চামড়ায় এবারও ধস

চট্টগ্রামে ১১২ আড়তে ৩ লাখ পিস সংগ্রহ তদারকিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কমিটি

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২৫ জুলাই, ২০২১ at ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ

ঢাকায় কোরবানির গরুর প্রতি পিস চামড়া গুণগতমান ও আকৃতিভেদে ৬০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকায়, অধিকতর ভালো হলে ৯০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রামে একই চামড়া আড়তে বিক্রি হয়েছে ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায়। সর্বোচ্চ ৪০০ টাকায়। তবে, চট্টগ্রামে এবারও কোরবানিদাতারা চামড়ার দাম পাননি। অনেক এলাকায় চামড়া কিনতে কেউ আসেননি। কেউ কেউ ৫০-১০০ টাকায় বিক্রি করেছেন। বেশিরভাগ লোক মাদ্রাসায় দিয়েছেন। দামে ধসের পেছনে সিন্ডিকেটের কারসাজি দেখছেন কোরবানিদাতারা। আড়তদাররা তাদের নির্ধারিত দামে চামড়া কিনেছেন। ফলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা মোটামুটি চামড়ার দাম পেয়েছেন। চট্টগ্রামে এবার সংগ্রহ হয়েছে ৩ লাখ পিসের বেশি কাঁচা চামড়া। এছাড়া চামড়া সংক্রান্ত বিষয় তদারকি করতে কমিটি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
আড়তদারদের দাবি, গত তিন বছর ধরে চামড়া ব্যবসায় মন্দাভাব যাচ্ছে। অন্যান্য ব্যবসায় মন্দাভাব কাটিয়ে ওঠার চিত্র দেখা গেলেও চামড়া শিল্পের সংকট কাটছে না। গত কয়েক বছর ধরে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাচ্ছে না। বৃহত্তর চট্টগ্রামে বিভিন্ন এলাকা থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ী, বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিমখানার সংগৃহীত চামড়া ট্রাকে করে নিয়ে আসে আড়তদারদের কাছে।
নগরীর প্রধান চামড়ার আড়তগুলো হলো আতুরার ডিপো, আগ্রাবাদ চৌমুহনী ও ঈশান মিস্ত্রি হাট এলাকায়। ঈদের দিনও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করা চামড়া আড়তে বিক্রি করতে এসে ন্যায্য দাম পাননি। প্রতিটি চামড়া বিক্রিতে প্রত্যাশার চেয়ে ১শ থেকে দেড়শ টাকা পর্যন্ত কম পেয়েছেন বলে অভিযোগ মৌসুমী ব্যবসায়ীদের।
কোরবানির দিন দুপুরে ব্যবসায়ীরা তিনশ থেকে সাড়ে ৩শ টাকায় কাঁচা চামড়া বিক্রি করলেও দুপুর গড়াতেই দাম কমে গেছে বলে জানান আগ্রাবাদ চৌমুহনী এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম।
শহরের তুলনায় গ্রামে চামড়ার দাম একেবারে কম। গ্রামের অনেক এলাকায় চামড়া কিনতে আসেননি বলে জানান আনোয়ারা উপজেলার তিশরী জামে মসজিদের সভাপতি মো. সেলিম।
এদিকে, প্রতি বছরের মতো এবারও সিটি কর্পোরেশনের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে কোরবানির দিন দুপুরের পর থেকে শহরের প্রধান সড়কেও বসেছে চামড়া কেনাবেচার অস্থায়ী হাট। চট্টগ্রামে কাঁচা চামড়া বিক্রির সবচেয়ে বড় নির্ধারিত স্থান হলো আগ্রাবাদ চৌমুহনী ও বহদ্দারহাট এলাকা। এর বাইরেও বিভিন্ন এলাকায় কাঁচা চামড়া কেনাবেচার জন্য রাখা হয়েছিল।
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মোহাম্মদ মুসলিম উদ্দিন আজাদীকে বলেন, গত বছর কাঁচা চামড়া রাস্তায় ফেলে দিলেও এ বছর কেউ ফেলেননি। এ বছর দাম কিছুটা কম হলেও সব চামড়া বিক্রি হয়েছে। আমরা চট্টগ্রামের ১১২ জন আড়তদার আড়তে প্রায় দেড় লাখ গরু-মহিষের চামড়া সংগ্রহ করেছি। এছাড়া আরো দেড় লাখের মতো চামড়া লবণ দিয়ে গ্রামে-গঞ্জে সংরক্ষণ করা হয়েছে। শহরের আড়তে ও গ্রামে মিলে মোট ৩ লাখ ১ হাজার ২৫০ পিস চামড়া সংগ্রহে আছে। এর মধ্যে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৫০ পিস গরু-মহিষের চামড়া, ২৫ হাজার ২শ পিস ছাগল ও ভেড়ার চামড়া। এবার আমাদের লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৩ লাখের মতো হলেও ৩ লাখ সংগ্রহ করতে পেরেছি। লক্ষ্যমাত্রা মোটামুটি অর্জিত হয়েছে। আমরা প্রতি বর্গফুট কাঁচা চামড়া লবণ ছাড়া ১৭ টাকা থেকে ২২ টাকায় নিয়েছি। প্রতিটি চামড়া গুণগতমান ও আকৃতিভেদে ২৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকায় ক্রয় করেছি। শহরে মোটামুটি চাহিদা মতো আসছে। নিজের আড়তের জন্য এ বছর ৪ হাজার কাঁচা চামড়া নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
এবার চট্টগ্রামে পশু কোরবানি গতবারের চেয়ে কম হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এবার চট্টগ্রামে সাড়ে ৩ লাখের মতো কোরবানি হওয়ার কথা। ৩ লাখ ১ হাজার ২৫টি কোরবানি হয়েছে। চট্টগ্রামে মোট কত কোরবানি হয় সেটা আমরা বলতে পারি। আমাদের কোন আড়তে কে কতগুলো চামড়া নেন জানি। একটি কাঁচা চামড়া কেনার পর লবণযুক্ত অবস্থায় সংরক্ষণ করতে লবণের দাম, লেবার খরচ, পরিবহন ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ কমপক্ষে ২০০ টাকা খরচ পড়ে বলেও তিনি জানান।
কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির নেতারা জানান, শহরের বাইরে আনোয়ারা, বন্দর, পটিয়া, বোয়ালখালী, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, হাটহাজারী, সাতকানিয়া, দোহাজারী, আমিরাবাদ ও কঙবাজার এলাকায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দেড় লাখের মতো কাঁচা চামড়া লবণ দিয়ে রেখেছেন। কয়েক দিন পর তারা এগুলো আড়তে আনবেন।
গত কয়েক বছর ধরে চামড়া খাতে ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে উল্লেখ করে নেতারা জানান, আমরা সবসময় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে চামড়া কেনার পরামর্শ দিই। এরপরও তারা বাড়তি দামে চামড়া কিনেন। লবণের দাম ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে এখনো ২৫ কোটি টাকার বেশি পাওনা রয়েছি। সব মিলিয়ে আমরাও নানাভাবে সমস্যার সম্মুখীন। তবুও চেষ্টা করছি মৌসুমি ব্যবসায়ীদের উপযুক্ত দাম দেওয়ার। কোবরানিদাতা চামড়ার সঠিক দাম না পেলেও মৌসুমি ব্যবসায়ী এবং ফড়িয়ারা আমাদের কাছ থেকে সঠিক দাম পেয়েছেন।
এবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় লবণযুক্ত চামড়ার মূল্য বেঁধে দিয়েছে। ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট চামড়ার দর ঠিক করা হয়েছে ৪০-৪৫ টাকা। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে ৩৩-৩৮ টাকা। তবে কাঁচা চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়নি। এই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন আড়তদার এবং মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তবে আড়তদারদের প্রস্তাবিত দামেই চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন মৌসুমি বিক্রেতারা। তাই মোটামুটি দামেই চামড়া ছেড়ে দিয়েছেন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এবং মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
ঈদের দিন আগ্রাবাদ চৌমুহনী এলাকায় ২০০ পিস চামড়া নিয়ে আসা পতেঙ্গার মো. আলমগীর বলেন, এসেছি দুই ঘণ্টা হয়েছে, এখনো একটি চামড়াও বিক্রি করতে পারিনি। বড় চামড়াগুলো সাড়ে ৩শ থেকে ৪শ টাকায় কিনেছি। সেগুলো এখানে ২শ থেকে আড়াইশ টাকা চাচ্ছে। গতবারের মতো এবারও চামড়ার ক্রেতা নেই। ছাগলের চামড়ার দাম কেউ জিজ্ঞেসও করছে না। যারা আগে থেকে আড়তদারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তাদের চামড়া গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছে। আমরা এবারও ন্যায্য দাম পাইনি।
চামড়া তদারকির জন্য ৫ সদস্যের কমিটি : এবার কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহনের বিষয় তদারকির জন্য চট্টগ্রামে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ঈদের দিন থেকে পরবর্তী পাঁচ দিন এই কমিটি তদারকির কাজ করবে।
জানা গেছে, তদারকি ছাড়াও তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় কমিটি তা সমাধান করবে। এছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটিকে অবহিত করাও বিভাগীয় কমিটির সদস্যদের দায়িত্বের মধ্যে পড়বে।
চট্টগ্রাম বিভাগের জন্য গঠিত তদারকি কমিটিতে দলনেতা আছেন বাংলাদেশ চা বোর্ডের সচিব লুৎফুন নাহার। কমিটিতে আরও রয়েছেন চট্টগ্রামের আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের নিয়ন্ত্রক মো. আবদুর রহিম, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ, আরজেএসসির উপনিবন্ধক হারুন অর রশীদ ও টিসিবি আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-ঊর্ধ্বতন কার্যনির্বাহী জামাল উদ্দিন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ২১ কোটি টিকার ব্যবস্থা হয়েছে
পরবর্তী নিবন্ধচাকরি দেয়ার নাম করে জিম্মি, ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে উদ্ধার