প্রত্যেক মানুষের জীবনই অমূল্য। এ নিয়ে দ্বিমত-বিতর্কের কোনোই অবকাশ নেই। প্রত্যেক মানুষই নিজ নিজ জীবনকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান মনে করে। সেটা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি বাস্তবিকও। মানুষ নিজের জীবনকে মূল্যহীন এবং ভালোবাসে না, সেটা একমাত্র মানসিক রোগীর ক্ষেত্রেই বিবেচনা করা যায়। নিজের জীবনকে নিরাপদ ও সুরক্ষায় সবাই কম-বেশি তৎপর থাকে। কিন্তু বাস্তবতার কষাঘাতে সেটা সামষ্টিক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। আমাদের মোট জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠদের ক্ষেত্রে যে সম্ভব হয় না সেটা তো আমরা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করে থাকি। যে জীবন অমূল্য-সে জীবন বাঁচাতেই বেছে নিতে বাধ্য হয় অনিরাপদ-ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। আমাদের শ্রেণি বিভাজিত সমাজে শ্রেণিভেদে মানুষের জীবন নিয়ে বৈষম্য বৈপরীত্য নিশ্চয় রয়েছে। যার মূলে শ্রেণিগত অবস্থান এবং ওই শ্রেণিগত অবস্থানের কারণেই জীবিকার প্রয়োজনে মেহনতিরা বাধ্য হয় অনিরাপদ-ঝুঁকিপূর্ণ পেশা গ্রহণে। এ কারণে নানা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর ঘটনা অহরহ ঘটে। এই দুর্ঘটনাকে কেবল দুর্ঘটনা বিবেচনা করে দায়-দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবার উপায় থাকার কথা নয়; যেমন রাষ্ট্রের, সরকারের, তেমনি শিল্পপতি-বণিক শ্রমিকের রক্ত চুষে অর্জিত মুনাফাভোগীদের। অহরহ ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় নিরপরাধ শ্রমিকদের অপমৃত্যুর জন্য সংশ্লিষ্টদের বিচার-শাস্তি তো পরের কথা, দায়ীদের ক্ষেত্রে সর্বত্রেই ঘটে চরম নির্লিপ্ততা এবং নীরবতা পালন। দুর্ঘটনা এড়াতে নেয়া হয় না কোনোই নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ। মুনাফাবাজদের মুনাফা প্রাপ্তিতে ঝুঁকিপূর্ণ ওই সকল পেশায় প্রাণ বিসর্জন দিতেই যেন জন্ম নিয়েছে অসহায় মেহনতি-শ্রমিকেরা।
নির্মাণ, শিল্প, গার্মেন্টস্ সেক্টর, শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড হতে উন্নয়নের মহাযজ্ঞে প্রাণ হারায় কর্মরত শ্রমিক, যাদের রক্ত-ঘাম ও জীবনের বিনিময়ে ঘটে তথাকথিত উন্নয়ন। পুঁজিবাদী উন্নয়নে প্রাণ বিসর্জন দেয়া শ্রমিকদের জীবন হারানোকে স্রেফ দুর্ঘটনা অবহিত করে পরিত্রাণ পেয়ে যায় ব্যক্তিমালিকানাধীন পুঁজিবাদী উন্নয়নের দাবিদার মুনাফাবাজ চক্র। এই চক্র আমাদের শাসকশ্রেণির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই মানুষের অস্বাভাবিক অপমৃত্যুরোধকল্পে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের বিপরীতে দায়মুক্তি দেয়ার সংস্কৃতি অবিচল রয়েছে। জীবন রক্ষায় একমাত্র মজুরি-প্রাপ্তিতে অনিরাপদ-ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যুক্ত শ্রমিকরা অকাতরে জীবন বিসর্জন দিয়ে থাকে। তাদের জীবনকে সঙ্গত কারণে অমূল্য ভাবার অবকাশ আর থাকে না। আমাদের মুনাফালোভীরা তাদের নির্মাণ, শিল্প-কারখানা, গার্মেন্টস শিল্প, শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড হতে নানামুখী পুঁজিবাদী উন্নতি ও উন্নয়ন কর্মতৎপরতায় অপরিহার্য জনশক্তি শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে আগাগোড়াই উদাসীন। তারা মুনাফা বোঝে আর কিছু বোঝে না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে অবদান রাখা গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও দেখা যায় মালিকপক্ষের চরম দায়িত্বহীনতা। রানা প্লাজা, তাজিন গার্মেন্টসসহ অসংখ্য গার্মেন্টসে প্রাকৃতিক নয়, মালিকদের দায়িত্বহীনতায় প্রাণ দিতে হয়েছে অগণিত শ্রমিককে। যারা ওই মুনাফাবাজদের মুনাফা লাভের প্রধান হাতিয়ার, সেই শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে মুনাফাভোগীরা ন্যূনতম নিরাপত্তা দিতে পারেনি। বিপরীতে ঠেলে দিয়েছে দুর্ঘটনা নামক মৃত্যুর মুখে। মুনাফাবাজদের মুনাফার বলিরপাঁঠা অগণিত শ্রমিকের মৃত্যুতেও রাষ্ট্র-সরকার আগাগোড়া নির্বিকার-নির্লিপ্ত থেকেছে। এই নীরবতাই ওই মালিকপক্ষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে শাসক শ্রেণির যুক্ততা নিশ্চিত করেছে। ওই যে বলেছি আমাদের শাসকশ্রেণির অবিচ্ছেদ্য অংশ আমাদের মুনাফাভোগীরা, এটা তারই দৃষ্টান্ত বটে। সাধারণ ভাবে দুইপক্ষ মনে হলেও বাস্তবে দুইপক্ষ কিন্তু একপক্ষই বটে। এরাই স্বাধীন দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। রাষ্ট্রে, সরকারে, বাণিজ্যিক পরিমণ্ডলে, অর্থনৈতিক শোষণে এই-সংখ্যালঘু শাসকশ্রেণিই শাসন-শোষণ চালিয়ে এসেছে স্বাধীনতার ৪৯ বছর ধরে।
আমাদের কৃষকেরা কৃষিপণ্য উৎপাদনে আমাদের খাদ্য-নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে। অথচ কৃষকেরা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বরাবরই বঞ্চিত। বিকল্প কর্মসংস্থান নেই বলেই নিরুপায়ে কৃষকেরা আধপেট খাবার খেয়ে দেশবাসীর খাদ্য চাহিদা পূরণ করে। মাঠের ফসলের মূল্য আর ভোক্তাদের ক্রয়কৃত মূল্যের বিস্তর ব্যবধানে যুক্ত মধ্যস্বত্বভোগী চক্র। যারা কৃষিপণ্য থেকে নানা উপায়ে মুনাফা লাভ করলেও উৎপাদক কৃষকেরা থাকে বঞ্চিত। শীত, গরম, বর্ষা গায়ে নিয়ে কৃষক অত্যধিক কায়িক পরিশ্রমেও উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না। অনিয়ম-অতিপরিশ্রমে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মরণাপন্ন ব্যাধির মুখে পড়তে হয় কৃষকদের। ফসলের মাঠে কর্মরত কৃষকদের বজ্রপাতে প্রাণ হারানোর ঘটনাও প্রায় ঘটে। কৃষকদের জীবিকা যে ঝুঁকিমুক্ত সেটাও কিন্তু বলা যাবে না। তাদের জীবন ও জীবিকা নিরাপদ নয়।
সমষ্টিগতদের জীবন বিদ্যমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাধীনে মূল্যহীন। তাই জীবন অমূল্য বলা হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে শ্রেণি বিভাজনে সকল মানুষের জীবন অমূল্য নয়। মানুষের জীবন অমূল্য কিংবা মূল্যহীন সেটা শ্রেণি বিভক্ত সমাজে শ্রেণি বৈষম্যের ন্যায় বিভাজিত এবং নির্ধারিত। সংখ্যালঘুর জীবন অমূল্য, অপরদিকে সমষ্টির জীবন মূল্যহীন। এই সত্যটি অপ্রাসঙ্গিক তো নয়ই, বরং আমাদের বিদ্যমান সমাজে অতিমাত্রায় জাজ্বল্যমান। প্রশ্ন থাকে সকল মানুষের জীবন অমূল্য সেটার বাস্তবায়ন কিভাবে সম্ভব? সম্ভব তো অবশ্যই। তবে উদারবাদী কিংবা এনজিওদের সংস্কারের কর্মসূচিতে সম্ভব হবে না। সমাজ কাঠামোকে অপরিবর্তিত রেখে যতই সংস্কার করা হোক না কেন ভিত শক্ত-পোক্ত না হলে যেমন স্থাপনা টিকতে পারে না। ঠিক তেমনি পুরো সমাজ কাঠামোকে পুনর্নির্মাণ করতে হবে বিদ্যমান কাঠামোকে ভেঙে। সমাজ কাঠামোর এই ভাঙা-গড়ার মধ্যে যেমন সকল মানুষের জীবন অমূল্য হয়ে উঠবে, পাশাপাশি সকল মানুষের অধিকার ও সুযোগের সমতাও প্রতিষ্ঠিত হবে। এছাড়া বিকল্প ভাবনার যে অবকাশ নেই।
২
কারোনাকালে আমাদের কাছে এই সত্যটি উন্মোচিত হয়েছে। আমাদের বিত্তবান শ্রেণির দেশের চিকিৎসা নেবার নজির তেমন নেই। বিশ্বজুড়ে করোনাকালে বিদেশে ছুটতে না পেরে অগত্যা তারা বিশ্বমানের বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে ছুটেছে। ওই বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো যে মুনাফার কসাইখানা সেটারও অজস্র প্রমাণ পাওয়া গেছে। চিকিৎসা-বাণিজ্যের কবলে আমাদের বিত্তবানদেরও ত্রাহি অবস্থা। টাকা ঢালছে কিন্তু আশানুরূপ চিকিৎসা পাচ্ছে না। চিকিৎসার নামে চলছে তুঘলকি কাণ্ড-কারখানা। সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে অসহায় মানুষ বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারাচ্ছে। ওদিকে বিত্তবানরাও তথাকথিত বিশ্বমানের চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে অজস্র অর্থের বিনিময়েও চিকিৎসার নামে প্রতারণার শিকার হয়ে চলেছে। সরকারি বা রাষ্ট্রের কোনোই হস্তক্ষেপ আমরা দেখি না। ব্যতিক্রম ভাবে দু’চারজনের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যারা কোন না কোন ভাবে শাসকশ্রেণি সংশ্লিষ্ট। এছাড়া সিংহভাগ তো ধরাছোঁয়ার বাইরে বহাল তবিয়তে করোনাকালের সুযোগে অর্থ-বিত্তের পাহাড় গড়ে তুলছে। তাদের স্পর্শ করা যায় নি, যাবেও না। কেননা তারা যে শাসকশ্রেণির অভিচ্ছেদ্য অংশ।
করোনায় আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার সামগ্রিক দৈন্যের চিত্রটি উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। বিশ্বের কোথাও এমন অমানবিক মুনাফা-নির্ভর চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে বলে জানা নেই। আমাদের সামগ্রিক অব্যবস্থার জাজ্জ্বল্যমান প্রতীক স্বাস্থ্যসেবা। সকল ক্ষেত্রে যেমন স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও তথৈবচ। তাই জীবনের মূল্য আমাদের কিরূপ সেটা আর ঘটা করে বলার প্রয়োজন হয় না। দেশের প্রতিটি মানুষকে এই আপদকালীন সময়ে নিজেদের বাঁচার পথ, খাদ্য-নিরাপত্তার বিষয়টি যেমন নিজেদেরই করতে হচ্ছে। রাষ্ট্র ও সরকারের কোনরূপ সহায়তা ব্যতিরেকে। তাই করোনাকালের স্বাস্থ্যবিধি মানার বলাই কেউ ধারছে না। জীবিকার প্রয়োজনে অনাহারী মানুষেরা পরিবার বাঁচাতে করোনা উপেক্ষা করে জীবিকায় এক প্রকার ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অপর দিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চলছে কর্মচারী কর্মকর্তা ছাঁটাইয়ের হিড়িক। মানুষের বেঁচে থাকা, টিকে থাকা ক্রমেই কঠিনতর হয়ে পড়েছে। জীবনের মূল্য যে কত ঠুনকো, মূল্যহীন সেটা সামগ্রিক বিষয়কে পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝতে অসুবিধা হয় না। অথচ প্রতিটি মানুষের জীবনই সর্বাধিক মূল্যবান। যেটা আমাদের দেশে কল্পনারও অতীত।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত