বিশ্বের যতদূর চট্টগ্রামের মানুষ, ততদূর চাটগাঁইয়া ভাষাও। বিশ্বজুড়ে বর্তমানে ৭ হাজার ১১১টি ভাষা রয়েছে। এরমধ্যে অপেক্ষাকৃত ক্ষয়িষ্ণু ভাষাগুলো ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। যে–সব ভাষা সবচাইতে বেশী ব্যবহার হচ্ছে, তা থেকে ১০০টি ভাষার তালিকা প্রণয়ন করেছে কানাডা ভিত্তিক একটি ওয়েবসাইট ‘ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট’ (খবর: বাংলা নিউজ)। এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে যথারীতি তালিকার শীর্ষে আছে ইংরেজি ভাষা। বর্তমান বিশ্বে ১১৩ কোটি ২৩ লাখ ৬৬ হাজার ৬০০ জন এ–ভাষায় কথা বলে। দ্বিতীয় স্থানে আছে মান্দারিন চাইনিজ। এ–ভাষায় কথা বলে ১১১ কোটি ৬৫ লাখ ৯৬ হাজার ৬৪০ জন। এই ধারাবাহিকতায় ভাষা–ভাষীর দিক থেকে বাংলা পৃথিবীর সপ্তম বৃহৎ মাতৃভাষা। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মানুষের প্রধান ভাষা বাংলা। বর্তমানে এ–ভাষার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২৬ কোটি ৫০ লাখ ৪২ হাজার ২৮০ জন। এদিকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের মানুষও নিজেদের মধ্যে ভাষার আদান–প্রদানে তারা ‘নিজস্ব’ ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। চট্টগ্রাম ও সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা অন্যান্যদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হলেও বিশ্বজুড়ে চাটগাঁইয়া ও সিলেটি ভাষা–ভাষী মানুষের সংখ্যা যে নিতান্তই কম নয়, তাও উঠে এসেছে ‘ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট’–এর প্রতিবেদনে। গবেষণাধর্মী এই প্রতিবেদনে বলা আছে– বিশ্বজুড়ে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলে। জনসংখ্যায় ভাষা–ভাষীর দিক দিয়ে ১০০ দেশের মধ্যে চাটগাঁইয়া ভাষার অবস্থান ৮৮তম। অপরদিকে ১ কোটি ১৮ লাখ ভাষা–ভাষী দিয়ে সিলেটি ভাষা রয়েছে ৯৭তম স্থানে।
যাই হোক, আমাদের আলোচ্য বিষয় চট্টগ্রামের ভাষা বিষয়ক “চাটগাঁইয়া সঅজ পন্না’ নিয়ে। চট্টগ্রামেরই মানুষ কিন্তু আস্তে আস্তে তাঁদের নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে প্রায় পরিবার তাদের সন্তানদের সাথে চট্টগ্রামি ভাষায় কথা বলছে না; বলছে প্রমিত বাংলায়, নয়তো ইংরেজিতে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও একই অবস্থা। সভা–সমিতি, অফিস–আদালত তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবে চলতে থাকলে দেখা যাবে একসময় চট্টগ্রামের ভাষা চট্টগ্রামিরাই ভুলতে বসেছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনাচারে চাটগাঁইয়া ভাষা সচল ও সজীব রাখার প্রত্যয় নিয়ে ‘চাটগাঁ ভাষা পরিষদ’ এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এই সংগঠন নানা কর্মসূচিও পালন করেছে। ‘চাটগাঁইয়া সঅজ পন্না’ তাঁদের এই ধারাবাহিকতার একটি উল্লেখযোগ্য কাজ বলতে হবে।
প্রমিত বাংলা ভাষার পর দেশে সবচাইতে বেশী ব্যবহৃত উপভাষাটি হচ্ছে চাটগাঁইয়া ভাষা। চাটগাঁর ভাষা চট্টগ্রামবাসী ছাড়াও দেশি–বিদেশি অনেকেই এখন শেখার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করছেন। সাহিত্যে এখন বিশেষ করে কথাসাহিত্যে ও নাটকে চাটগাঁইয়া ভাষার বহুল প্রচলন লক্ষনীয়। এসব চিন্তা মাথায় রেখে গবেষক ড. মাহবুবুলক হক এ–ধরনের একটি গ্রন্থ প্রণয়নে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ‘চাটগাঁইয়া সঅজ পন্না’র ভূমিকায় তিনি নিজেই লেখেন–
“চাটগাঁইয়া সহজ পাঠ রচনার উদ্দেশ্য–অচাটগাঁইয়া যারা এই ভাষা শিখতে চান আর চাটগাঁবাসীর সন্তান যারা চাটগাঁইয়া ভুলে গেছেন তাঁদের চাটগাঁইয়া শেখার সহায়তা করা। সেই সাথে সামগ্রিকভাবে চাটগাঁইয়া উপভাষার চর্চাকে অব্যহত রাখা”।
উল্লেখ্য– চট্টগ্রামের ভাষার এই গবেষক কিন্তু জন্মসূত্রে এই চট্টগ্রামের মানুষ নন; ফরিদপুরের অধিবাসী। তবে তাঁর জীবনের পুরোটা সময় অতিবাহিত করেছেন চট্টগ্রামের নগর জীবনে। প্রকৃতপক্ষে এই গবেষকের প্রতিদিনকার ভাষাও কিন্তু প্রমিত বাংলা। সাধারণত চট্টগ্রামি ভাষায় তিনি কথা বলেন না। আবার অঞ্চলভেদে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাও উচ্চারণগত তারতম্য রয়েছে। উপভাষার তারতম্যের ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে চট্টগ্রামকে চারটি ভাগে ভাগ করতে পারি।
১. উত্তর চট্টগ্রাম ২. মধ্যম ও শহর চট্টগ্রাম ৩. দক্ষিণ চট্টগ্রাম ৪. সন্দ্বীপ, মিরসরাই ও সিতাকুন্ড অঞ্চল। চট্টগ্রামের মধ্যে এই চার অঞ্চলের ভাষারও কিন্তু সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে চট্টগ্রামের এই ভাষা গবেষক ড. মাহবুবুল হক কিন্তু চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস না করেও অঞ্চলভেদে বিভিন্ন উপভাষাকেও রপ্ত করেছেন একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামের অতি সাধারণ মানুষের মুখের বুলির মতো। বস্তুত এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেই তিনি চাটগাঁইয়া ভাষা গবেষণায় নেমেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন–
“চট্টগ্রামের উপভাষার বাক্যপ্রকরণে না–বাচক ক্রিয়ার ব্যবহার বিশেষ লক্ষনীয়। সাধারণভাবে বাংলায় না–বাচক ক্রিয়া পরে বসলেও এই উপভাষায় তা আগে বসে। যেমন– প্রমিত বাংলায় উচ্চারিত ‘আমি যাইনা’ চট্টগ্রামি উপভাষায় হয়ে যায় ‘আই না যাই’। প্রমিত বাংলায় ‘আমি খাব না’ ব্যাখ্যাটির চট্টগ্রামি উপভাষার রূপ ‘আই ন খাইয়ম’। তবে চট্টগ্রামি উপভাষার না–বাচক ক্রিয়া সবসময় যে পরে বসে তা নয়। যদি তা পরে বসে তবে বুঝতে হবে অনিচ্ছা বা অসম্মতি অত্যন্ত প্রবল। যেমন– ‘আই যাইতান নয়’ (আমি কিছুতেই যাব না)। …অন্যান্য আঞ্চলিক উপভাষার সঙ্গে এর পার্থক্য কেবল উচ্চারণগত নয়, শব্দ সম্ভার ও বাক্য প্রকরণের ক্ষেত্রেও এর রয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্যতা” (গ্রন্থ : অন্বেষার আলোয় চট্টগ্রাম)।
চাটগাঁইয়া সহজ পন্না (চট্টগ্রামি সহজ পাঠ, ChATGAIA Shaaj Panna. Easy Chittagonian.) রচনা করতে গিয়ে লেখক সকল শ্রেণির পাঠকের দিকে দৃষ্টি রেখে পাঠের ও বোঝার সুবিধার কথা চিন্তা করে চারটি ভাষার আশ্রয় নিয়েছেন, যথা– চাটগাঁইয়া ভাষা, প্রমিত বাংলা, রোমান হরপ এবং ইংরেজি ভাষা। বইটির শিরোনাম এবং ভূমিকা থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত সবকিছুই এই চার ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে। চট্টগ্রামের ভাষার যেহেতু কোনো নিজস্ব লিপি নেই, তাই বইটিতে চাটগাঁইয়া উপভাষার লিপি হিসেবে রোমান লিপি এবং বাংলা ভাষার লিপিরূপই ব্যবহার করা হয়েছে। গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি তৈরি করার পর লেখকের তত্ত্ববধানে একটি কর্মশালারও আয়োজন করা হয়। এই কর্মশালা থেকে প্রাজ্ঞ লেখকদের কাজ থেকে অনেক গঠনমূলক পরামর্শ ও সংশোধনীও উঠে আসে।
চট্টগ্রামের উপভাষা যাতে সর্বসাধারণের বোধগম্য হয় সেই লক্ষ্যে বইটিকে চারটি খণ্ডে নানাভাবে প্রতিটি বর্ণ দিয়ে শব্দ গঠন ও বাক্যগঠন দাঁড় করিয়েছেন।
যেমন: অ্যাঁ – ক্যাতা – কাঁতা – Kaeta – quilt
যেমন– চাটগাঁইয়া বাক্য গঠন–
ওবা, শুভ সআল/ বিয়ান।
অঁঅনে ক্যান আছন বদ্দা?
আঁই বঅর ভালা আছি।
আঁই বঅর কোয়াইল্লা।
আঁই গম নাই ওবা।
এই বাক্যগুলোকে প্রমিত বাংলা, Roman Transliteration I English Translation – এ দেখানো হয়েছে। এতে যে কোন ভাষার মানুষেরই মূল ভাষাটি বুঝে নিতে সহজ হবে। শব্দ এবং বাক্যগঠন ছাড়াও এই গ্রন্থে চট্টগ্রামের ভাষা, বচন, প্রবচন, ছড়াসহ চট্টগ্রামের লোকজ ঐতিহ্যের নানা অনুষঙ্গে ভরপুর। চাটগাঁইয়া ভাষা–ভাষীর জন্য ‘চাটগাঁইয়া সহজ পন্না’ একটি দুর্লভ সম্পদ। চট্টগ্রামি ভাষা সংক্রান্ত কয়েকটি গ্রন্থ ইতোমধ্যে লেখার চেষ্টা হয়েছে বটে। তবে এই গ্রন্থটি চট্টগ্রামের ভাষাকে নিখুঁতভাবে বোঝার ও লেখার জন্য অনন্য গ্রন্থ বটে।
চট্টগ্রামের নানা লোকাচার এবং আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে ড. মাহবুবুল হকের নিরন্তর গবেষণা এবং কৌতূহলী অন্বেষণের ফলে তাঁকে আমরা চট্টগ্রাম আঞ্চলিক বিষয়ক যে কোনো গবেষণার আকর ব্যক্তি হিসেবে ভাবতে পারি। জীবনের প্রান্তবেলায় এসেও অনেকটা অসুস্থ শরীরে চট্টগ্রামের ভাষা নিয়ে ড. মাহবুবুল হকের সম্প্রতি প্রকাশিত শ্রমলব্ধ মূল্যবান গ্রন্থ ‘চাটগাঁইয়া সঅজ পন্না’ রচনা করে চট্টগ্রামবাসিকে অপরিশোধ্য ঋণে আবদ্ধ করেছেন।