গৌরবের উত্তরাধিকার

দেশের গান জাগরণের গান

আবু মুসা চৌধুরী | শুক্রবার , ৮ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:০৭ পূর্বাহ্ণ

সংগীতসাধক শাহরিয়ার খালেদ-এর যে কোনো তৎপরতা সবিশেষ তাৎপর্যবাহী এজন্যে যে, সুরসমুদ্রের অতলান্ত গভীর-গভীরতায় নিমজ্জিত-নিমগ্ন তার তন্বিষ্ট জীবন: তাই এবারের একুশে গ্রন্থমেলায় তদীয় সম্পাদনায় প্রকাশিত দেশের গান জাগরণের গান শীর্ষক মহার্ঘ্য সংগ্রহটি বিশেষ বার্তাবাহী। ভূমিকায় গ্রন্থটি প্রকাশের উদ্দেশ্য ও সারবত্তা পরিস্ফুট। তার জবানি…‘এই প্রযুক্তি-শাসিত ডিজিটাল যুগের নতুন প্রজন্মের চিন্তা চেতনা, ধ্যান-ধারণা মানসভিন্নতায় আবর্তিত। বিশ্বায়নের খোলা জানালায় আজ তরুণকুল শেকড়চ্যুত কিংবা মূল বিস্মৃত হওয়ার পর্যায়ে; আমাদের সেই উত্তরাধিরের দুয়ার বাংলা ও বাঙালির গৌরবের অমর অধ্যায়, দেশের গান জাগরণের গান পরিচিত করার জন্যে আমরা ব্রতী হয়েছি। মুজিব জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বিষয়টি অনিবার্যভাবে প্রাসঙ্গিক।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলা শীলিত সংগীতে দেশপ্রেমের গভীর অনুভব রূপায়িত হতে শুরু করে। স্বদেশ সংগীত, স্বদেশি সংগীত, স্বদেশি গান, মুক্তির গান, দেশের গান, দেশাত্ববোধক গান, গণসংগীত, জাগরণের গান-প্রভৃতি নানা নামে এই দেশপ্রেমমূলক, উজ্জীবক সংগীত ধারা আখ্যায়িত। যেখানে স্বদেশের প্রতি বন্দনা ও অনুরাগ এবং স্বদেশের দুঃখ মোচন করে দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করা হয়, তার নামই দেশের গান জাগরণের গান।
তো, বাংলা সংগীতের সমৃদ্ধ ধারায় এই ঘরানার যে মহামূল্য সম্ভার রয়েছে, তা থেকে চয়িত ১৫৪টি গান নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে এই গ্রন্থ। এতে অঙ্গীভূত যেমন বহুল প্রচলিত লোকপ্রিয় সংগীত, সমান্তরালে স্বল্পশ্রুত মানসম্পন্ন গানও স্থান পেয়েছে: সম্পাদকের রুচি-মান প্রজ্ঞা ও পারমিতার সুচারু নিক্তিতে যাচাই বাছাই হয়েই নিশ্চয়ই মুদ্রিত হয়েছে সেই রচনা; যাতে স্বল্প সুসম্পাদনার ছাপ ও প্রকাশ সুষ্পষ্ট। সংগীত সুষমার অমর, চিরকালীন শ্রোতাপ্রিয় জননন্দিত জেগে ওঠা ও উদ্দীপনার প্লাবন সৃষ্টিকারী বেশ কিছু গান নিয়ে মুজিব জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে দেশের গান জাগরণের গান, শিরোনামে এই বইয়ের প্রকাশনায় সহযোগিতা করেছে দেশের অন্যতম শিল্প উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান জিপিএইচ ইস্পাত। দেশ ও জাতির এই মহান লগ্নে এই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মহতি পৃষ্ঠপোষকতা অবশ্যই ধন্যবাদার্হ । তাদের এই সদর্থক সংস্কৃতিমনস্কতা ও প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট মিশন ও ভিশন আগামীতেও অব্যাহত থাকবে নিশ্চয়ই।
আলোচ্য গ্রন্থে গ্রথিত হয়েছে নির্বাচিত স্বদেশ চেতনামূলক, স্বদেশপ্রেমের গান। ১ম ছত্রের বর্ণমালাভিত্তিক বিন্যস্ত করা হয়েছে, পরিশিষ্টে গীতিকার-সুরকার ও শিল্পীর নাম সংযোজন সামগ্রিক মিলিয়ে দেশের গান জাগরণের গান একটি সুগ্রথিত প্রকাশনা।
অত্র গ্রন্থের সর্বাঙ্গ জুড়ে যত্ন-পরিশীলন-রুচি-মেধা ও আন্তরিকতার ছাপ সুস্পষ্ট। গ্রন্থটি এই তাৎপর্যবাহী যে, শাহরিয়ার খালেদ, একজন দায়বদ্ধ শিল্পী ও সংগীত যোদ্ধা। উপরন্তু তিনি এজন সুপরিচিতি অ্যাকটিভিস্ট। বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। এছাড়া তার বংশ লতিকাও উল্লেখযোগ্য। তিনি ভারতীয় আইন পরিষদের সাবেক সদস্য ও কাজেম আলী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা শেখ-ই চট্টগ্রাম কাজেম আলী মাস্টারের প্রপৌত্র। এছাড়া তিনি চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রভাগের সৈনিক।
শাহরিয়ার খালেদ বস্তুত একজন জাতশিল্পী। একটি সম্পূর্ণ জীবন সংগীত সমুদ্রে নিমজ্জিত ছিলেন, এবং এখনো তার এই নির্বাণ অব্যাহত। যেহেতু তিনি সুস্থ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক তাই তার এই প্রকাশনাও ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।
দেশের গান জাগরণের গান সর্বতোভাবে একটি সুসম্পাদিত সংকলন। এই গ্রন্থে প্রচলিত গান যেমন স্থান পেয়েছে, তেমনি হালের জনপ্রিয় দেশের গানও মুদ্রিত।
আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল- এর সংগীত উইশ্যাল ওভার কাম এর হেমাঙ্গ বিশ্বাস অনূদিত ‘আমরা করবো জয়’ যেমন গ্রন্থিত হয়েছে, সমান্তরালে আবদুল জব্বারের গাওয়া রবীন ঘোষের সুরারোপিত জনপ্রিয় সিনেমার গান পিচ্‌ ঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি বা কে জি মুস্তাফার লেখা আনোয়ার উদ্দীন খানের সুর করা একই শিল্পীর তোমরা যাদের মানুষ বল না ইত্যাদি কালজয়ী সংগীতও সন্নিবেশিত হয়েছে এই সংকলনে, এতে নির্বাচন বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের বহুল পরিচিত স্মরণীয় গানগুলো অবধারিতভাবেই এসেছে। তেমনি এসেছে মুকুন্দু দাশ, রমেশ শীল, সুশান্ত, সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস থেকে শুরু করে ফজল-এ খোদা, আহমদ, ইমতিয়াজ বুলবুল ও মকসেদ আলী সাঁই, লোককবি শামসুদ্দীন আহমদ, মোস্তাফিজুর রহমান মোহাম্মদ শাহ বাঙালি’র মতো গুণীজনদের রচনা।
অবধারিতভাবে এসেছেন দ্বিজেন্দ্র লাল, অতুল প্রসাদ, রজনীকান্ত; পাশাপাশি গাজী মজহারুল আনোয়ার। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, গোবিন্দ হালদার ও গণসংগীতকে অনন্যমাত্রায় পৌঁছে দেয়া ভূপেন হাজারিকা আছেন যথাযোগ্য মর্যাদায়। আছেন ব্যতিক্রমী প্রতুল মুখোপাধ্যায়, সামপ্রতিক হাসান মতিউর রহমানও। এক কথায় সর্বাঙ্গীন সম্পূর্ণ বলা যায় এই গ্রন্থ।
পক্ষান্তরে রুমা গুহ ঠাকুরতার কলকাতা ইয়ুথ কয়্যার এবং আমাদের বগুড়া ইয়ুথ কয়্যার- এর সংগীত সংযোজিত হলে এই সংকলন আরো সমৃদ্ধ হতো। উপরন্তু খ্যাতিমান সুমন- এর অনুবাদকৃত বব ডিলান এর দুনিয়া কাঁপানো গান আসতে পারতো। নিশ্চয়ই পরবর্তী সংস্করণে বিষয়গুলো বিবেচনা করা হবে : তো সবকিছু মিলিয়ে শাহরিয়ার খালেদ সম্পাদিত দেশের গান জাগরণের গান সময়োপযোগী ও একটি প্রয়োজনীয় প্রকাশনা। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন মনিরুল মনির আর প্রকাশক খড়িমাটি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৮নং ওয়ার্ডে এলবিয়ন গ্রুপের ইফতার সামগ্রী বিতরণ
পরবর্তী নিবন্ধনাতিকের শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু