ফেব্রুয়ারি আমাদের চেতনার মাস, জাগরণের মাস ও ভাষার মাস। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের বাঙালির জীবনে এক উল্ল্লেখযোগ্য দিন। দিনটি আমাদের জন্য যেমন উদ্দীপনার তেমনি উজ্জীবনের। মহান একুশে আমাদের চেতনা ও মননের বাতিঘর। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের করেছে মহিমান্বিত এবং গৌরবান্বিত। ১৯৫২ সালের এ দিনটিতে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার দাবিতে মিছিলে স্ল্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। দুর্বার আন্দোলনে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলা ভাষার মান সমুন্নত রেখেছেন রফিক, শফিক, জব্বার, সালাম, বরকতসহ অনেক নাম না জানা শহীদ। সেদিন তাঁরা রক্ত দিয়ে, জীবন উৎসর্গ করে বাঙালি জাতিকে মাথা নত না করার শিক্ষা দিয়েছেন, প্রেরণা দিয়েছেন।
সুদীর্ঘকাল ধরে ভারতবর্ষে ছিল হিন্দু, মুসলমান, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্মাবলম্বী মানুষের বসবাস। সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে হিন্দুরা ছিল প্রথম আর মুসলমানরা ছিল দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। আবার পূর্ববঙ্গ (বাংলাদেশ), পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানে মুসলমানরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিভিন্ন সময়ে একই শাসকের অধীনে থাকলেও হিন্দু ও মুসলমান সমপ্রদায়ের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা রকমের বিরোধ দেখা দেয়। এই বৈষম্য নিরসনে ভারতবর্ষে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি ওঠে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পৃথক দুটি অংশ নিয়ে পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত নামে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের মধ্য দিয়ে এই দাবি পূরণ হয়। এর সাথে সাথে ভারতীয় উপমহাদেশে অবসান হয় প্রায় দু’শত বছরের ইংরেজ শাসনের।
ভারত-পাকিস্তান রাষ্ট্র বিভাজনে পূর্ব পাকিস্তান নাম দিয়ে বাংলাদেশকে অন্তর্ভূক্ত করা হয় প্রায় ১৮০০ কিলোমিটার দূরবর্তী পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনভার ন্যস্ত হয় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের হাতে। পূর্ব পাকিস্তানে ছিল শতকরা ৫৫ ভাগ লোকের বাস এবং এদের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসকারী ৪৫ ভাগ লোকের ভাষা ছিল পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতু, বালুচি ও উর্দুসহ আরো কয়েকটি ভাষায় বিভক্ত। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের মোট ৬ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ লোকের ভাষা ছিল বাংলা। সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে এদেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল স্বাধীন রাষ্ট্রে বাংলা রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা পাবেই।
শুরু থেকেই বাংলা ভাষার প্রতি পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরূপ মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে পোস্টকার্ড, ডাকটিকিট, মানি অর্ডার ফরম প্রভৃতি ছাপা হয় ইংরেজি ও উর্দু ভাষায়। এতে পশ্চিমা শাসকদের বাংলাকে চরমভাবে উপেক্ষা করার বিষয়টি প্রকট হয়ে উঠে। এ কারণে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বাংলা ভাষাভাষিদের মধ্যে। এরপর বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন চলা সত্ত্বেও বাংলা ভাষাকে নিয়ে চলতে থাকে পশ্চিমাদের নানা ষড়যন্ত্র। বাংলার জনগণ এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় গড়ে তুলে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফরে আসেন। একুশে মার্চ ঢাকার রমনা ময়দানে এক জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন-‘ উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ তার এই বক্তব্যে পূর্ব বাংলার জনগণ ‘না না’ বলে প্রতিবাদ জানায়। এরপর থেকে বাঙালি জাতি শাসক গোষ্ঠীর বিভিন্ন ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে থাকে। বাংলা ভাষার দাবিতে মিছিল- মিটিং, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। এ’জাতির সমস্ত কর্মসূচি হয়ে ওঠে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস।
এদিকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারা পূর্ব বাংলায় একুশে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ক্ষমতাসীন সরকার এদিনের কর্মসূচির ব্যাপকতা উপলব্ধি করে ঢাকা শহরে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে সভা, সমাবেশ, মিছিল মিটিং নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এতে করে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব বাংলায়। একুশ ফেব্রুয়ারি এদেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে জড়ো হতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। বেলা ১২ টার দিকে ছাত্রদের সাথে ছাত্রীরাও মিছিলে যোগ দেয়। এ সময় মিছিল থেকে পুলিশ শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীকে গ্রেফতার করে। এতে পুলিশের সাথে শুরু হয় ছাত্রদের সংঘর্ষ। পুলিশ গুলি, কাঁদুনে গ্যাস ছুঁড়ে ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। বেলা ৩টার দিকে সংঘর্ষ আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং ছড়িয়ে পড়ে আশে পাশের এলাকায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে পুলিশ হিংস্র হয়ে গুলি বর্ষণ করতে থাকে ছাত্রদের ওপর। গুলিতে শহীদ হন রফিক উদ্দিন আহমদ, আবদুল জব্বার ও আবুল বরকত, শফিউর রহমান, আবদুস সালাম। গুলিতে নিহত হয় এগার বছর বয়সী কিশোর অহিউল্লাহ। এ ঘটনায় ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় প্রতিবাদ ও পুলিশের নির্যাতন অব্যাহত থাকায় উত্তেজনা আরো ব্যাপক রূপ নেয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি অনাড়ম্বরভাবে উদ্বোধন করা হয় তাৎক্ষণিকভাবে নবনির্মিত শহীদ মিনার। ২১ ফেব্রুয়ারির এ ঘটনা থেকে সৃষ্টি হয় ঐতিহাসিক ২১ দফা। এ দফাকে ভিত্তি করে ১৯৫৪ সালে গঠিত হয় রাজনৈতিক দল যুক্তফ্রন্ট। একই সালে সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে। শেষ পর্যন্ত শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়।
ফেব্রুয়ারি আমাদের মাঝে আসে মাতৃভাষা বাংলার চেতনা নিয়ে। আসে মাথা নত না করার শিক্ষা নিয়ে। মহান এই মাসে গভীর শ্রদ্ধা জানাই সকল ভাষা শহীদ ও ভাষা সংগ্রামীদের।