চলো বই কিনি

গোপা রানী দে | মঙ্গলবার , ১ মার্চ, ২০২২ at ১০:১৩ পূর্বাহ্ণ

ফেব্রুয়ারির বই মেলা এখন বাৎসরিক আনন্দ উৎসবে পরিণত হয়েছে। কতভাবে যে একুশ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে! একুশকে উপলক্ষ করে বই প্রকাশনার উদ্দীপনা কালে কালে সমৃদ্ধ হয়েছে।বই মেলায় গেলেই দেখি উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে বই প্রেমিরা বই কিনতে গেছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তরা বাংলা বইয়ের প্রকাশনাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কবি, দার্শনিক, প্রকাশক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বহু গুণীজনের সমাগম ঘটে এই মেলায়। অনেকেই সারা বছর এই মেলার অপেক্ষায় থাকে কেননা মাঝেমাঝে সুলভ মূল্যে বই কেনার সুযোগ দেয়া হয়। প্রতিবছর মেলায় স্থান পায় নতুন গ্রন্থরাজি। তবে ক্রেতার সংখ্যা কম বললেই চলে। বর্তমানে বই কেনার প্রতি যুবসমাজের অনীহা রয়েছে প্রচুর। তার কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে বলে আমি মনে করি। আধুনিকতম প্রযুক্তি এখন আমাদের সামনে আলাদীনের চেরাগ নিয়ে হাজির। কেবল অনুসন্ধান প্রণালীর বোতাম টিপে সবাই পেয়ে যাচ্ছে কপিরাইট ফুরিয়ে যাওয়া হাজারো গ্রন্থ। এর বাইরে নতুন বইও ইন্টারনেটে পাওয়া সম্ভব ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের ‘অনলাইন বুকস’ এর ঠিকানায় তবে এর জন্য আলাদা দামও দিতে হতে পারে। উচ্চবিত্তরা ঘরে বসে ডিভাইস ব্যবহার করে বই পড়ে নিতে পারছে, তারা তাই বই কিনার আগ্রহ হারিয়েছে।
জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণে বইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। বইকে বন্ধু ভাবতে হবে। তবে বইটা যাতে পড়ার মতো হয়। বই শুধুমাত্র পাণ্ডিত্য অর্জনের জন্য নয় আনন্দলাভের জন্যও বটে। অনেকেই মনে করেন পাঠ্যক্রম বহির্ভূত বই কিনে দিলে সন্তানের লেখাপড়ায় ক্ষতি হবে। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানেরা বই কিনার জন্য অভিভাবকদের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা ও উৎসাহ পায়না। তারা সার্টিফিকেট নির্ভর শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চান তাদের সন্তানকে। পাঠ্যবই এর বাইরে চোখ রাখার সময় নেই তাদের সন্তানদের।শুধু এই কোচিং থেকে ওই কোচিং এর মধ্যেই তারা জ্ঞানের আলো খুঁজে বেড়ান।
বই কিনতে হলে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে প্রথমে, যেটা বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে দেখা মিলা ভার। এটাও সত্যি যে এই অভ্যাস গড়ে তুলার ক্ষেত্রে মা-বাবা ও শিক্ষকদের একটা ভূমিকা রয়েছে। আমাদের যুগে মা-বাবারা উপহার হিসাবে রবীন্দ্র, নজরুল, নীহাররঞ্জন, শরৎচন্দ্রের বই কিনে দিতেন। আর আমরা পয়সা জমিয়ে কিনে আনতাম ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ, পাঠ্যবইয়ের নীচে রেখে লুকিয়ে লুকিয়ে সাবধানে পড়তাম। নজরে পড়লেই অর্ধচন্দ্র দেয়া হতো।
আমাদের শিক্ষকরা ক্লাসে রেফারেন্স দিয়ে কোন বইয়ের কিয়দংশ আলাপ করতে গিয়ে বলতেন–‘হাতে কিছু টাকা পেলেই বইটা কিনে পড়ে নিও, মনে রেখো বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়নি, এটা মুজতবা আলী বলে গেছেন।’ প্রিয় শিক্ষকের এমন কথায় মুগ্ধ হয়ে আমি অনেক বই কিনেছি ও পড়েছি।
আমাদের স্কুলে সপ্তাহে একদিন লাইব্রেরী থেকে বই দেয়ার প্রচলন ছিলো। এক সপ্তাহ রাখা যেত। বইটি পড়ে ভালো লাগলে সংগ্রহে রাখার জন্য কিনে নিতাম। স্কুলের রুটিনে বই পড়ার বাধ্যতামূলক ক্লাস রাখা ও প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা যায়। ফেইসবুক, সেল্ফি, উত্তাল মিউজিক আর লাইক কমেন্টের যুগে এসে আমাদের সন্তানেরা জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করে দিচ্ছে, ফলে তারা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছেনা। সমাজে নেমে আসছে অবক্ষয়। যুবসমাজ খুন, ধর্ষণ, আত্মহত্যা, মাস্তানি, চাঁদাবাজির মতো অপরাধজনক কর্মকান্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে। যুবসমাজকে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারলে বই কেনার সম্ভাবনা জাগবে ও তাদের মানবিক গুণাবলী বৃদ্ধি পাবে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, বোয়ালখালী হাজী মোঃ নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধবন্ধ হোক যুদ্ধ এবং আগ্রাসন মুক্তি পাক মানবতা
পরবর্তী নিবন্ধশ্রদ্ধায়-স্মরণে বেগম মুশতারী শফী