মহা আতংকের বছর ২০২০-এর একেবারে শেষে এসে একটি ভালো ছবি দেখার সুযোগ হলো। গাজী রাকায়েত পরিচালিত দ্বিভাষিক চলচ্চিত্র দি গ্রেভ (গোর)। ছবিটি বাংলাদেশে প্রথম মুক্তি পেল চট্টগ্রামে ২৫ ডিসেম্বর। এ শহরে এখন একটিমাত্র প্রেক্ষাগৃহ অবশিষ্ট। আছে দু’টি সিনেপ্লেক্স। একই করুণ অবস্থা সারা দেশের সিনেমা শিল্পের। করোনার আগে ৯০টির মতো প্রেক্ষাগৃহ ছিল। করোনার পর তার অর্ধেকও চালু হয়নি। বন্ধই হয়ে গেছে অনেকগুলো। এদেশের বেশিরভাগ জেলায় এখন আর কোনো প্রেক্ষাগৃহ নেই। ছবিও মুক্তি পেয়েছে করোনার আগে ও পরে হাতে গোনা কয়েকটি। এহেন দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় একটি ভালো ছবি দেখতে পাওয়া নিতান্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার।
গাজী রাকায়েত আমাদের দেশের একজন শক্তিমান অভিনেতা। মঞ্চের একজন সক্রিয় কর্মী। নাটক রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয়ে তার সমান পারদর্শিতা। বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে, বিশেষ করে মোরশেদুল ইসলামের ‘খেলাঘর’ ও ‘অনিল বাগচীর একদিন’-ছবি দুটিতে তার সাবলীল অভিনয় যথেষ্ট প্রশংসনীয় হয়েছিল। চলচ্চিত্র পরিচালনায় এসেছেন তিনি বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। প্রথম ছবি ‘মৃত্তিকা মায়া’ বিষয়বস্তু, অভিনয়, চিত্রনাট্য এবং পরিচালনার দিক থেকে যথেষ্ট পরিণত একটি কাজ। কয়েক বছরের বিরতির শেষে দ্বিতীয় ছবি নিয়ে তিনি আবার এলেন। ‘গোর’ ছবিটির কাহিনি মূলত রাকায়েতের লেখা একই নামের ৫৫ মিনিটের নাটক অবলম্বনে গড়ে উঠেছে। নাটকটি ১৯৯৪-৯৫ সালে মঞ্চস্থ হওয়ার সময়ে যথেষ্ট সমাদৃত হয়। দীর্ঘদিন পর একই কাহিনি নিয়ে রাকায়েত তার দ্বিতীয় ছবিটি তৈরি করেছেন। তবে মানবিক মূল্যবোধের কারণে ছবির কাহিনির প্রাসঙ্গিকতা সর্বকালীন।
‘গোর’ ছবিটির কাহিনিরেখা গড়ে উঠেছে এক কবর বা গোর খোদকের জীবনের ঘটনাকে অবলম্বন করে। অসহায় লোকটি একসময় ঘর বেঁধেছিল নতুন জেগে ওঠা এক চরে। শত কষ্টের মধ্যেও শিশু কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে ছিল তার ছোট সুখী সংসার। তবে এতই দরিদ্রক্লিষ্ট ছিল সে-জীবন, শিশু কন্যার একটি মাত্র চাওয়া, একটি ছোট পুতুল নিয়ে দেওয়ার সামর্থ্যটুকুও তার ছিল না। কাজের খোঁজে ঢাকাসহ নানা জায়গায় যেতো সে। একবার সে যখন ঢাকায় যায় তখন দেশের দক্ষিণাঞ্চল ঝড়ের কবলে পড়ে। উদভ্রান্ত হয়ে সে-তার চরে ফিরে দেখে মাটিতে মিশে গেছে তার সুখের ঘর, নিস্পন্দ হয়ে পড়ে আছে তার স্ত্রী ও কন্যা আরো অনেকের সাথে। নিজের হাতে সে কবর দেয় স্ত্রী কন্যাকে। জীবনের ঠিকানা হারিয়ে সে পথে নেমে পড়ে। মৃত মানুষের জন্য কবর খোঁড়াই হয়ে ওঠে তার জীবনের ব্রত যার বিনিময়ে সে কিছু নেয় না। সেই ঝড়ের শেষে সে ঢাকা থেকে একটি পুতুল কিনে ফিরেছিল মেয়ের জন্য। সে-পুতুলটিই তার পাথেয় হয়ে ওঠে। একশোটি কবর খোঁড়ার সংকল্প নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায়। ৯৭টি কবর খোঁড়ার পর একসময় সে এক প্রত্যন্ত গাঁয়ে গিয়ে পৌঁছায় যেদিন সেদিন সেখানে একজনের মৃত্যু হয়। কবর খোঁড়ার সূত্রে ঐ পরিবার এবং সেই গ্রামের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। হিন্দু, মুসলমান সবার কাছেই সে গ্রহণযোগ্যতা পায়। সুখে-দুঃখে মিশে যায়। পিতৃ মাতৃ ধর্ম পরিচয়হীন যুবক মজা ক্রমশ তার অনুরক্ত হয়ে উঠে। আরো একজনের মৃত্যুর পর সে শততম কবর খোঁড়ার জন্য দিন গোনে। এর মধ্যে রেহা নামের আরেকটি শিশুকন্যার সাথে তার অপত্য স্নেহের সম্পর্ক তৈরি হয়। যার মূল কারণ তার মৃত শিশু কন্যার নামের মিল। নানা ঘটনার শেষে নিজের খোঁড়া শততম কবরে সে তার প্রাণ বিসর্জন দেয় যার পরিবর্তে ঐ বাড়ির শিশু কন্যাটির প্রাণ রক্ষা পায়।
ছবির কাহিনি রেখার অভিনবত্ব ও মানবিক মূল্যবোধ ছবিটিকে বিশিষ্টতা এনে দিয়েছে। গোর বা ঞযব মৎধাব ছবিটি ইতোমধ্যে পাশ্চাত্যের চলচ্চিত্র রসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণেও সক্ষম হয়েছে। ছবিটি ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেমা সার্কিটে মুক্তি পাবে। প্রখ্যাত মার্কিন চলচ্চিত্র পরিবেশক ইলিয়ট ক্যানবার, যিনি ‘দি গ্রেভ’ ছবির মার্কিন পরিবেশনার দায়িত্ব নিয়েছেন ছবিটি সম্পর্কে তার মতামত টহঁংঁধষ ংঃড়ৎু ধহফ নবধঁঃরভঁষষু ভরষসবফ ভিন্ন স্বাদের কাহিনি রেখাই এই ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য যা গাজী রাকায়েতের লেখা সুগঠিত চিত্রনাট্য ও বাস্তবানুগ সংলাপের মধ্য দিয়ে হৃদয়গ্রাহীভাবে চিত্রায়িত হয়েছে রাকায়াতের দক্ষ পরিচালনায়। চিত্রনাট্য ও তদানুযায়ী পরিশ্রমী চিত্র গ্রহণের মাধ্যমে চরাঞ্চল ও গ্রামীণ বাংলার দৃশ্যপট এবং ডিটেলস চমৎকারভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। হিন্দু, মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নানা লৌকিক আচার বেশ বিশ্বস্তভাবে দৃশ্যায়িত। লং শট ও এ্যারিয়েল শটের ব্যবহার ছবিতে নান্দনিকতা এনে দেওয়ার পাশাপাশি ডিটেলসকেও বিস্তৃত করে তুলেছে। ছবির সম্পাদনাও যথেষ্ট গতিশীল। ছবির চিত্রগ্রহণ করেছেন পংকজ পালিত ও নিয়াজ মাহমুদ। সম্পাদনায় শরিফুল ইসলাম রাসেল। পংকজ পালিত ও রাসেল দুজনেই জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত চিত্রগ্রাহক ও সম্পাদক। এ-ছবিতেও তারা সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছেন। ছবির অভিনয়াংশ যথেষ্ট সাবলীল, মূল চরিত্র গোর খোদকের ভূমিকায় মর্মস্পশী অভিনয় করেছেন গাজী রাকায়েত। দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র জন্ম পরিচয়হীন যুবক মজার চরিত্রেও প্রাণবন্ত অভিনয় করেছেন আশিউল ইসলাম। বিভিন্ন চরিত্রে মামুনুর রশীদ, দিলারা জামান, মৌসুমী হামিদ, সুস্মিতা সরকার, দীপান্বিতা মার্টিন, এ.কে আজাদ সেতু সকলেই চরিত্রানুগ অভিনয় করেছেন।
ছবির শেষ দৃশ্য নিয়ে খটকা থাকতে পারে যে চরম অসুস্থ শিশুকন্যাটি আকস্মিকভাবে বেঁচে উঠলো আর হঠাৎ করে মারা গেলেন আপাত সুস্থ বৃদ্ধ গোর খোদক। জীবন কিন্তু অনেক সময় বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে যায়। তাছাড়া এই নাটকীয়তা ছবির মেজাজের সঙ্গে বেশ খাপ খেয়ে গেছে। ছবির আবহ ও কন্ঠ উভয় সংগীতই সুপ্রযুক্ত ও পরিমিত।
‘দি গ্রেভ’ দ্বিভাষিক ছবি। বহুভাষিক ছবি বাংলাদেশে আগেও তৈরি হয়েছে। তবে মূল স্যুটিং হয়েছে বাংলায় এবং ডাব করা হয় পরে অন্যান্য ভাষায়। দি গ্রেভ স্যুটিং করা হয়েছে বাংলা ও ইংরেজিতে আলাদাভাবে। সেদিক থেকে ‘দি গ্রেভ’ বাংলাদেশের প্রথম ইংরেজি চলচ্চিত্র। অভিনয় শিল্পীরা ইংরেজিতে সংলাপ বলেছেন ভালোই এবং ড. আবদুস সেলিমের লেখা ইংরেজি সংলাপও বেশ ভালো। সব মিলে গাজী রাকায়েতের ‘দি গ্রেভ’ বেশ সুসংহত একটি চলচ্চিত্র।