গল্পটি একেবারে অন্যরকম। প্রধানমন্ত্রীর মহানুভবতাকে পুঁজি করে ভিন্ন ধরনের প্রতারণার ফাঁদপাতা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী ছাত্র-ছাত্রীদের করোনাকালীন বিশেষ সহায়তা প্রদান করছেন- এমন বিষয়টি বেশ মন ছুঁয়ে গিয়েছিল সবার। কিন্তু বিষয়টিকে পুঁজি করে এমন গল্প সাজিয়ে যে ফাঁদপেতে সর্বনাশের পথ তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছিল তা শুরুতে কেউ বুঝতে পারেননি। কিন্তু শেষপর্যন্ত চক্রটির সকল প্রতারণা ধরা পড়ে। বড় ধরনের সর্বনাশের হাত থেকে বেঁচে যায় ছাত্রীরা। উইমেন কলেজগুলোতে ফোন করে ছাত্রীদের মোবাইল নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য জরুরি ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানোর নাম করে ব্যতিব্যস্ত করে তোলা হলেও ভাগ্যক্রমে চক্রটির কারসাজি ধরা পড়ে। আর এতে প্রতারক চক্রের টার্গেটও ভেস্তে যায়।
সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ, এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ, আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ এবং রাঙামাটি মহিলা কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে ০১৮৭৮৩৫৬১০৪ নম্বর থেকে ফোন করে ভারী ভরাট কন্ঠের একব্যক্তি নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাকালীন সময়ে ছাত্র-ছাত্রীদের দুরবস্থার বিষয়টি বিবেচনা করে এককালীন সহায়তা দিচ্ছেন বলে জানান। এজন্য কলেজের প্রথম বর্ষ থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণির প্রতি বর্ষের একশ’ জন করে ছাত্রীর নাম রোল নম্বর, মোবাইল নম্বর এবং ছাত্রীর পিতা/অভিভাবকের মোবাইল নম্বর দেয়ার অনুরোধ করেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কথাটি বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে তথ্যগুলো দেয়ার জন্য চাপ দেন। কিন্তু কলেজ অধ্যক্ষদের পক্ষ থেকে বিষয়টিকে অত্যন্ত ভালোভাবে গ্রহণ করে বলা হয়, এক ঘণ্টার মধ্যে তো সম্ভব নয়; তবে যত দ্রুত সম্ভব দেয়া হবে। কিন্তু ওই কর্মকর্তার ই-মেইল ঠিকানা চাওয়া হলে তিনি আগে তালিকা তৈরি করতে নির্দেশ দেন। তালিকা নেয়ার সময় ই-মেইল এড্রেস দেয়া হবে বলে জানান।
এদিকে কলেজগুলো বন্ধ। দুর্গাপূজার ছুটি চলছে। অফিসের স্টাফরা ছুটিতে। তবুও একে ওকে ডাকিয়ে এনে তথ্যগুলো যোগাড় করে তালিকা প্রণয়নের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু খটকা লাগে দ্বিতীয় ফোনে। বিকেল নাগাদ ফোন করে তালিকা দেয়ার তাড়া দিয়ে বলা হয়, দ্রুত না দিলে অনুদান দেয়া সম্ভব হবে না। এসময় এনায়েত বাজার মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ তহুরীন সবুর ডালিয়া ই-মেইল এড্রেস দেয়ার জন্য বলেন এবং পরদিন সকাল ১০টার মধ্যে তালিকা পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন বলে কথিত ওই কর্মকর্তাকে জানান। কিন্তু উক্ত ব্যক্তি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একটি ই-মেইল এড্রেস দেয়া হবে বলে অধ্যক্ষকে জানালে তিনি পুরো বিষয়টি নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সহায়তার তালিকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে কেন? এনায়েত বাজার মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ বিষয়টি নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-পরিচালক ড. গাজী গোলাম মাওলার সাথে যোগাযোগ করেন। এই ধরনের কোনো বিষয় আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি ফোন করেন। কিন্তু ড. গাজী গোলাম মাওলা বিষয়টিকে প্রতারক চক্রের বড় ধরনের প্রতারণার ছক বলে উল্লেখ করে তালিকা না দেয়ার পরামর্শ দেন। পরে একে একে অন্যান্য কলেজ থেকেও একই ধরনের ফোন এবং তথ্য চাওয়ার বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে ড. গাজী গোলাম মাওলা ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে সকলকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।
এই ব্যাপারে গতকাল সোমবার এনায়েত বাজার মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ তহুরীন সবুর ডালিয়া সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ফোন করে আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলা হয়েছিল। কিন্তু কোনভাবেই ই-মেইল এড্রেস দিচ্ছিল না। প্রথমে আমরা বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে তার কথাবার্তায় সন্দেহ হলে আমি ড. গাজী গোলাম মাওলার সাথে যোগাযোগ করি। অন্যান্য আরো কয়েকটি কলেজেও একইভাবে প্রতারণার চেষ্টা করা হয়েছিল বলেও তিনি জানান।
এই ব্যাপারে গতকাল গাজী গোলাম মাওলার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বড় ধরনের প্রতারক চক্র একটি ছক তৈরি করে এগুচ্ছিল। অধ্যক্ষরা সচেতন হওয়ায় চক্রটি সুবিধা করতে পারেনি। এতগুলো ছাত্রীর মোবাইল নম্বরসহ ব্যক্তিগত তথ্য যোগাড় করে তারা বড় কোনো অঘটন ঘটানোর চেষ্টা করছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষক গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে জানান, ভয়াবহ রকমের প্রতারক চক্র সক্রিয় রয়েছে। যে কোনো বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো ধরনের তথ্যের আদান প্রদান না করতে তারা সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। চট্টগ্রামের একাধিক মহিলা কলেজে চেষ্টা করেও কোনো ধরনের তথ্য প্রতারকদের হাতে পড়েনি। এতে সংশ্লিষ্টরা স্বস্তি প্রকাশ করে ভবিষ্যতের জন্য সকলকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।