জনস্বাস্থ্যখাতে বৈশ্বিক নেতৃত্বের স্থান যুক্তরাষ্ট্রের হারাবার কারণসমূহ নিয়ে আজকের আলোচনা। ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র যে কোনো বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থায় সবচেয়ে বেশি অর্থ ও কূটনৈতিক সহযোগিতা দিয়েছে বলে জানান বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জেনিফার কেটস। তিনি বলেন, গত কয়েক দশক ধরে এ খাতে যুক্তরাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তগুলোকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নেওয়ার ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের কারণে জনস্বাস্থ্যখাতে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার স্থান হারিয়েছে।
জাতিসংঘ ক্রমেই খেলনা পুতুলে পরিণত হচ্ছে। দিন দিন শক্তি ও প্রভাব হারাচ্ছে সংস্থাটি। করোনা পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ আস্থার প্রতিদান দেয়ার সুযোগ হারিয়েছে। পরাশক্তির উপর জাতিসংঘের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর পরেও জাপান, কানাডা, ভারত, অষ্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, জার্মানী, ইন্দোনেশিয়া বা আফ্রিকা মহাদেশের কোনো দেশের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হওয়া সম্ভব হয়নি। আর মহামূল্যবান ভেটো ক্ষমতার অধিকারী হয়ে আগের পরাশক্তিরাই ছড়ি ঘুরিয়েছে বিশ্বব্যাপী। অথচ ছড়িটি থাকার কথা ছিল জাতিসংঘের হাতে।
আমেরিকা ক্রমেই মিত্রহীন হয়ে উঠছে। করোনাকালে কোনো পূর্ব নোটিশ ছাড়াই ইউরোপের সঙ্গে বিমান চলাচল প্রত্যাহার করে নিয়েছে আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি মিত্রদের অনাস্থা বাড়ছে। “মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে জার্মান প্রেসিডেন্টের বক্তব্য-‘আমাদের সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ধারণায় বিশ্বাস করেনা [ প্রথম আলো, ০৭–০৫–২০ ]।”
এককেন্দ্রিক বিশ্বে নেতৃত্ব কেন যুক্তরাষ্ট্র হারাতে পারে? গত কয়েক বছরে চীন ও রাশিয়ার আলাদা প্রভাব বলয়ের সৃষ্টি হয়েছে। ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থার অবনতি হয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তহীনতা এর অন্যতম কারণ। ট্রাম্প একবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে দোষারোপ করছিলেন, আবার বলছিলেন ঘরে বসে অননুমোদিত ওষুধ খেতে। মহামারীকালীন পরিস্থিতিতে বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।
ট্রাম্পের বিবিধ কার্যকলাপে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহ গুরুত্ব হারিয়েছে। ন্যাটোর কার্যকলাপ নিয়ে বারংবার প্রশ্ন তুলে যাচ্ছিলেন ট্রাম্প। ডাব্লিউটিএ কে পাশ কাটানো হচ্ছিলো। নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহের গুরুত্ব হারানোর ফলে পৃথিবীতে নেতৃত্বের সংকট তৈরী হচ্ছিলো।
বৈশ্বিক অতিমারী করোনা বিশ্বের নেতৃত্ব পরিবর্তন করেছে। চীনের উত্থান ঘটছে। পরিবর্তনবাদীদের পক্ষ থেকে যে দাবীটি তোলা হচ্ছে তা হলো ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় বৈশ্বিক নতুন মোড়লের উত্থান তখনই হয়েছে যখন বিশ্বব্যাপী কোনো ইতিহাসের গতি পরিবর্তনকারী ঘটনা মঞ্চস্থ হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বৈশ্বিক রাজনীতিতে ফ্রানস দুর্বল হয়ে যায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটেনের কাছে এবং ব্রিটেন বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে একক পরাশক্তি হিসেবে আবিভর্’ত হয়।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ন প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি হয়ে উঠে এবং সুয়েজ খাল সংকটকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনের ভুল পদক্ষেপ আমেরিকাকে বৈশ্বিক নেতৃত্বে নিয়ে আসে। করোনা সংকটের ভুরাজনৈতিক প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী যে এটি ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সবচেয়ে বড় ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। করোনা মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র যে অপরিনামদর্শীতার পরিচয় দিয়েছে তারই সূত্র ধরে অনেকে পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে চীনের উত্থানের কথা ভাবছে।
একক নেতৃত্বের আধিপত্য জরুরি। বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলাটিকে মসৃণভাবে চালানোর জন্য আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলায় একটি একক নেতৃত্বের আধিপত্য জরুরি– তবেই শৃঙ্খলাটি স্থিতিশীল থাকবে। আর বর্তমান নেতৃত্বের পতন কিংবা নতুন নেতৃত্বের উত্থান আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলাটিকে অস্থিতিশীল করে তোলে।এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় মূলতঃ ক্ষীয়মান নেতৃত্বের আক্রমণাত্মক আচরণের কারণে, যেখানে তারা শৃঙ্খলাটিকে সচল রাখতে তাদের যে বিনিয়োগ তার লাভ বুঝে পেতে চায়, যার আভাস আমাদের মধ্যে ইতিমধ্যে স্পষ্ট– বড় দুই অর্থনীতির বাণিজ্যযুদ্ধ আর করোনাকালে ট্রাম্পের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় অর্থায়ন প্রত্যাহারের ঘোষণায়। বিপরীতে স্বাস্থ্য সংস্থায় চীন তিন কোটি ডলার অনুদান দেয়।
বিশ্ব নেতৃত্বে আলাদা বলয়ের সৃষ্টি হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পুরো বিশ্বব্যবস্থাকে এককেন্দ্রিক করে তুলেছিল। সেই বৃত্তের কেন্দ্রে ছিল শুধুই যুক্তরাষ্ট্র। গত কয়েক বছরে সেই বৃত্তে আলাদা বলয় সৃষ্টি করেছে চীন ও রাশিয়া।
যুক্তরাষ্ট্র চীনকে বেশি দিন ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। জো বাইডেন কুটনৈতিক শর্ত আরোপ করেছেন। ‘বাইডেন প্রশাসন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র বা হবু মিত্র হওয়ার শর্ত হচ্ছে, তাদেরও চীনকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ভবিষ্যতের জন্য প্রধান প্রতিদ্বন্ধী বলে মনে করছে। যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশকে একটা উভয় সংকটে ফেলে দিয়েছে। চীন এ সব দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সহযোগী ও প্রধান বিনিয়োগকারী। বেল্ট এন্ড রোডস প্রকল্পের আওতায় তাদের অবকাঠামো তৈরীর প্রধান সহায়ক এখন চীন। যুক্তরাষ্ট্র তাদের আধিপত্য খুইয়ে ফেলুক, এমন কোনো কিছু করার আগ্রহ নেই চীনের। চীনের সম্পর্কে বন্ধুত্ব করার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যাবে না এমন কোনো শর্তও কাউকে দেয়নি চীন। বেইজিং এর পররাষ্ট্র কুটনীতি এমন যে কোনো দেশের পক্ষে একই সঙ্গে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা সহজ। অন্যদিকে মার্কিন জোটের সহযোগী দেশ হতে গেলে বেইজিং এর সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করার অংগীকার করতে হবে। মেঙিকো সহ লাতিন আমেরিকার অনেক দেশই এ কারণে জুন, ২০২২ লস এঞ্জেলসে অনুষ্ঠিত আমেরিকান সম্মেলনে যোগ না দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল [প্রথম আলো, ২৩–০৬–২২ ]।’
চীনকে অভিযুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের দাবী প্রমাণিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, চীন পরাশক্তি হয়ে উঠার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে তাদের ল্যাবরেটরি থেকে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে। পক্ষান্তরে চীন বলছে যে, চীনকে দুর্বলতর করার জন্য অলিম্পিক গেমের সময় যুক্তরাষ্ট্র চীনে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে। এই দুই দেশের পাল্টাপাল্টি দুই দাবীর মধ্যে কোনটা সঠিক তা খতিয়ে দেখা হয়েছে। আসলে এর পেছনে রয়েছে বড় ধরনের রাজনৈতিক অর্থনীতি। এই অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক অর্থনীতিটা সাধারণ মানুষের উপলব্ধির বাইরেই থেকে যায়।”এ সম্পর্কে ’স্ক্রিপস রিসার্চ ইনসটিটিউট’ কোভিড–১৯ এর জিন কাঠামো নিয়ে গবেষণা করে প্রমাণ করেছে যে, করোনা ভাইরাস ল্যাবরেটরিতে উৎপাদন করা সম্ভব নয়। অতএব এর উদ্ভব ঘটেছে নিজে নিজে প্রাকৃতিক রূপান্তর বা মিউটেশনের মাধ্যমে। অর্থাৎ এই করোনা ভাইরাস সৃষ্টির পেছনে কোনো দেশেরই হাত ছিল না। এটি নতুন ধরনের একটি ভাইরাস পরিবার। তবে ’ল্যানসেট’ জানিয়েছে যে, ৪৩ জন করোনা রোগীর মধ্যে ১৩ জন রোগী ছিল উহান প্রদেশের বাইরের এবং এদের করোনা ভাইরাস এর উৎপত্তিস্থল চীনের উহান প্রদেশের কোনো করোনা রোগীর সংস্পর্শ ছিল না কিংবা সেখানের ’ওয়েট মার্কেট’ এর সাথেও তাদের কোনো যোগসূত্র ছিল না। উহানের ওছেঁ মার্কেট হচ্ছে একটি স্থানীয় ছোট মাছ বাজার। অনেক গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে উহানের এই ওয়েট মার্কেট থেকেই বিশ্বব্যাপী এই করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে। কিন্তু ‘স্ক্রিপস রিসার্চ ইনসটিটিউট ’ সেই ওয়েট মার্কেট সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে মিউটেশনের মাধ্যমে কোভিড–১৯ ও এর জিন কাঠামোর যেভাবে উদ্ভব ঘটেছে তার জন্য প্রয়োজন প্রাণিদের ঘনবসতি। তার একমাত্র সমভাব্য স্থান হচ্ছে, যেখানে শিল্প উৎপাদন হিসাবে পশু উৎপাদন চলে এবং উৎপাদনের পর এগুলোকে একসাথে রাখা হয়। মুরগী ও শুকরের খামারে ঠিক এ ভাবেই এ কাজটি চলে। গবেষণা সূত্রে বলা হয়েছে যে, যেহেতু শূকর ও মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে কাছাকাছি, তাই এই কোভিড–১৯ মানবদেহে এসেছে শূকরের মাধ্যমে [ আলইতিসাম ডট কম,০৯–০৭–২০ ]”
এককেন্দ্রিক বিশ্বে নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্র কেন হারাতে যাচ্ছে সে ব্যাপারে এ পর্যন্ত যেটুকু আলোচনা হলো তার নিরিখে জনস্বাস্থ্যখাতে যে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব ইতিমধ্যে হারিয়েছে সেটা আশা করি পাঠকদের কাছে পরিষ্কার হয়েছে।
লেখক: চর্ম যৌন রোগ ও ডায়াবেটিসে স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম।