চৈত্র সংক্রান্তি ও বর্ষবরণ

বিভা ইন্দু | মঙ্গলবার , ১২ এপ্রিল, ২০২২ at ৭:৪৬ পূর্বাহ্ণ

প্রকৃতির প্রতিটি অনুষঙ্গে চলছে বর্ষবরণের প্রস্ততি। মানুষের মনেও রঙধনু রঙের প্রলেপ। পলাশ শিমুল কৃষ্ণচুড়ার ডালে ডালে মন মাতাল করা মোহনীয়তার আগুন। পিচের রাস্তাগুলো ঢেকে যাচ্ছে কৃষ্ণচূড়ার লালিমায়। জারুল সোনালুর বিমুগ্ধ হাতছানিতে রূপকথা দোল খাচ্ছে চুপকথার মনে। কোকিলের কুহুতানে মনভোমরার মাতাল হবার দশা।
সবুজ প্রকৃতিতে তখন পালাবদলের সুর। ঠিক তখনই একদিকে মাতাল চৈত্রের ক্রান্তিলগ্ন অন্যদিকে চিরনবীন রুদ্র বৈশাখের আগমন বার্তা। ধূলট পৃথিবীকে রঙিন সাজে সাজানোর মনলোভা সব রকমারি আয়োজন। কবিগুরুর সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে গাইতে ইচ্ছে করছে- ‘ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফেরে’।
নান্দনিকতার অন্যতম পীঠস্থান ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ ও ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়‘র চারুকলা বিভাগে এ সময়টাতে সৃজনশীল ছাত্রছাত্রীদের দম ফেলবার সময় থাকে না!
সাজ সাজ রবে মুখরিত চারপাশ। চৈত্র সংক্রান্তির দিনগুলোতে নবীন প্রবীণ চারুশিল্পীরা ব্যস্ত সময় পার করে। কালো পিচের রাস্তা সাজে ফুল লতাপাতা মোড়ানো রঙতুলির নিপুণ আলপনায়। সুরের মূর্ছনা ও আড্ডা উল্লাসের মধ্যে সুসজ্জিত হয় দীর্ঘতম নকশার উজ্জ্বলতম আলপনা। মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাঙালি ঐতিহ্যের স্বকীয়তা ও চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য বাঁশের ফ্রেমের ওপর রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি হয় রঙ বেরঙের শাপলা, দোয়েল, পেঁচা, টিয়া পাখি, ইলিশ মাছ, শাপলা, ঘোড়া, হাতি, তাল পাতার পাখা, ট্যাপা পুতুল, বরবধূ সহ বর্ণিল সব ব্যানার ফেস্টুন ও মুখোশ। রাত জেগে এসব তৈরির আয়োজন চলে সপ্তাহব্যাপী।
ধর্ম, বর্ণ, ধনী, গরীব, নির্বিশেষে সবার মনে নতুন বছরকে বরণ করবার নির্মল আনন্দানুভূতি। গ্রামে গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব সংগঠনগুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। শৈশবে সংক্রান্তির দিনগুলোতে, চাল ডাল কাঁচা তরকারির সিধাসহ পান সুপারি ও নগদ টাকার বিনিময়ে জ্যোতিষীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভাগ্য গণনা করতেন। নতুন বছরে কার ভাগ্য কতোটা সুপ্রসন্ন ও কারো কারো ভাগ্যকে বিভিন্ন পূজাপার্বণের সৌভাগ্যের সারিতে নিয়ে আনা যাবে তারই প্রতিবিধান দিয়ে যেতেন জ্যোতিষশাস্ত্রের পণ্ডিতগণ।
চৈত্র মাসের শেষের দুদিনকে যথাক্রমে ফুল বিউ ও মূল বিউ বলা হয়। ফুল বিউ’র দিন ঠাকুরবাড়ি, গৃহস্থবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাটগুলো ফুল দিয়ে সাজানো হয়। মূল বিউতে জ্যোতিষপণ্ডিতের দেয়া ঘাট ঘিলা, কাঁচা হলুদ, সরষে, সর্বৌষধি, সরিষার তেল পাটায় পিষে মিশ্রণ বানানো হয়।
বাড়ির ছেলে বুড়ো সবাই স্নানে যাবার সময় এই মিশ্রণ শরীরে মেখে স্নান সারে।
আয়ুর্বেদিক রূপবিশেষজ্ঞদের পরামর্শের মতো নিজেকে সেদিন অনেক সুন্দর ও প্রাণোচ্ছল মনে হয়। অনিশ্চিত সম্ভাবনার সুনিশ্চিত প্রথা পার্বণগুলো বাঙালি মননে ও আটপৌরে জীবনে ছিলো, আছে এবং যুগ যুগান্তর থাকবে। গ্রাম ও শহরের ক্লাব সংগঠনগুলোতে বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আয়োজন করা হয়। তবে মূলধারার অনুষ্ঠানগুলো যেমন যাত্রাপালা, কীর্ত্তনের আসর, কবির লড়াই, রাত জেগে পু্‌ঁথিপাঠ, ভেড়ার ঘর পোড়ানো, বাড়ির উঠানে সূর্য ওঠার আগে ও সূর্য অস্ত যাবার সময় কাঁটাজাতীয় গাছপালা পুড়িয়ে তার চারপাশ ঘিরে গান গেয়ে গেয়ে জাঁক দেবার প্রথাগুলো কোনো কোনো জায়গায় আজ স্মৃতিতেই ভাস্বর।
তবুও মন্দেরও ভালো থাকে। তাই পুরোনো যা কিছু জরা, জীর্ণতা, মলিনতা ভুলে গিয়ে সর্বস্তরের বাঙালি ‘ঐতিহ্য প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায়’ উদ্বুদ্ধ হয়ে সমস্বরে গেয়ে ওঠে –
‘তাপস নিঃশ্বাস বায়ে/ মুমূর্ষুরে দাও ওড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক/ এসো এসো-/ এসো হে বৈশাখ এসো এসো’।

পরম সৌভাগ্যের বিষয়, এখনও কবিতা পাঠের আসর, কবির লড়াই, চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সাঁতার প্রতিযোগিতা, নৌকা বাইচ, হাডুডু খেলা, মোষের লড়াই, মোরগের লড়াই, গানের আসর, পুঁথি পাঠের আসর, বইমেলাসহ আরো বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আয়োজন করা হয়।
টিভি চ্যানেলগুলোতে থাকে নবর্ষের বর্ণিল আয়োজন । প্রধানত তিনটি অনুষ্ঠানকে ঘিরেই চট্টগ্রাম সহ সারাদেশ হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। মেলা,হালখাতা ও পুণ্যাহ। ঢাকায় রমনার বটমূলে নববর্ষের প্রথম প্রহর থেকে দিনব্যাপী বর্ষবরণের অনুষ্ঠানমালার জমজমাট আয়োজন থাকে। চট্টগ্রামে সিআরবি’র শিরীষতলায় সেই প্রথম প্রহর থেকেই চলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। তিল ধারণের জায়গা থাকে না। প্রচুর ভিড় এড়িয়ে বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ একটা দিন সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সর্বজনীন জাতীয় উৎসব নববর্ষ’ উৎসাহ উদ্দীপনার ভেতর পালন করা হয়। সমতলের প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা দূরদূরান্ত থেকে ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পের সমস্ত জিনিস নিয়ে চট্টগ্রামের বকশিবিট সংলগ্ন লালদিঘি ময়দানে এসে মেলায় অংশ নেয়।
এই মেলার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত বহুবছরের ঐতিহ্য মণ্ডিত ঐতিহাসিকভাবে প্রশংসিত চট্টগ্রামের লালদিঘির ময়দানের ‘জব্বারের বলিখেলা’। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেরা পালোয়ান বা বলী’রা এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। মাটির সড়া থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর হরেক রকমের রঙিন বাহারি সব জিনিস। এছাড়া পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কাছেও চৈত্র সংক্রান্তি ও নববর্ষ বিশেষভাবে তাৎপর্যমণ্ডিত। খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী নববর্ষে মাসব্যপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
জলকেলি বা সাংগ্রাই উৎসব অনেক বেশি বিনোদন নির্ভর। নাচ, গান, মঙ্গলশোভা যাত্রা, ভিন্ন স্বাদের উৎসব ভিত্তিক খাবারদাবার, মিষ্টিমুখ, অতিথি আপ্যায়ন সহ বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে তারাও নববর্ষের আনন্দযজ্ঞে নতুন করে প্রাণের স্ফুরণ ঘটায়।
তাদের বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বহুমাত্রিকতা সকল বাঙালির মনে গভীর প্রভাব ফেলে। উৎসবমুখর এ অনুষ্ঠানর নাম বৈসাবি/ বিজু উৎসব। পাহাড়ি ও সমতল এলাকার সকল শ্রেণির ব্যবসায়ী হালখাতা খোলেন। সারাদিন গ্রাহক সহ অতিথিদের জন্য মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা করেন। পুরোনো বা বকেয়া লেনদেন পরিশোধ করে নতুন ভাবে গ্রাহকের খাতায় নাম লেখান।মূল বিউ’র দিন প্রায় সব গৃহস্থ বাড়িতে তিরিশ চল্লিশ পদের সবজি দিয়ে পাঁচন রান্না হয়।
সংক্রান্তিতে নিরামিষ এই পাঁচনের স্বাদ ও গুণাগুণ সত্যি অতুলনীয়। নববর্ষের দিন মানে পয়লা বৈশাখ বিভিন্ন পদের খাবারের আয়োজন হয় প্রত্যেকের বাড়িতে বাড়িতে। পান্তা ইলিশসহ হরেক পদের মিষ্টি খাবার, পিঠা, নাড়ু, মুড়ি খই, বাতাসা, জিলিপি আরো কতো কী! আরো আছে বাহারি পদের ভর্তা, ভাজিভুজি, মাছ, মাংস, পোলাও, কোরমা, চাঁটনি, পুডিং, পায়েস, অম্বল, দই, রসগোল্লা, চমচম, পানতোয়া, ক্ষীরসা আরো কতো পদের মিষ্টি!
পোশাকে থাকে নতুন দিনের ছোঁয়া। আটপৌরে ঘরোয়া পোশাক বাদ দিয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী ধনী দরিদ্র সকলেই নতুন পোশাকে নিজেকে সাজায়। লাল সাদা রঙের প্রাধান্য থাকলেও রঙের ব্যঞ্জনায় বাঙালি খুঁজে নেয় স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ আয়োজনের সুবিশাল প্ল্যাটফর্ম। প্রাণোচ্ছল উৎসবকে বিপুল আড়ম্বর ও উৎসাহ উদ্দীপনায় বহুকাঙ্ক্ষিত ক্ষণ নতুন বৎসরের সূর্যোদয়ের ভেতর দিয়েই বাঙালি বরণ করে। মহিমান্বিত নতুন একটি বছরকে।
লেখক- শিক্ষক, কবি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্ববাসী এখন বন্ধুত্ব লাভের প্রতিযোগিতা দেখছে
পরবর্তী নিবন্ধআমরা কোন পথে অগ্রসর হচ্ছি!