১
লোকসংস্কৃতির সঙ্গে লোকজীবনের রয়েছে গভীর ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। আবার লোকজীবনের আদল তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে লোকখাদ্য। তাই যে-কোনো অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির স্বরূপ নিরূপণ করতে হলে সে অঞ্চলের মানুষের লোকখাদ্যের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধান করা দরকার।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষের খাদ্য সংস্থান প্রক্রিয়া ছিল দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত : ১. সংগ্রহ প্রক্রিয়া ও ২. উৎপাদন প্রক্রিয়া। আদিম কাল থেকে লোকজীবনে খাদ্য সংস্থান প্রক্রিয়ার প্রাথমিক ভিত্তি ছিল সংগ্রহ কৌশল নির্ভর। এই সংগ্রহ কৌশল ছিল প্রধানত তিন রকম : ক. বনাঞ্চল থেকে ফলমূল সংগ্রহ, খ. বনের পশুপাখি শিকার, এবং গ. জলাশয় থেকে মাছ শিকার । সংগ্রহ ও শিকার ব্যবস্থায় প্রথম প্রথম প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত খাদ্য সরাসরি ভোগে লাগানো হতো। পরে আগুন, পশুপালন, কৃষি, লোকপ্রযুক্তি ইত্যাদি আবিষ্কারের পর মানুষ খাদ্য উৎপাদন করতে শেখে। এর ফলে লোক-খাদ্যাভ্যাসে লক্ষণীয় পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য সূচিত হয়। এভাবে দীর্ঘকাল ধরে মানুষের এক ধরনের খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে। আধুনিক কালে শিল্প উৎপাদন ও নগরায়ণের ফলে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে আবার এক দফা পরিবর্তন সূচিত হয়। প্রাক-শিল্প উৎপাদন ও প্রাক-নগরায়ণ পর্বে লোকজীবনে যে খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠেছিল তাকেই মোটামুটিভাবে লোকখাদ্য হিসেবে বিবেচনা করা চলে।
চট্টগ্রামের লোকখাদ্য নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এ নিয়ে কোনো জরিপও সম্ভবত হয় নি। কিছু লিখিত উপকরণ ও সংগৃহীত কিছু তথ্যের ভিত্তিতে বর্তমান প্রবন্ধে চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকখাদ্য সম্পর্কে মোটামুটি ও প্রাথমিক একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
বনাঞ্চল থেকে ফলমূল সংগ্রহ
সুপ্রাচীন কালে চট্টগ্রামের অধিবাসীদের লোকখাদ্যের একটা বড় অংশ আসত বনাঞ্চল থেকে ফলমূল সংগ্রহের মাধ্যমে। বিভিন্ন ঋতুতে তারা যেসব ফল সংগ্রহ করে খেত সেগুলির মধ্যে ছিল : আম, আইট্টা কেলা (বিচিকলা), কাট্টলি কেলা, গারাইং কেলা (সাগর কলা), চিনিচাম্পা কলা, চাম্বাকেলা (চাপা কলা), কান্নাল বা তুরুনজা (বাতাবি লেবু), কাট্টল (কাঁঠাল), কাময গোড়া বা কওরা (কামরাঙা), গোঁয়াচি বা গইয়াম (পেয়ারা), আরাগোলা বা আমড়াগোটা (আমড়া), চাইলদা বা চাইল্যা (চালতা), তেতই (তেঁতুল), নাইরকল (নারকেল), বত্তা বা ডেউয়া, মনগুলা (পাহাড়ি ফল), হিয়রি (পানিফল), জলপাই, অলতি বা অলমতি (আমলকি), কা গোলা, হারপাড়া গোলা, ভাককুমগোলা, লটকনগোলা, পাইন্যাগোলা, কিউর, ছইকিউর (মাটির নিচে উৎপন্ন হয়। দেখতে মিষ্টি আলুর মতো। ইত্যাদি।
আর সবজির মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য : কলাগাছের পাতা ছাড়া অন্যান্য অংশ। যেমন : কলার বৌলি, কলা গাছের মুরি, কচি কলাগাছ, কলার থোড়। সবই সবজি বা তরকারি হিসেবে খাওয়া হয়।
এ ছাড়া তরকারি হিসেবে এখানকার অধিবাসীরা ব্যবহার করত কঁইন্দা বা কইডা (চিচিঙ্গা), কচু, কুঅরা বা হঅরি বা হ’রি (মিষ্টি কুমড়া), কোঁয়ারা বা চাল কেঁঅরা (চালকুমড়া), ছই (শিম), জাইত কদু (লাউ), তিতা করলা (উচ্ছে), ধেউরগ্যা (ছোট মূলা), কইয়া (পেঁপেঁ), বাইয়ন (বেগুন), ফল (শসা), ভেটবাইয়ন (এক রকমের ছোট বেগুন, যিআঁ বা ঝিয়া (ঝিঙা), পুরুইল (ধুন্দুল), টাইয়ন (টমেটো), অরঅল (অড়হর), কিয়ারাগুলা, বাঁশকরুল, বন কাশ (দেখতে এবং খেতে ঢেঁড়শের মতো। নালসা, টিয়াটুই ইত্যাদি।
বনের পশুপাখি শিকার
চট্টগ্রামের অধিবাসীরা খাদ্যের প্রয়োজনে বন থেকে বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, বুনো ছাগল, বুনো গরু, গয়াল, বুনো মহিষ, হুয়র (কালো হরিণ বা শুকর) ইত্যাদি পশু শিকার করত। খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো এগুলির মাংস। পরে গৃহপালিত গরু, ছাগল, মোষের মাংসও খাদ্য তালিকায় যোগ হয়।
পাখি শিকার ছিল লোকখাদ্যের আর একটি উৎস। সেকালে বনজঙ্গল থেকে বনমোরগ, বুনো পাখি ও বুনো হাঁস শিকার করার রীতি ছিল।
জলাশয় থেকে মাছ শিকার
সেকালে চট্টগ্রামের অধিবাসীদের লোকখাদ্যের আর একটি বড় উৎস ছিল জলাশয় বা সমুদ্র থেকে মাছ শিকার। মাছ ধরার জন্যে তারা বড়শি, জাল, চাঁই, ফলঅ, টেঠা, ইত্যাদি ব্যবহার করত। জালের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল, টাইয়া জাল, চাক জাল, টানা জাল, ঝাই জাল (ঝাকিজাল) ও ডুব জাল। এছাড়াও সাগরে বা নদীতে ‘জাগ’ দিয়ে ধরা হয় মাছ। মাছের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় ইছা মাছের কথা। সাগরে এবং মিষ্টি পানিতে প্রায় ৩৫ প্রজাতির ইছা মাছ ছিল।
সমুদ্র মেখলা বলে চট্টগ্রামের লোকখাদ্যে সামুদ্রিক মাছও বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। সামুদ্রিক মাছের মধ্যে ইছা, লইট্ট্যা, ছুরি, রিস্যা (তপসে), লাক্ষা, পোপা, ঘুইজ্যা (ক্যাটফিস প্রজাতির মাছ) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক মাসে সাগর উত্তাল থাকে। সে জন্যে সাগর থেকে মাছ ধরা সম্ভব হয় না। জীবন্ত মাছের এই আকালের সময়ে চট্টগ্রামবাসীরা নানা ধরনের ফুউনি/হুউনি (শুটকি) মাছ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। ইছা, লইট্ট্যা, ছুরি, ফাইস্যা, বাটা, রিস্যা (তপসে), লাক্ষা, পোপা, রুপচান্দা, ঘুইজ্যা, পুটিসহ সাগরের বিভিন্ন প্রজাতির মাছের শুটকি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
মাছ আগুনে সেঁকে এক ধরনের শুটকি করা হয়। এর নাম ফাতরা শুটকি। তা পান্তা ভাত দিয়ে খাওয়া হয়। হলুদ-মশলা মেখে রোদে শুকানো মাছ পরিচিত ছিল ফুয়ানা মাছ হিসেবে। এটাও বেশ জনপ্রিয় ছিল। বর্ষাকালে যখন মাছের আকাল দেখা দেয় তখন নুনশা ইলিশ তাজা মাছের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
উৎপাদিত খাদ্যশস্য
উৎপাদিত খাদশস্যের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য চইল বা চাল। সেকালে চট্টগ্রামে বহু জাতের ধান উৎপাদিত হতো। আহমেদ আমিন চৌধুরী তাঁর চট্টগ্রামী ভাষার অভিধান ও লোকাচার গ্রন্থে (২০০৯ : ২৫২) প্রাচীন চট্টগ্রামে উৎপাদিত ১৫৪ রকম ধানের তালিকা দিয়েছেন। তা থেকে ধারণা করা যায় চাল ও চাল থেকে তৈরি নানা রকম খাদ্য (যেমন মুড়ি, খই, লারু, করই (চাউল ভাজা), মোয়া ইত্যাদি) ছিল চট্টগ্রামবাসীর প্রধান খাদ্য।
২
বিভিন্ন স্তরের পরিবারের দৈনন্দিন সাধারণ খাবার
সেকালে গরিব পরিবারের দৈনন্দিন সাধারণ খাবারের মধ্যে ছিল পানতা ভাত, মাছ কিংবা শুটকির তরকারি, ডাল আর শুকনো মরিচ, মরিচচুরা বা মরিচভর্তা (শুকনো মরিচ পুড়িয়ে তার সাথে পেঁয়াজ, লবণ, সরিষার তৈল, ধন্যে পাতা দিয়ে মরিচচুরা বা মরিচের ভর্তা তৈরি করা হয়।) ভত্তা-ভাজিও এদের খাদ্যতালিকায় স্থান পেত।
সাধারণ গৃহস্থের দৈনন্দিন সাধারণ খাবারের তালিকায় থাকত ভাত, মাছ, ডাল ও শাক-সবজির তরকারি। এছাড়া দোমাছা বা এক সঙ্গে রান্না করা মাছ ও শুটকির সালন বা তরকারি খুবই পছন্দনীয় খাবার ছিল।
অন্যদিকে, সচ্ছল পরিবারের দৈনন্দিন সাধারণ খাবারের তালিকায় থাকত ভাত, চার-পাঁচ রকমের সালন বা তরকারি এবং দুধ-কলা, দই কিংবা খাট্টা (টক)। মাছের তরকারি ছিল নিত্যদিনের খাবারের অপরিহার্য অংশ। মাংস খাওয়ার চল ছিল অতিথি-আগমনে কিংবা উৎসব-অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। মোগল প্রভাবে সচ্ছল ও বিত্তশালী পরিবারে দুরুচ-পোলাও, মোচম্মান, কোরমা-পোলাও ইত্যাদি খাদ্য হিসাবে প্রচলিত হয়। পিয়াজ, রসুন ও মশলা প্রথম প্রচলিত হয় বিত্তশালী পরিবারে। ক্রমে তা সাধারণ পরিবারে বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে খাদ্য তালিকাভুক্ত হতে থাকে।
তবে সাধারণ ও সম্পন্ন পরিবারের খাবার তালিকায় একটি বিশেষ ধরণের খাবারের পদ থাকতো। আর তা হচ্ছে ‘কাজি’ (যা দেখতে শরবতের মতো)। যেমন : আমের কাজি, রসুন কাজি। কাচা আমের ‘কাজি’ সবচেয়ে উপাদেয় খাবার।
নাশতা জাতীয় খাবার
নাশতা জাতীয় খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উরুম (মুড়ি), ওড়া (মুড়কি জাতীয় খাদ্য), চালের করই-এর লাড়ু (নাড়ু), খৈঅর লাড়ু (খইয়ের নাড়ু) ইত্যাদি। নাশতা হিসেবে রান্না করা শিমদানা ও আলু দিয়ে মেখে খই খাওয়ার প্রচলনও ছিল। (আবদুল হক চৌধুরী, ১৯৮৮ : ৪৩৭)।
সাধারণ ও গরিব পরিবারে সকালের খাবার হিসেবে সেকালে পান্তা ভাত ও ফাতরা শুটকির ব্যবহার ছিল। তার সঙ্গে তেলে ভাজা বা আগুনে পোড়ানো শুকনো মরিচ ছিল অপরিহার্য।
সকালের নাশতা হিসেবে মধুভাতও ছিল পছন্দনীয় খাবার। আগের দিন সন্ধ্যায় পানিতে ভিজিয়ে রাখা ভাত পরদিন সকালে ভালো করে ঘুঁটে খাজুইয্যা মিডা (খেজুড়ে গুড়) বা রস মাখিয়ে এই মধুভাত তৈরি করা হতো। এতে খাবারে এক ধরনের মাদকতা আসত। খাজুইয্যা মিডা ও নারকেল সহযোগে বিনি ভাত ও কাঁকন চালের ভাতও খাওয়া হতো সকালের নাশতা হিসেবে। তা ছাড়া সকালের খাবার হিসেবে রসভাতেরও চল ছিল। খাজুইয্যা রসে সিদ্ধ করে ভাত রান্নার সময়ে কখনো কখনো তাতে বদা বা ডিম ছেড়ে দেওয়া হতো। সাধারণ ও গরিব পরিবারে খাজুইয্যা রস দিয়ে কিংবা সুরুয়া বা ঝোল দিয়ে জাউভাত খাওয়ার রীতি ছিল।
সকাল-বিকালের নাশতা হিসেবে নানা রকম শুকনো খাবারের প্রচলন ছিল চট্টগ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : করই (চালবাজা), করই বা কড়ইর লাড়ু (নাড়ু), আটকড়ইয়া, কইয়র ওরা ইত্যাদি। শীতকালে সকালে-বিকালে নাশতা হিসাবে মুড়ি, মুড়কি, মোয়া, ও খইয়ের চল ছিল। মুড়ি খাওয়া হতো গুড় ও নারকেল দিয়ে। তেল-মরিচ মাখানো ঝালমুড়িরও চল ছিল।
এ ছাড়াও চল ছিল নানা রকম মিডা বা মিষ্টি খাবারের। যেমন : লাড়ু (নাড়ু), নাইরকল্লা লাড়ু (নারকেলের নাড়), মোলা (মোয়া), শিরনি, হাল্ল (হালুয়া) ইত্যাদি। মিষ্টি খাবারের মধ্যে ক্রমে খাজা, লবঙ্গ, ছক্কার দানা, জিলিপি, বাতাসা, গজা ইত্যাদি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
পিঠা চট্টগ্রামবাসীর অন্যতম প্রিয় লোকখাদ্য। উৎসব-অনুষ্ঠানে এখানে নানা রকমের পিঠার প্রচলন দেখা যায়। যেমন : কাডইল্যা মারি পিডা (কাঁঠাল দিয়ে খাওয়ার উপযোগী এক ধরনের পিঠা), কেলা পিডা (চালের আটা ও কলা দিয়ে তৈরি), তালর পিডা, চিতই বা চিতল পিডা, চুঁয়া পিডা (বাঁশের চোঙায় তৈরি পিঠা), পাক্কন পিডা (তেলে ভাজা পিঠা। জালি পিডা, পুলি, নাইরকল পুলি, লেদা পুলি, পাইচ পিডা (পাটিসাপটা), হাতঝাড়া পিডা, ধুঁই পিডা (ধুপি পিঠা বা ভাপাপিঠা), চুটকি পিডা, গুরা পিডা, ছাইন্যা পিডা, পুয়া পিডা (তেলে ভাজা পিঠা), তিন-কোনা গড়গড়া পিডা ইত্যাদি। জালি পিডা খেজুরের রস দিয়ে খাওয়া হয়।
মাংস জাতীয় খাবারের মধ্যে সচ্ছল পরিবারে মাঝে মাঝে খাদ্য হিসেবে কুরার (মোরগ/মুরগি) গোস্ত ব্যবহৃত হতো। বিয়ের সময় ও বিয়ের পর জামাইকে রাওল বা রাতা কুরা (মোরগ) ও পুরুষ হাঁসের মাংস খাওয়ানোর রীতি ছিল। ডিম পাওয়ার জন্য সাধারণত মুরগি ও মাদি হাঁস জবাই করা হতো না।
দুধের তৈরি খাবারের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল গরু, ছাগল ও মোষের দুধ ও দই। দুধের তৈরি খাবারের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল ক্ষীরের মোয়া, শিরনি ইত্যাদি। এছাড়া দুধের তৈরি ঘি, মাখন, মলাই (ছানা) ছিল উল্লেখযোগ্য খাদ্য।
পানীয় হিসেবে দুধ তো ছিলই। এ ছাড়া পানীয়ের মধ্যে গুড়ের শরবত, গুড় ও দই মিশিয়ে তৈরি দই-শরবত উল্লেখযোগ্য। গরমের দিনে পথযাত্রার ক্লান্তি দূর করতে তেঁতই (তেঁতুল) শরবতের চল ছিল।
৩
উৎসব-অনুষ্ঠানের লোকখাদ্য
চট্টগ্রামে বিভিন্ন লোক-উৎসব-অনুষ্ঠানের খাদ্য তালিকায় বেশ কিছু লোকখাদ্যের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এখানে এ রকম কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হল।
মুসলিম বিয়ে, জামাইভাতা, বেয়াইভাতা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে গরুর মাংস ও ভাত খাওয়ার চল ছিল। মানী অতিথিদের জন্যে দুরুচ কুরা বা পুরো মুরগির রোস্টের ব্যবস্থা হতো। কচি মোরগ বা মুরগী নিয়েই দুরুচ তৈরি করা হয়। সঙ্গে পোলাও। একে বলা হতো দুরুচ-পোলাও। প্রক্রিয়া-করা আস্ত মুরগি সিদ্ধ করে নিয়ে মরিচ-মশলা মাখিয়ে আগুনে সেঁকে নিয়ে তারপর তেলে বা ঘিয়ে ভেজে নিলে তৈরি হয় দুরুচ কুরা। তা খাওয়া হতো ভাত বা পোলাওয়ের সঙ্গে। দুরুচ কুরার প্রচলন এখনো আছে। পুরো মাছ ভুনাও অতিথি আপ্যায়নে ব্যবহৃত হতো।
মরিচ ও মশলা সহযোগে রান্না করা গোস্তের ঝাল তরকারি বা নুন্নুচ খাওয়া হতো ভাত বা পোলাওয়ের সঙ্গে। মানী অতিথিদের জন্যে কখনো কখনো দেওয়া হতো কুরার ‘মোচম্মান’ বা মুরগি-মুসল্লাম। মোচম্মান হল মরিচ ছাড়া অন্যান্য মশলা এবং দধি-দুধ সহযোগে রান্না করা শুরগ্যা বা ঝোলসহ আস্ত মুরগি। মোচম্মানের সঙ্গে ডিমের দোপেয়াজা দেওয়া হতো।
চট্টগ্রামবাসী মুসলমানরা বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে শত শত বা হাজার হাজার অতিথির জন্যে যে খাবারের আয়োজন করে থাকেন তা মেজ্জান বা মেজবান নামে পরিচিত। এ ধরনের মেজ্জান বা মেজবানের আয়োজন করা হয় নবজাত শিশুর আকিকা, মেয়েদের কান ছেঁদানো, ছেলেদের খতনা, ওরস, বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে। তবে কোন মৃত ব্যক্তির পারলৌকিক মঙ্গল ইত্যাদি উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানকে জেয়াফত বলা হয়। এই জেয়াফত অনুষ্ঠানের উপরে উল্লেখিত মতে গরু, মহিষ বা গয়াল জবাই করে মেহমান খাওয়ানোর বিধান এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ ধরনের অনুষ্ঠানের বিশেষ খাদ্যতালিকায় সাদাভাতের সঙ্গে সাধারণত তিন ধরনের তরকারি পরিবেশিত হয় : ১. কড়া মরিচ ও মশলা সহযোগে রান্না করা ঝাল গোস্ত, ২. কম ঝাল, মশলা ও টক সহযোগে রান্না করা গরুর নলার শুরুয়া, ৩. ঢেঁকিতে গুড়ো করা মাস কলাইয় দিয়ে রান্না করা ডাল (আবদুল হক চৌধুরী, ১৯৮৮ : ৪৩২)।
উৎসব-অনুষ্ঠানের উপাদান হিসেবেও লোকখাদ্যেরও প্রচুর ব্যবহার ছিল। যেমন : পান-তেল দেওয়া, কান ছেদনি, হাদি খাওয়ান প্রভৃতি মেয়েলি অনুষ্ঠান উপলক্ষে পান, সুপারি, খদ (খয়ের), চুন, সাদাপাতা, নারকেল তেল ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। সেকালে বিয়ের নিমন্ত্রণ করা হতো পান-সুপারি দিয়ে। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিয়েতে বাড়ির দরজায় যে মঙ্গল ঘট বসানো হতো তাতে ডাব বা নারিকেল ব্যবহৃত হতো। মুসলিম বিয়েতে দুলা বা বর সাজানো উপলক্ষ্যে পাঁচ কুলা ধানের চাল দিয়ে শিরনি রেঁধে পরিবেশন করা হতো। বরপক্ষকে অভ্যর্থনা জানানো হতো পান-মিঠা দিয়ে আর দুলাকে অভ্যর্থনা জানানো হতো পান, সুপারি, মিডা বা গুড় ও শরবত দিয়ে। বউ-জোড়নি অনুষ্ঠানেও পান-মিঠা দেওয়ার চল ছিল। হিন্দু বিয়েতে দধিমঙ্গল অনুষ্ঠানে বর-কনেকে দই দিয়ে ভাত খাওয়ানো হতো। এ সম্প্রদায়ের বিয়েতে বর চৌদোলায় চড়ে যাত্রা শুরু বরলে খই ছুঁড়ে সম্মান দেখানো হতো। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে শুভ কাজে বরণকুলায় স্বাস্থ্য ও সজীবতার প্রতীক হিসেবে কাঁচ কলা ও কাঁচা পেয়ারা এবং সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে কাঁচা হলুদ ব্যবহার করা হতো। হিন্দু ও বৌদ্ধদের বরণকুলার অন্যতম উপাদান ছিল ধান ও সরিষার তেল। অন্যদিকে মুসলমান সমাজে বরণকুলার অন্যতম উপাদান ছিল পিঠা। মুসলিম বিয়েতে সালামি হিসেবে পান, সুপারি ও বাতাসার প্রচলন ছিল। বর ও বরযাত্রীরা বিয়ের আসরে আসন নিলে পান-মিঠা (পান ও মিষ্টি) দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হতো। হিন্দু বিয়েতে বধূবরণে চাল, টাকি মাছ, মিঠা ভাত, দুধ, কলা ইত্যাদি ব্যবহৃত হতো। বর-বধূর অধিবাস ভঙ্গ করা হতো তাদের কলার থোর ও কলমি শাকের তরকারি খাইয়ে। বিয়ের দিন গণক, নাপিত, ধোপা প্রমুখকে যে সিধা বা উপহার দেওয়ার রীতি চট্টগ্রামে প্রচলিত তাতে অন্যান্য উপহারের সঙ্গে চাল ও ডাল দেওয়া হতো।
সেকালে মেজবানে আমন্ত্রিত অতিথিদের মাটির সানকিতে করে খাবার দেয়া হতো। তা ছিল ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জন্যই প্রযোজ্য। তবে কোনা কোনো ক্ষেত্রে কলা পাতার উপরও খাবার পরিবেশন করা হতো।
৪
লোকখাদ্য কেবল মানুষের জীবন ধারণের সঙ্গে যুক্ত নয়, ভৌগোলিক পরিবেশ, নানা লোকাচার এবং উৎসব-অনুষ্ঠানের সঙ্গেও এর রয়েছে গভীর যোগ। তা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও লোকবিশ্বাসের ভিত্তিতে লোকখাদ্যাভ্যাসে গড়ে উঠেছে নানা বিধিনিষেধ। চট্টগ্রামের লোকখাদ্যে সমুদ্র, পাহাড়, সমতল ও নদীর প্রভাব যেমন লক্ষণীয়, তেমনি লক্ষণীয় বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের প্রভাব। এ ছাড়াও আরাকানি, ত্রিপুরী, মোগলদের প্রভাবও বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে।
বিশ্বায়ন, শিল্পায়ন ও আধুনিকতার প্রভাবে চট্টগ্রামের লোকখাদ্য ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে। বিদেশি খাবারের দিকে আমাদের আকর্ষণ বাড়ছে। ঘরে ঘরে চিপস, নুডুলস, চানাচুর, কনফেকশনারি-খাদ্যের আধিপত্য তৈরি হয়েছে। উৎসব-অনুষ্ঠানে জায়গা করে নিয়েছে ফ্রায়েড রাইস, কাচ্চি বিরিয়ানি, ফ্রুট সালাদ ইত্যাদি। শহর ছাড়িয়ে সুদূর পল্লিগ্রামেও লেগেছে তার হাওয়া। ফলে লোকখাদ্য এখন অস্তিত্বের সংকটে বিলীয়মান। তবে আশার কথা, ঐতিহ্যের টানে এবং ফাস্টফুডসহ আধুনিক অনেক খাবার স্বাস্থ্যের জন্যে হুমকি বলে বিবেচিত হওয়ায় আবার নতুন করে লোকখাদ্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও আকর্ষণ বাড়ছে। এই অবস্থায় চট্টগ্রামের লোকখাদ্য নিয়ে আলোচনা, তথ্যসন্ধান, তথ্যসংগ্রহ, গবেষণা বিশেষ গুরুত্ব দাবি করে।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক, গবেষক, শিক্ষাবিদ