জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১২ নভেম্বর, ২০২১ at ৫:০৫ পূর্বাহ্ণ

সূরা ইন্‌শিরাহ’র শিক্ষা ও তাৎপর্য

সূরা: ইন্‌শিরাহ্‌ প্রসঙ্গ:
মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ৯৪ তম সূরা আলাম নাশ্‌রাহ বা সূরা ইনশিরাহ মক্কী সূরা হিসেবে প্রসিদ্ধ। এ সূরায় রুকু সংখ্যা এক, আয়াত সংখ্যা আট, পদ বা শব্দ সাতাশ, বর্ণ একশ ত্রিশ। ইনশিরাহ শব্দটি ক্রিয়ামূল, শরহুন আরবি শব্দ থেকে নির্গত, অর্থ: প্রশস্ত করা, উন্মুক্ত করা, সম্প্রসারণ করা।
সূরার আলোচ্য বিষয়: ১. রাসূলুল্লাহর বক্ষ বিদারণ, ২. ইসলাম প্রচারে প্রতিকুলতার পর অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টির আলোচনা, ৩. নবীজির মর্যাদা ও সম্মানকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সমুন্বত করার বর্ণনা, ৪. মহান আল্লাহর সমীপে ইবাদত ও দুআয় মনোনিবেশ করার নির্দেশনা।
সূরার শানে নুযুল: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছিলেন, মাওলা মুনীব! তুমি হযরত আদম আলায়হিস সালামকে বিশেষ বন্ধুত্ব দান করেছো। হযরত মুসা আলায়হিস সালামকে তাওরাত শরীফ দান করেছো, আমাকে কি দান করেছো? তদুত্তরে মহান আল্লাহ প্রিয় হাবীবের সমুন্নত মর্যাদার বর্ণনা সম্পর্কিত এ সূরা নাযিল করেছেন। [তাফসীর রুহুল বয়ান, কৃত: আল্লামা ইসমাঈল হক্কী (র.)]
বক্ষ বিদারণ:
বর্ণিত আয়াতে বক্ষ প্রশস্ত করার তাৎপর্য: অধিকাংশ তাফসীরকারদের বর্ণনা মতে “বক্ষ প্রশস্ত” দ্বারা “শক্কে ছদর” বা বক্ষ বিদারণ বুঝানো হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র তিন বা চারবার বক্ষ বিদারণের ঘটনা অসংখ্য হাদীসের নির্ভর যোগ্য বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। প্রথমবার, শৈশবকালে নবীজি যখন হযরত মা হালিমা সাদিয়ার তত্ত্বাবধানে ছিলেন তখন রাসূলুল্লাহর বয়স ছিল চার বৎসর।
দ্বিতীয় বার: বক্ষ বিদারণ দ্বিতীয়বার ঘটেছিল নবীজির দশ বছর বয়সে।
তৃতীয় বার: নবুওয়াত লাভের প্রাক্কালে সংঘটিত হয়। নবুওয়তের মহান দায়িত্বভার ধারণ করার ক্ষমতা সম্পন্ন করার জন্য বক্ষ বিদারণ হয়েছিল।
চতুর্থ বার: মি’রাজ রজনীতে উর্ধ্বজগতের আল্লাহর কুদরতী নিদর্শনাদি, দৃশ্যাবলী, জান্নাত-জাহান্নাম প্রত্যক্ষকরণ, সরাসরি আল্লাহর দিদার তথা সাক্ষাৎ লাভে সক্ষমতা অর্জন, আল্লাহর হিকমত ও মারিফত লাভে নবীজির পবিত্র সত্তাকে পূর্ণতা বিধানের জন্য আল্লাহ তা’আলা বক্ষ বিদারণ করেছেন। হাদীস শরীফের বর্ণনার আলোকে প্রমাণিত যে, হযরত জিবরীল আমীন (আলায়হিস সালাম) নবীজির পবিত্র বক্ষ মুবারককে বিদীর্ণ করে ক্বলব মুবারক বের করেছিলেন এবং তা স্বর্ণের পাত্রের মধ্যে রেখে জমজম পানি দ্বারা ধৌত করেন, অত:পর নূর হিকমত, মারিফত ও খোদা প্রদত্ত, দৃশ্য অদৃশ্য প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সর্বপ্রকার জ্ঞান বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ করে তা যথাস্থানে স্থাপন করে দিয়েছেন। [তাফসীর (হাশিয়া) খাযাইনুল ইরফান, সীরাতে ইবন হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ: ৫৬, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮ খ, পৃ: ২২২, যুরকানী শরহে মাওয়াহিব: ৬খ, পৃ: ২৪]
বোঝা নামিয়ে ফেলার তাৎপর্য: মক্কী জীবনে নবীজির ইসলাম প্রচারের মিশন চতুর্দিকে কাফির মুশরিকদের বাধা বিপত্তি চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হাচ্ছিল। এই কঠিন ক্রান্তিকালে নবীজির অন্তর অত্যন্ত ভারাক্রান্ত ছিলো, কাফিরগণ ঈমান না আনার কারণে নবীজির অন্তরে সর্বদা চিন্তা বিরাজ করতো অথবা গুনাহগার উম্মতগণের গুনাহ ক্ষমা করার চিন্তায় নবীজির কুলব মুবারক সর্বদা চিন্তিত থাকতো। মহান আল্লাহ তা’আলা নবীজিকে সুপারিশকারীর মর্যাদায় অভিষিক্ত করে নবীজীর অন্তরে বিরাজিত দু:খ বেদনা ও চিন্তার বোঝা আল্লাহ দূর করে দিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে হুযুরকে বড় বড় সমস্যার সম্মুখীন করা হুযুরের মর্যাদা বহি:প্রকাশ ঘটানোর জন্যই ছিল। নবীজির অগ্রযাত্রায় সকল বোঝা অপসারণ করে সাফল্য ও বিজয় সুনিশ্চিত করার জন্য আল্লাহ তা’আলা নবীজিকে সাহাবায়ে কেরামের এক বিশাল নিবেদিত উৎসর্গীত প্রাণ কাফেলা দান করেছেন। অথবা নবুয়তের মহান দায়িত্বাবলী পালনে আমি আপনাকে অন্তরের প্রশান্তি, দৃঢ় মনোবল, সুদৃঢ় বিশ্বাস, অদম্য সাহস, স্থিরতা অটলতা ও অন্তরের প্রশস্ততাসহ অপরিসীম নিয়ামতরাজি ও গুনাবলী দান করে আপনার চিন্তার বোঝাকে আমি আল্লাহ অপসারণ করেছি। (তাফসীরে নূরুল ইরফান)
বিভিন্নভাবে নবীজির সমুন্নত মর্যাদা:
১. মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সকল সম্মনিত নবী রাসূলগণের নিকট থেকে আমাদের রাসূলের উপর ঈমান আনার অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে।
২. সকল সম্মানিত নবীগণ ও ফিরিস্তারাজি দ্বারা নবীজির উপর দরুদ-সালাম পাঠ করানো হয়েছে।
৩. সৃষ্টিকুলে প্রত্যেক মহান ব্যক্তির স্মরণ চর্চা ও আলোচনা হয় জমিনে কিন্তু আল্লাহর প্রিয় মাহবুব সরকারে দোআলমের চর্চা গুণগান ও শান মানের আলোচনা হয় জমীনে, আসমানে ও জান্নাতের প্রতিটি স্তরে।
৪. শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা একমাত্র তাঁরই জন্য: সর্বত্র নবীজির নাম মুবারক, কলেমা, আজানে, ইকামতে, তাশাহুদে সর্বত্র আল্লাহর নামের সাথে নবীজির নাম মুবারক যুক্ত রয়েছে। এ জন্যই তো মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন, “হে মু’মিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর রাসূলের।” (সূরা: নিসা, আয়াত: ৫৯)
আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূলের আনুগত্যকে শর্তহীনভাবে অপরিহার্য করেছেন। এরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল অবশ্যই সে আল্লাহর আনুগত্য করল।” (সূরা: নিসা: আয়াত: ৮০)
আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছেন, “এবং যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে তারা অবশ্যই মহা সাফল্য অর্জন করবে। (সূরা: আহযাব, ৭১)
সোমবার নবীজির শুভাগমন: মহান আল্লাহই তাঁর রাসূলকে সম্মানিত করেছেন সকল সৃষ্টি তাঁরই ওসীলায় সম্মানপ্রাপ্ত হয়েছে। শুক্রবার মুসলমানদের জন্য সাপ্তাহিক ঈদের দিন, পবিত্র দিন, শ্রেষ্ঠ দিন। আল্লাহ এ দিনে নবীজিকে পৃথিবীতে প্রেরণ করলে লোকেরা বলতো শুক্রবারে শুভাগমনের কারণে নবীজি সম্মানিত হয়েছেন, শনিবার ইয়াহুদীদের পবিত্র দিন, রবিবার খৃষ্টানদের পবিত্র দিন, মঙ্গলবার মুশরিকদের শ্রেষ্ঠ দিন, এ দিনগুলোর কোনটিতে আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে প্রেরণ করেননি নবীজি এরশাদ করেছেন, “সোমবারেই আমি জন্ম নিয়েছি এ দিনেই আমার উপর পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।” (মুসলিম শরীফ)
নবীজির আগমনের ওসীলায় সোমবার দিবসটি মর্যাদামন্ডিত ও মহিমান্বিত হয়েছে। এভাবে প্রসিদ্ধ মাস মহররম, রমজান, জিলহজ্ব, প্রসিদ্ধ কোন মাসে নবীজির জন্ম হয়নি, বরঞ্চ রবিউল আউয়াল মাসে ধরাধামে নবীজির শুভাগমন হওয়ায় রবিউল আউয়াল মাস মর্যাদাপ্রাপ্ত ও মহিমান্বিত হয়েছে। এভাবে হাজারো নবী রাসূলদের স্মৃতি বিজড়িত পূণ্যময় স্থান বায়তুল মুকাদ্দাস শরীফেও নবীজির জন্ম হয়নি কেউ যেন এ কথা বলার সুযোগ না হয় বায়তুল মুকাদ্দাস এর পুণ্যময় স্থানে নবীজির জন্ম হওয়ায় তিনি সম্মানিত হয়েছেন। বরঞ্চ আরবের বালুকাময় মরু অঞ্চল ধূসর এলাকায় মক্কা মুকাররমায় নবীজিকে প্রেরণ করে আল্লাহ মক্কা নগরীর মর্যাদাকে বৃদ্ধি করেছেন। মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাসের পরিবর্তে নবীজির ওসীলায় খানায়ে ক্বাবা বায়তুল্লাহ শরীফকে ক্বিবলা হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে। [শানে হাবীবুর রহমান, কৃত: হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খাঁন নাঈমী (র.)]
কষ্টের সাথে স্বস্তি ও শান্তি আছে : বর্ণিত আয়াতে আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীজির প্রতি সুসংবাদ রয়েছে। নবীজির জন্য পরিপার্শ্বিক প্রতিকূল অবস্থা স্থায়ী হবেনা। অচিরেই সব সংকট কেটে যাবে দু:খ বেদনা কষ্ট বিপদ ও নানাবিধ সমস্যা দূর হয়ে যাবে। ফিরে আসবে স্বস্তি শান্তি বিজয় সাফল্য। হয়েছেও তা-ই। এটাই চিরন্তন বাস্তবতা, কঠোরতার পর প্রশস্ততা, অন্ধকারের পর আলো আসবেই, গরমের পর ঠান্ডা, অসুস্থতার পর সুস্থতা, হেমন্তের পর বসন্ত, জয় পরাজয়, হাসি-কান্না, ক্ষতির পর লাভ, দু:খ কষ্টের পরই রয়েছে আরাম ও প্রশান্তি। (তাফসীর নূরুল ইরফান)
সর্বশেষ আয়াতে রয়েছে নামায শেষে প্রভূর দরবারে দুআর নির্দেশনা: যেহেতু নামাযের পর দুআ কবুল হয়ে থাকে। সেহেতু নামাযের পর দুআ কবুল হয়ে থাকে, প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ মোল্লা আলী ক্বারী (র.) প্রণীত, মিরকাত শরহে মিশকাত এ উল্লেখ রয়েছে, নামায থেকে যখন অবসর হবেন, সালাম ফিরাবেন, প্রয়োজন পূরণের প্রত্যাশায় ভিক্ষুকের ন্যায় দু’হাত তুলে দুআ করুন। (মিরকাত শরহে মিশকাত, ২য় খন্ড, পৃ: ৪৮৪)
হে আল্লাহ আমাদের কে আপনার মকবুল বান্দাদের অন্তভূক্ত করুন, আপনার প্রিয় হাবীবের সর্বোচ্চ মর্যাদা বুঝার ও তাঁর পবিত্র জীবনাদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী);
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলিমদের অবদান
পরবর্তী নিবন্ধকরোনা উত্তর কালে মানব সম্পদ উন্নয়নের বিকল্প নেই