গৃহপরিচারিকাদের ওপর নির্যাতন বেড়েই চলেছে। বিশেষত শিশু গৃহপরিচারিকাদের ওপর নির্যাতন বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। যৌন হয়রানির শিকার হওয়া তো নারী গৃহপরিচারিকাদের একাংশের জন্য নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমনকি শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা–২০১৫ এর সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মীগণ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্য মতে, সারা দেশে যত গৃহকর্মী আছেন তার ৯৫ ভাগের বেশি নারী। যারা ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের বয়স ১০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। তারা বলছে, এই তথ্য পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য। বাস্তব অবস্থা আরও ভয়াবহ। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) শুধু নারী গৃহকর্মীদের প্রতি সহিংসতার তথ্য সংরক্ষণ করে। তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, কমপক্ষে তিন ভাগের এক ভাগ ঘটনায় কোনো মামলা হয় না। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা আরো কম। আসকের পর্যবেক্ষণ বলছে, অপ্রাপ্তবয়স্কদের মামলার বাদী হন তাদের অভিভাবক। ফলে এক পর্যায়ে গিয়ে তারা অর্থ বা যে কোনো চাপের মুখে আপস করে ফেলেন। আর প্রাপ্তবয়স্ক হলেও বছরের পর বছর মামলা চালানোর পরিবর্তে তারা অর্থের বিনিময়ে মিটিয়ে ফেলেন। তাছাড়া গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা সাধারণত ঘরের মধ্যে হয়। তাই যারা নির্যাতনের শিকার হন তাদের পক্ষে তেমন কোনো সাক্ষী থাকে না। ফলে মামলাটি দুর্বল হয়ে যায়।
দেশে রয়েছে প্রায় ২০ লাখ গৃহকর্মী। এদের ৮০ ভাগই মেয়ে শিশু। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফের এক জরিপে এ তথ্য জানা যায়। এই বিপুল সংখ্যক গৃহকর্মীর সার্বিক কল্যাণ ও গৃহকর্মকে ‘শ্রম’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর ‘গৃহশ্রমিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা–২০১৫’–এর খসড়া অনুমোদন করা হয়। এই নীতিমালায় গৃহপরিচারিকাদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও বর্তমানে গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমিকদের ওপর শারীরিক নির্যাতন, যৌন নিপীড়নসহ বিভিন্নভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উল্লেখজনকভাবে বেড়ে গেছে। শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, থাকা–খাওয়ার বেলায়ও এদের ওপর অমানবিক আচরণ করা হয়।
গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান আজাদীকে বলেন, সরকার ঘোষিত গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫ বাস্তবায়ন না হওয়ায় গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন বেড়েই চলেছে। গৃহকর্মী নির্যাতনের মামলার আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হলে, তদন্ত সুষ্ঠুভাবে হলে এ প্রবণতা কমত। তার মতে, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫ আইনে পরিণত হওয়া দরকার। পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠা জরুরি।
সরকার ২০১৫ সালে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি গ্রহণ করে। এতে গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই নীতিমালায় তাদেরকে মাসের ৭ তারিখের মধ্যে বেতন দেওয়া, চাকরি থেকে অপসারণের অন্তত এক মাস আগে জানানো, কোনো কারণে জানাতে না পারলে ৩০ দিনের বেতন প্রদান করার কথা বলা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী, ১২ বছরের নিচে কাউকে চাকরি দিলে তৃতীয় পক্ষের অনুমতি নিতে হবে। পরিশ্রমের পাশাপাশি বিনোদনের জন্য সময় দেওয়ার কথাও বলা আছে নীতিমালায়।
মাতৃত্বকালীন ছুটি হিসেবে চার মাসের বেতনসহ ছুটি দেওয়ার কথাও আছে এতে। কোনো কারণে গৃহকর্মী অসুস্থ হলে তার সুস্থতার জন্য সম্পূর্ণ খরচের ব্যয়ভার বহন করবে নিয়োগকর্তা। কিন্তু এই নীতিমালাটির বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে।
মহিলা ও শিশু অধিদফতর কর্তৃক গৃহশ্রমিক নির্যাতন রোধে ফোন নম্বরের মাধ্যমে জরুরি সেবার ব্যবস্থা আছে। ন্যাশনাল টোল ফ্রি হেল্পলাইন ১০৯ ডায়াল করলেই তাৎক্ষণিকভাবে সহযোগিতা পাওয়া যাবে। কিন্তু সচেতনতা না থাকায় এই নম্বরে তেমন ফোন আসে না বলে জানান অধিদফতরের কর্মকর্তারা।