এক্ইসউনুস: আচ্ছা, হিন্দু-মুসলমান যদি একই অফিসে বসে কাজ করতে পারে, তাহলে একই বাড়িতে বসবাস করতে অসুবিধা কোথায়? তাছাড়া ওদের আমরা দীর্ঘদিন ধরে চিনি, ওরা আমাদের সহকর্মী।
মোদাব্বের : ঐ চেনাজানায় কিছু হয় না ইউনুস মিয়া, কিচ্ছু হয় না। যেখানে থাকতে, সেখানকার মানুষগুলোকেও কি কম চিনতে? কিন্তু, দেখলেই তো! সময়কালে সবাই কেমন বইদলে গেল! এখন সময়টা খারাপ। যে কোনো সময় বিপদ-আপদ হতি পারে।
ইউনুস: আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না তো! এদের দুজনের দ্বারা আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না।
মোদাব্বের: শোনো, তেলে আর পানিতে কখনো মিশ খায় না, বুঝলা? ইউনুস : না, আমি আপনার কোনো কথাই বুঝতে পারছি না।
মোদাব্বের: বুঝবা ইউনুস মিয়া, একদিন ঠিকই বুঝবা। কিন্তু, সেদিন আর কিছুই করতি পারবা না। (ঘরের ভেতর থেকে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলো প্রশান্ত, মাহমুদ আর শুভেন্দু)
প্রশান্ত: আজকের খবরের কাগজ পড়েছো?
মাহমুদ: না তো! কেন, জরুরি কোনো খবর আছে নাকি?
প্রশান্ত: এখন তো সবই জরুরি। আমাদের নেতাদের হাবভাব তো ভালো ঠেকছে না।
শুভেন্দু: আরে, তারা তো গদির স্বপ্নে বিভোর। বৃটিশ কখন ক্ষমতা ছেড়ে যাবে, আর কখন তারা ক্ষমতার হালুয়া-রুটি ভাগ করবে!
ইউনুস : জনগণের কথা চিন্তা করার সময় কোথায় তাদের?
ঘাবড়াবেন না পাঠক। উপর্যুক্ত কথোপকথন এখনকার নয়, ঊনিশশ ছেচল্লিশ সালের। সাতচল্লিশের দেশভাগের প্রাক্কালে দাঙ্গাবিক্ষুব্ধ পরিস্থিতির শিকার উদ্বাস্তুপ্রায় কয়েকজন ব্যক্তির দৈনন্দিন কড়চা। পাওয়া যাবে কথক থিয়েটারের ‘অস্পৃশ্য’ নাটকে। নাকটির আখ্যান পাওয়া যাবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১) রচিত দেশভাগের ঘূর্ণাবর্তের পটভূমিকায় ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ গল্পে। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্পগ্রন্থ ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থে একটি তুলসী গাছের কাহিনী সংকলিত। গল্পটি অবলম্বনে শিবলু চৌধুরী রচিত এবং অকালপ্রয়াত নাট্যজন শোভনময় ভট্টাচার্য (১৯৫৮-২০০৫) নির্দেশিত ‘অস্পৃশ্য’ নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন হয় ২০০০ সালের ৮ ডিসেম্বর । নাটকটির নির্দেশক কথক থিয়েটারের প্রাণপুরুষ শোভনময় ভট্টাচার্যের মৃত্যুর পরও নাটকটির মঞ্চায়ন অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেছে সংগঠনটি। বিভিন্ন কারণে মঞ্চায়নে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ২০২০ সালে এসে অতিমারী কোভিডজনিত কারণে আবার মঞ্চায়ন স্থগিত হয়ে যায়। সর্বশেষ গত ১২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে নাটকটির ষোলতম মঞ্চায়ন সম্পন্ন হয়। দেশভাগের ঘূর্ণাবর্তে কয়েকজন সরকারি কর্মচারি কলকাতা থেকে এসে ঢাকা শহরে আশ্রয় নেয়। আশ্রয় নেয় একটি পরিত্যাক্ত বাড়িতে। তারা কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান। বাড়িটি ছিল একটি হিন্দু বাড়ি, যারা দেশভাগের দাবানলে এই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। বাড়িটি যে হিন্দুবাড়ি তা নিশ্চিত হয় মোদাব্বের কর্তৃক উঠানের এক কোনায় একটি তুলসী গাছ আবিষ্কার হওয়ার মাধ্যমে। তুলসী গাছটি উপড়ে ফেলা এবং উপড়ে না ফেলা নিয়ে বাকবিতন্ডা, উপড়ে ফেলার দায়িত্ব কেউ না নেয়া, একে অন্যের অলক্ষ্যে তুলসী গাছের গোড়ায় পানি দেওয়া, গাছটির আবার সতেজতা প্রাপ্তি, সরকার কর্তৃক বাড়িটি অধিগ্রহণ করার পর আশ্রিত সবার পুনঃউদ্বাস্তু অবস্থা, আবার তুলসীগাছে পানি দেয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং তুলসী গাছটির আবার মৃতপ্রায় পরিণতি- এই কাহিনী সবার জানা। কিন্তু, নাটকে আরেকবার চোখ ফেরানো যাক-
মোদাব্বের: খবরদার, ওই নাপাক গাছ তুমি ধরতি পারবা না মাহমুদ মিয়া।
মাহমুদ: তুলসী গাছ নাপাক জিনিস! এসব কি বলছেন মোদাব্বের ভাই? মোদাব্বে: হ্যাঁ, যা বলছি ঠিকই বলছি। ওটা উপড়ি ফেলতি হবে। মাহমুদ: কিন্তু তুলসী গাছ নাপাক হলো কি করে তা তো বুঝলাম না! মোদাব্বের: ওই গাছে হিন্দুরা পূজা দেয়, তা তুমি জান না?
মাহমুদ: তাহলে আমরা মুসলমানেরা যে মেহেদী ব্যবহার করি, তাতে কি মেহেদী গাছ হিন্দুদের কাছে অস্পৃশ্য হয়ে যাবে? আর এই তুলসী গাছটি যদি নাপাক হয়, তবে এই বাড়ি-ঘর, এর জিনিসপত্র এমনকী যে থালা-বাসনে আমরা গত দুদিন ধরে খাওয়া-দাওয়া করেছি, সবই তো নাপাক! তা হলে তো আমাদের এই মুহূর্তেই এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। ইউনুস: আমি বলি কি মোদাব্বের ভাই। গাছটা উপড়াবার কি দরকার! আমরা তো আর এতে পূজা দিচ্ছি না। বরং বাড়িতে একটা তুলসী গাছ থাকা ভালো। সর্দি-কফে তার পাতা বড়ই উপকারী।
মোদাব্বের: অত কথা বুঝি না। ওই গাছ উপড়ি ফেলতি হবি। আমরা যখন এই বাড়িতে এইসে উঠেছি, তখন এইখানে কোনো হেন্দুয়ানির চিহ্ন আর সহ্য করা হবি না।
মাহমুদ: এই বাড়িতে আরও তিনজন হিন্দু লোকও রয়েছেন। তাদের কথাটা ভেবেছেন?
এভাবে নাটকটি দ্বন্দ্বমুখর হয়ে উঠে। গল্পে না থাকলেও নাটকীয়তার প্রয়োজনে নাট্যরূপদানকরী গল্পের তুলসী গাছের সমান্তরালে শেফালী নামক একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন, যা সুপ্রযুক্ত হয়েছে। আগেই বলেছি ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ গল্পের নাট্যরূপ নয়, গল্প অবলম্বনে নাটক ‘অস্পৃশ্য’। নাটকে শেফালী দেশভাগ-দাঙ্গার শিকার সব হারানো এক তরুণী। এই বাড়ির আশ্রিতগণ পরম যত্নে যাকে আশ্রয় দিয়েছে। বিরোধীতা করেছে শুধু তুলসী গাছে হিন্দুয়ানি গন্ধ পাওয়া মোদাব্বের। গল্পে তুলসীগাছের শেষ পরিণতির চেয়েও অনিশ্চিত পরিণতি নাটেকর শেফালী চরিত্রের।
অস্পৃশ্য নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন উত্তম বিশ্বাস, মুহাম্মদ শাহ আলম, নারগিস চৌধুরী, অনুপম পাল, সৈকত নাথ, অনুপম চক্রবর্তী, তুহিনা মুনা, ওবায়দুল হক সাগর ও সুব্রত পাল। আলোক প্রক্ষেপনে সালাউদ্দিন বাপ্পী, আবহ প্রয়োগে চয়ন বিশ্বাস, রূপসজ্জায় শাহীনূর সরোয়ার, ব্যবস্থাপনায় জয় প্রকাশ চৌধুরী, নিলয় মুহাম্মদ, সুশান্ত সেন, নিউটন ও রাসেল। অভিজ্ঞ অভিনেতা মুহাম্মদ শাহ আলম চরিত্রানুগ অভিনয় করার চেষ্টা করেছেন। অপর অভিজ্ঞ অভিনেতা উত্তম বিশ্বাসের প্রকৃত অভিনয় উপভোগ থেকে দর্শক বঞ্চিত হলো। মঞ্চে উত্তম বিশ্বাস একজন আস্থাভাজন অভিনেতা। স্বল্প ব্যাপ্তির চরিত্র হলেও নারগীস চৌধুরীর দীর্ঘদিন পর মঞ্চে উঠা অনুপ্রাণিত করবে অনেককে। নাট্যকার সৃষ্ট শেফালী চরিত্রটির মঞ্চে উপস্থিতি স্বল্প সময়ের জন্য। চরিত্রটিতে তুহিনা মুনার সংযত ও পরিমিত অভিনয় দর্শকহৃদয়ে দাগ কেটেছে। অন্য চরিত্রগুলো রূপদানকারী শিল্পীগণ অপেক্ষাকৃত নবীন। মঞ্চে তাঁদের কাজ আগে খুব একটা দেখার সুযোগ হয়নি। এই নাটকেও তাঁরা প্রথমবারের মতো মঞ্চারোহন করেছেন। তাই কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি দেখা গেছে। আশা করি ভবিষ্যতে শুধরে নেবেন। আলোক ও আবহ পরিকল্পনা যথাযথ। তবে প্রয়োগে কখনো কখনো সময়ক্ষেপন হয়েছে। বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় দৃশ্যে আলোক প্রক্ষেপনে সময়ক্ষেপন হয়েছে।
এখন গল্প থেকে একটু পাঠ নেয়া যাক ‘আজ যে তুলসী গাছের তলে ঘাস গজিয়ে উঠেছে, সে পরিত্যাক্ত তুলসী গাছের তলেও প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় কেউ প্রদীপ দিতো। আকাশে যখন সন্ধ্যাতারা বলিষ্ঠ একাকিত্বে উজ্বল হয়ে উঠতো, তখন ঘনায়মান ছায়ার মধ্যে আনত সিঁদুরের নীরব রক্তাক্ত স্পর্শে একটি শান্ত-শীতল প্রদীপ জ্বলে উঠতো প্রতিদিন।… কয়েকদিন পরে রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় তুলসী গাছটা মোদাব্বেরের নজরে পড়ে। সে একটু বিস্মিত না হয়ে পারে না। তার তলে যে আগাছা জন্মেছিল, সে-আগাছা অদৃশ্য হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়। যে গাঢ় সবুজ পাতাগুলো শুকিয়ে খয়েরি রং ধারণ করেছিল, সে পাতাগুলি কেমন সতেজ হয়ে উঠেছে। সন্দেহ থাকে না যে, তুলসী গাছটির যত্ন নিচ্ছে কেউ। খোলাখুলিভাবে না হলেও লুকিয়ে-লুকিয়ে তার গোড়ায় কেউ পানি দিচ্ছে। মোদাব্বেরের হাতে তখন একটি কঞ্চি। সেটি সাঁ করে কচুকাটার কায়দায় সে তুলসী গাছের ওপর দিয়ে চালিয়ে দেয়। কিন্তু ওপর দিয়েই। তুলসী গাছটি অক্ষত দেহেই থাকে।’
ক্ষমতা, হালুয়া-রুটির ভাগ, দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও সম্প্রীতির প্রামাণ্য দলিল সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’। গল্পটি অবলম্বনে প্রায় বাইশ বছর আগে অস্পৃশ্য প্রথম মঞ্চে আনে কথক থিয়েটার। তখন যেমন প্রাসঙ্গিক ছিল এই গল্প ও নাটক, এখনো প্রাসঙ্গিক। নানা কারণে ও কাণ্ডে। গল্পটি যেমন কালজয়ী, আশা করি নাটকটিও কালজয়ী হবে। গল্পকার গল্পটি সমাপ্ত করেছেন এভাবে- ‘উঠানের শেষে তুলসী গাছটা আবার শুকিয়ে উঠেছে। তার পাতায় খয়েরি রং। সেদিন পুলিশ আসার পর থেকে কেউ আর তার গোড়ায় পানি দেয়নি। সেদিন থেকে গৃহকর্তীর ছলছল চোখের কথাও আর কারো মনে পড়েনি। কেন পড়েনি সে তুলসী গাছের জানবার কথা না, মানুষেরই জানবার কথা।’
বুঝলাম, গল্পের তুলসীগাছের পরিণতি মানুষের জানবার কথা। কিন্তু নাটকে তুলসীগাছতূল্য শেফালীর পরিণতি কি মানুষ জানতে পেরেছে? কেউই তাকে সাথে নিতে চায় না, দায়িত্ব নেয়া তো দূরে থাক। অসহায় শেফালীর শেষ সংলাপ দিয়ে শেষ করছি-
মাহমুদ: আমরা ভীতু? কি বলছো তুমি?
শেফালী: হ, ঠিকই কইতাছি। আপনেরা ভীতু না হইলে পালাইয়া আইতেন না।
প্রশান্ত: কি করতে পারতাম আমরা?
শেফালী: অনেক কিছু, অনেক, অনেক। এখন চইল যান। নিজের যান বাঁচান গিয়া। আমার কথা চিন্তা কইরতে হইবো না।
শুভেন্দু : তোমার জন্য কষ্ট হয়। তবু উপায় নেই। চল্লাম।
শেফালী: যান্ যান্। আপনেগো মুখ দেখার ইচ্ছা আমার নাই। (সবাই আস্তে আস্তে হেঁটে বেরিয়ে যায়। শেফালী যায় তুলসী গাছের কাছে) শেফালী : কারো কারো কাছে তুই অস্পৃশ্য। আর আমরা? আমরা এই দুনিয়ার বেবাগতের কাছেই অস্পৃশ্য। তোর আর আমার মাঝে আইজ আর কুনো পার্থক্য নাই। তোর মতো আমিও আইজ নিরাপত্তাহীন, আশ্রয় ছাড়া এক পতিত। সৃষ্টিকর্তার হাতে তৈয়ার হইয়াও আমরা এই সৃষ্টিকুলের কাছে অস্পৃশ্য।’
নাট্যকর্মী, সম্পাদক, নাট্যমঞ্চ