আমরা কোন পথে অগ্রসর হচ্ছি!

ড. আনোয়ারা আলম | মঙ্গলবার , ১২ এপ্রিল, ২০২২ at ৭:৪৬ পূর্বাহ্ণ

একে একে নক্ষত্রের পতন। মহামারি বা সড়ক দুর্ঘটনায় না। দারিদ্র্যের চাপের কাছে হার মেনে গত চার এপ্রিল আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র অন্তু রায়। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের এতে যেন কোন দায় নেই। বরং আমরা বিবেক শূন্য হয়ে পড়ছি।
২০২১ সালের এক গবেষণার তথ্যমতে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে যার মধো ৬২ জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ছেলে শিক্ষার্থী বেশি। এর অন্যতম কারণ সামাজিক, আর্থিক ও পারিবারিক চাপ- ক্যারিয়ার কেন্দ্রিক মানসিক সংকট। ভবিষ্যতের অনিশ্চিত ভাবনায় দিশেহারা অনেক কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থী জীবনকে বিদায় জানাতে বাধ্য হচ্ছে।
করোনা নামক মহামারির ধাক্কায় দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। প্রতিটি খাতে নেমেছে এক বিশাল ধস আর এর সাথে যুক্ত ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধে পুরো বিশ্ব এখন অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি।
দেশেও এসব কারণে নীরবে ঘটে যাচ্ছে শ্রেণীর রূপান্তর বা বিভাজন। দিশেহারা মুখ্যত মধ্যবিত্ত সমাজ। ইতোমধ্যে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন অনেক নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। ঘটে যাচ্ছে অর্থনীতিরও রূপান্তর।
বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের এক বিশাল ঐতিহ্য আছে। বিশেষত ষাট থেকে নব্বই সাল পর্যন্ত রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে এই শ্রেণিরই নেতৃত্ব দিয়েছে। আর পরম বেদনা ও ক্ষোভের সাথে বলতে হয় এ শ্রেণির বিকাশের পথ ক্রমাগত রুদ্ধ হওয়ার পথে।
তবে অপ্রিয় হলেও সত্যি একইসাথে বেড়েছে নব্য কোটিপতির সংখ্যা। বহুজাতিক আর্থিক পরামর্শ দানকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্সএর তথ্যমতে সম্পদশালী শ্রেণির বিকাশ ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বেড়েছে প্রায় ১৪.৩ শতাংশ। করোনাকে পুঁজি করে এ সংখ্যা ইতোমধ্যে হয়তোবা দ্বিগুণ। আার মধ্যবিত্ত সমাজের আবাস,অবস্থান ও মর্যাদা এক বড়ো ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। হয়তো বা বিলুপ্তির পথে।
আই এল ও সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যে পরিসংখ্যান দিয়েছে তা একধরনের অশনি সংকেত।
দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত শ্রেণি যুদ্ধ করে যায় কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যেন মরতে মরতে বেঁচে থাকা। বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত খরচ বা বিদ্যুৎ, গ্যাস সহ স্থায়ী খরচের উর্ধ্বগতিতে বাজারের থলে দিনে দিনে সংকুচিত। জনগণকে এ অবস্থান থেকে উত্তরণে আমরা কি কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছি না’কি কেবলই গেয়ে চলেছি উন্নয়নের জয়গান।
টিসিবির লাইনে কারা এখন! শুধু তৃণমূলের না মধ্যবিত্তের অনেকে ছদ্মবেশে। অনেক পরিবারের খাদ্য তালিকায় পুষ্টিমানে নেতিবাচক প্রভাবে বিশেষত বয়সী ও শিশুরা পুষ্টিমানের নেতিবাচক প্রভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে।
মহামারি মোকাবিলা করা বিশ্বের প্রতিটি দেশের জন্য ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। শুরুতে এটি সামলাতে সরকারকে অনেক বিপাকে পড়তে হয়েছে। আর দুর্নীতি ছিলো সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধকতা। তবে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে দেশের অর্থনীতি সহ নানা খাতে একটা শৃঙ্খলা এসেছে। কিন্তু বিশ্ব রাজনৈতিক সমস্যায় আবারও ঝুঁকিতে দেশ। বিশেষত দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উর্ধগতি। মানুষকে খাদ্য নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব।
এ লক্ষ্যে গ্রামীণ কৃষি অর্থনাীতিকে প্রাধান্য দিয়ে কৃষক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের আর্থিক প্রণোদনা সহ যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। করোনাকালীন দূর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক সমপ্রসারণশীল মুদ্রানীতির মাধ্যমে তারল্য সৃষ্টির যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তা অব্যাহত রাখা প্রয়োজনে তারল্য আরো বাড়ানো যেতে পারে।এ মুহূর্তে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় কমানো। টিসিবির ওপর নজরদারি আরও বৃদ্ধি করা, কালোবাজারি ও মজুতদারদের সিন্ডিকেটকে কঠিন আইনের আওতায় আনা।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আয়তন বাড়ানো সহ সত্যিকার অর্থে যারা প্রাপ্যতার অধিকার রাখে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া। গ্রামের দরিদ্র শ্রেণির সাথে শহরের স্থায়ী নাগরিকদের ক্ষেত্রে ও দারিদ্র্যের ভয়াল বিস্তৃতি স্পর্শ করেছে। তাদেরকেও এই আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া। সামনে বাজেট আসছে। কোন কোন খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে সে লক্ষ্যে এখন থেকে দেশের অর্থনীতিবিদদের নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা নেওয়া।
সরকারের পক্ষে একা সম্ভব না। তাই দারিদ্র্যকে ঘিরে আত্মহত্যার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বন্ধে এগিয়ে আসতে হবে ব্যক্তি খাত, এনজিও, তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং সামর্থ্যবানদের। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দুর্নীতি রোধে কঠিন আইনী পদক্ষেপ।
লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ

পূর্ববর্তী নিবন্ধচৈত্র সংক্রান্তি ও বর্ষবরণ
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল