ষার জন্য ফিনিসড প্রডাক্ট (জুতা ও অন্যান্য তৈরি সামগ্রী) আমদানি বন্ধ করলে এই শিল্পটি রক্ষা পাবে। অনেকে বলবেন, এতে চামড়ার সামগ্রীর দাম বেড়ে যাবে। কিন্তু একটু খবর নিয়ে দেখুন, শোরুমে যে জুতাটি ৩০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে তার কস্টিং হচ্ছে মাত্র ১০০০ হতে ১২০০ টাকা। যেখানে চামড়া বাবদ খরচ হচ্ছে মাত্র ২৫০ টাকা (এখানে একেবারে কাচা চামড়ার দাম ধরা হয়েছে ৩০-৩৫ টাকা/ফুট হিসাবে, সেই হিসাবে একটি গরুর কাঁচা চামড়ার দাম পড়ে ৯০০-১১০০ টাকা)। বাকিটা হচ্ছে আনুষাঙ্গিক খরচ ও লাভ। তাই চামড়া শিল্পকে বাঁচাতে হলে ট্যানারিগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য জরুরি ভিত্তিতে সিইটিপি কার্যকর প্রয়োজন অথবা বড় বড় ট্যানারিগুলোকে নিজস্ব ইটিপি তৈরি করার অনুমোদন দেওয়া দরকার।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিজেকে বড় করে দেখা
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে