মনে কি পড়ে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের কথা? ১৯৩০ সালের ১৮এপ্রিল থেকে ২২এপ্রিল মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে একদল তরুণ যে ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, ইতিহাসে তা ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। যুগান্তর দলের মুখপত্র সাপ্তাহিক স্বাধীনতা ২৪এপ্রিল লিখেছিল,‘বাংলার সুদূর প্রান্তর চট্টগ্রামে বিপ্লবী বাংলা বিদ্রোহ বিস্ফোরণে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে।…ধন্য চট্টগ্রাম! আজ বহু বৎসরের সাধনার পর বাঙালিকে সার্থকতার মুখ দেখাইলে!’ মহীবুল আজীজ লিখেছেন, ‘১৯৩০ সালের এপ্রিল মাস কেবল চট্টগ্রামের ইতিহাসে নয়, ভারতের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এবং বাঙালির স্বাধীনতার পশ্চাৎ প্রেরণা হিসেবে প্রাতঃস্মরণীয়। টি.এস.এলিয়ট তার ওয়েস্টল্যান্ড কাব্যে এপ্রিলকে বলেছেন নিষ্ঠুরতম মাস। আমরা বলতে পারি আমাদের জন্যে এটি মহত্তম মাস’। ১৯৩০ সালের ১৮এপ্রিল শুক্রবার ছিল আয়ারল্যান্ডের ইস্টার বিদ্রোহ বার্ষিকী। আয়ারল্যান্ডের বিপ্লবী প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে ইস্টারের ছুটির উৎসবমুখর রাতে অভ্যুত্থান ঘটাতে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে বিপ্লবীরা জাতীয় সপ্তাহের শেষদিনে কংগ্রেস অফিসে কর্মসূচি নির্ধারণে সমবেত হয়েছিলেন। সিদ্ধান্ত হয়, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চট্টগ্রামকে স্বাধীন করবে। তারপর কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। একটি ‘বিপ্লবী কর্মী বাহিনী’ও গঠিত হয়। মাস্টারদা এবং নির্মল সেন কর্মী বাহিনীর তালিকা করেন। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা নিয়ে মতভিন্নতা আছে। চারু বিকাশ দত্ত ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ গ্রন্থে ৬২জন বিপ্লবীর কথা উল্লেখ করেছেন। অনন্ত সিংহ ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’ গ্রন্থে ৬৪জন লিখেছেন। রমেশ চন্দ্র সেন ৫৭জন বলেছেন। পূর্ণেন্দু দস্তিদারের গ্রন্থে ৬৩জনের নাম আছে। ভারত সম্রাট বনাম সূর্যসেনের ঐতিহাসিক মামলার রায়ে ৩৪জন বিপ্লবীর নাম আছে। রায়ে উল্লেখিতরা অস্ত্রাগার দখল এবং জালালাবাদ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
১৮এপ্রিল অনন্ত সিংহ ও গনেশ ঘোষের নেতৃত্বে একটি দল গনেশ ঘোষের বাসা থেকে পুলিশ আর্মারি আক্রমণে যান। রেলওয়ে আর্মারি আক্রমণকারী দল নির্মল সেন ও লোকনাথ বলের নেতৃত্বে লোকনাথ বলের বাসা থেকে বের হন। অম্বিকা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একটি দল টেলিফোন অফিস আক্রমণ করেন। অঙিলিয়ারি ফোর্সের রেলওয়ে আর্মারি দখলে বেশি ক্ষয়-ক্ষতি হয়। মৃতদেহ, বিধ্বস্ত গাড়ি আর আগুনে সমগ্র আর্মারি রণাঙ্গনে পরিণত হয়। সে রাতে চট্টগ্রামের আইন-শৃঙ্খলা ব্রিটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সিপাহী বিদ্রোহের পর এখানে কিছু সশস্ত্র হামলা হয়েছিল। কিন্তু এমন সংঘটিত সশস্ত্র অভ্যুত্থান হয়নি। এই অভ্যুত্থান চট্টগ্রামের সমস্ত প্রশাসনিক ক্ষমতা অচল করে দেয়।
১৮এপ্রিল রাত দশটার পর শহরের বিভিন্ন প্রান্তে আক্রমণ শুরু হয়, সকাল পর্যন্ত চলে। আক্রমণের পরিকল্পনা এতই নিখুঁত ছিল, আমলা বা পুলিশ কেউই বুঝতে পারেনি। তাই হঠাৎ আক্রমণে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। বিপ্লবীরা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে অস্ত্রাগার দখল করে সময়মতো সরে পড়েন। আর্মারিতে আগুন লাগাতে গিয়ে হিমাংশু সেন অগ্নিদগ্ধ হলে অনন্ত সিংহ ও গনেশ ঘোষ তাঁকে নিয়ে চলে যান। আর কোনোদিন মাস্টারদার সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়নি।
অস্ত্রাগার দখলের খবরে শহরে হৈচৈ পড়ে যায়। শ্বেতাঙ্গদের মনে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। সেই রাত্রে তারা ভীত হয়ে পরিবারসহ জাহাজে করে কর্ণফুলীর মোহনায় চলে যায়। থানার পুলিশেরা আত্মসমর্পণের চিন্তা করছিল। চট্টগ্রাম শহর তিনদিন একরকম অরক্ষিত ছিল।
বিপ্লবীদের মন যখন বিজয়ের নেশায় উদ্দীপ্ত, তখন অসংখ্য গুলির শব্দ হয়। লোকনাথ বল বললেন, ‘গুলি করার ধরন দেখে মনে হয় ওরা রিইনফোর্সমেন্টের জন্যে গেছে। ওরা আমাদের এখানেই আটক করতে চায়।’ মাস্টারদা বললেন, ‘এখন কোনো নতুন প্রোগ্রামে হাত দিও না। আপাতত কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে আত্মগোপনই একমাত্র পন্থা।’ চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা কঠিনতম পরীক্ষায় সাফল্য পেয়েও পরেরদিন অপেক্ষাকৃত সহজ পথে ক্ষমতা দখলের পরিবর্তে বনের পথ ধরেন। পরদিন মাস্টারদা আলোচনায় বসে শহরে ঢুকে অতর্কিত আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু তা আর পারেননি।
২২এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীরা দ্বিতীয়বার সশস্ত্র ইংরেজদের মুখোমুখি হন। একটি যুদ্ধ আসন্ন বুঝেই মাস্টারদা বললেন, ‘লোকনাথ, আজকের যুদ্ধের জন্যে তোমাকেই আমরা সেনাপতি পদে বরণ করলাম। দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হও।’ লোকনাথ বল সামরিক কায়দায় সর্বাধিনায়ককে অভিবাদন করে সৈন্য সমাবেশ করেন। তিনি পাহাড়ের দুদিকে বিপ্লবীদের ভাগ করে সমাবেশ করান। নির্দেশ দিয়ে তিনিও পজিশন নিলেন। সর্বাধিনায়ক থেকে কনিষ্ঠতম বিপ্লবী টেগরা বল পর্যন্ত তাঁর আদেশের অপেক্ষায় থাকলেন। সৈন্যদের পাহাড়ে উঠতে দেখে সেনাপতি লোকনাথ বল ফায়ারের নির্দেশ দেন। সেদিন জালালাবাদ পাহাড়ে বিদ্রোহীরা তাঁর নেতৃত্বে ব্যুহ রচনা করে যে বীরত্বের পরিচয় দেন, বাংলার ইতিহাসে তা অবিস্মরণীয়। অনন্ত সিংহ লিখেছেন, ‘জালালাবাদ যুদ্ধের বিভীষিকাময় চিত্র আমার এই বর্ণনা পড়ে কতখানিই বুঝা যাবে? সিনেমা দেখে, বই পড়ে অথবা বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের কথা চিন্তা করে যুদ্ধ ক্ষেত্রের বাস্তবতাকে পুরোপুরি অনুধাবন করা যায় না। সম্ভবও নয়।’
লোকনাথ বল যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করলে নির্মল সেন তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। মাস্টারদা সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি বেশ সুষ্ঠুভাবেই তোমার সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছ। আমাদের বীর সেনানীদের এবার গার্ড অব অনার দাও।’ লোকনাথ বল বিপ্লবীদের ‘ফলইন’ করিয়ে শহীদদের সারিবদ্ধ করার আদেশ দেন। কান্না ভুলে বিপ্লবীরা শহীদদের সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানালেন। মাস্টারদা শ্রদ্ধাভরে প্রতিটি শহীদের নাম উচ্চারণ করলেন : ১. হরিগোপাল বল টেগরা ২. প্রভাস বল ৩. নরেশ রায় ৪. ত্রিপুরা সেন ৫. বিধূ ভট্টচার্য্য ৬. মতি কানুনগো ৭. শশাঙ্ক দত্ত ৮. নির্মল লাল ৯. জিতেন দাশগুপ্ত ১০. মধুসূদন দত্ত ১১. পুলিন ঘোষ ১২. অর্ধেন্দু দস্তিদার।
২৩এপ্রিল সকালে এতোগুলো মৃতদেহ দেখে খুশিতে ব্রিটিশবাহিনী তাঁদের সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানিয়ে দাহ করে। জালালাবাদ পাহাড়ে শহীদবেদী ঘিরে অনুপম এক বহ্নিশিখা সহস্রশীর্ষ মেলে গগণস্পর্শী হয়ে ওঠে। দৃশ্যটি পাশের পাহাড়ে বসে এই মহাযজ্ঞের পুরোহিত মাস্টারদা এবং তাঁর অনুসারীরা দেখলেন। একথা অনস্বীকার্য, সেদিন যুব বিদ্রোহের ‘শহীদদের চিতার অগ্নিশিখা চট্টগ্রামের আকাশে লাল অক্ষরে লিখেছিল, সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক! বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!’ তাই তারাপদ রায় ‘ছিলাম ভালোবাসার নীলপতাকা তলে স্বাধীন’ কবিতায় লিখেছেন, ‘কয়েকদিন মাত্র তবু এখনো সেই স্বাধীনতার স্বাদ/এখনো তো ভোলা গেল না।’
চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা প্রথমবারের মতো একটি ভৌগোলিক এলাকার দক্ষ প্রশাসন ও সুসংগঠিত বাহিনীকে পরাজিত করে শুধু ইতিহাস সৃষ্টি করেননি, দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মহান দেশপ্রেমের। জালালাবাদ যুদ্ধের বীরদের সাহসিকতার প্রশংসা করে নেলী সেনগুপ্তা গর্ববোধ করেছিলেন। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামেই বিপ্লববাদের একটা নতুন সার্থক প্রচেষ্টা দেখা যায় সম্মুখ সমরে, স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত ও দেশের সম্মুখে এই আদর্শ স্থাপনে।’ সুকান্ত ভট্টাচার্য চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ স্মরণে চট্টগ্রামের হরিখোলা মাঠের সাহিত্য সম্মেলনে পাঠ করেন-‘ক্ষুধার্ত বাতাসে শুনি এখানে নিভৃত এক নাম চট্টগ্রাম : বীর চট্টগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২২এপ্রিল চট্টগ্রাম বিদ্রোহের স্মৃতিসভা উপলক্ষে প্রেরিত বাণীতে বলেছিলেন, ‘মুক্ত বাংলায় জালালাবাদ দিবস পালিত হচ্ছে শুনে আনন্দিত হয়েছি। আজ থেকে বিয়াল্লিশ বছর আগে মৃত্যু ভয়হীন বাঙালি বীর বিপ্লবী সূর্যসেনের নেতৃত্বে পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিল। বাংলার মুক্তি পাগল মানুষ রক্তঝরা সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সেই স্বাধীন বাংলাকে জয়যুক্ত করেছে, আমাদের গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতার সার্থক রূপায়নের মাঝে মাস্টারদার অতৃপ্ত আত্মা আজ খুঁজে পাবে শান্তি। মাস্টারদা অমর হয়ে রইলেন বাংলার মানুষের হৃদয়ে-বাংলার ঘরে ঘরে। যুগে যুগে ঐতিহাসিক এই দিনটি প্রতিটি বাঙালির কাছে অনন্ত প্রেরণার হয়ে থাকুক-এ কামনা করি।’ অনুষ্ঠানে জালালাবাদ পর্বতশীর্ষে কবি দিলীপ কানুনগো ‘মৌন মুখর জালালাবাদ’ কবিতাটি পাঠ করেন। সেদিন ওখানে ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল শহীদদের নামখচিত ফলক পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় স্থাপিত হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার