আগামীকাল ৩০ ডিসেম্বর। কেলিশহর উচ্চ বিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্র–ছাত্রী পরিষদ–অত্র স্কুল প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর পূর্তিতে এক হীরকজয়ন্তী উৎসব ও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। প্রথমত: কেলিশহর অতুলনীয় গোত্রের অনন্যসাধারণ একটি গ্রাম। বাঙালির নানা সংগ্রামের ও সংস্কৃতি চর্চার একটি আঁতুড়ঘর। স্কুলটিও গ্রামটির একটি অনবদ্য অচ্ছেদ্য অংশ: একটি ঐতিহাসিক পরিপূর্ণতা।
আদিকাল থেকে কেলিশহর একটি প্রাণবন্ত উজ্জ্বল গ্রাম। ১৮৫২ সালে ‘সংবাদ প্রভাকর’ এর সম্পাদক ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত চট্টগ্রামে ঘুরতে এসে জেলার কেলিশহর সুচক্রদণ্ডী ধলঘাট ডেঙ্গাপাড়া চক্রশালা– গ্রামসমূহকে অতি ভদ্রগ্রাম হিসেবে অভিহিত করে ‘জিলা চট্টগ্রামের পুরাতন ও নতুন বিবরণ’ নামক এক প্রবন্ধ লিখেন। অনেকের মতে মগদের এখানে স্থিত তৎকালের কিল্লাঘর থেকে কিল্লাশহর তথা কেলিশহর নামের উৎপত্তি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে চট্টগ্রাম শহরের ফিরিঙ্গীবাজারে স্থিত যতীন্দ্র মোহন সেন প্রতিষ্ঠিত জে. এম. সেন. উচ্চ বিদ্যালয়টির পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী কেলিশহর নিবাসী শ্রী রমণীমোহন চক্রবর্ত্তী এম.এ.বি.এল.; যুদ্ধের কারণে সেখানে ব্রিটিশ সৈন্যরা অস্থায়ী ঘাঁটি করলে স্কুলটি কেলিশহরে সাময়িক স্থানান্তরিত হয়, তখন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন নগেন্দ্র লাল দে এম এ। স্কুলটি যুদ্ধ শেষে শহরে চলে এলে কেলিশহরে তার অবকাঠামোগত স্থাপনায় অধ্যাপক সুবোধ রঞ্জন রায়, এডভোকেট চিত্তপ্রিয় দাশ, ইংরেজী সাহিত্যবিদ শিশির চৌধুরী ও তার ভাই সুধীর চৌধুরী এমএ, এবং সতীশ চন্দ্র চক্রবর্ত্তী(শর্মা) প্রমুখের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় ১৯৪৭–এ কেলিশহর উচ্চ বিদ্যালয়ের শুভ সূচনা হয়। ‘৪৭ এর পহেলা জানুয়ারি কেলিশহর ইউনিয়ন বোর্ডের তদানীন্তন চেয়ারম্যান হরগোবিন্দ ভট্টাচার্য্যের সভাপতিত্বে প্রথম কেলিশহর উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদ গঠিত হয়, পরিষদে ছিলেন–রমণী মোহন চক্রবর্ত্তী এম.এ.বি.এল, আলামপুর নিবাসী অধ্যাপক হীরেন্দ্র লাল সেনগুপ্ত (এম এ গোল্ড মেডেলিস্ট,সহ–অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম কলেজ), মৌলভী ইউসুফ আলী ও ডা. বিনয় ভূষণ চৌধুরী প্রমুখ। পরিষদ ২রা জানুয়ারি ‘৪৭ রমণীমোহন চক্রবর্ত্তীকে সভাপতি, হীরেন্দ্র লাল সেনগুপ্তকে সহ–সভাপতি, সুবোধ রঞ্জন রায়কে সম্পাদক নির্বাচিত করে। স্বর্গতঃ শ্রী অন্নদা কুমার চৌধুরী খননকৃত ১.৮৫ একরের পুকুরটি স্কুলকে দান করেন যার পাড়ে স্কুলটি স্থাপিত হয়। এ সময়ে শ্রী নীরেন্দ্রনাথ লাল চৌধুরী এমএবিএল প্রধান শিক্ষক, হরিপ্রসাদ সেন বিএবিএল সহকারী প্রধান শিক্ষক, সরোজ রঞ্জন রায় বিএসসি, সামছুল আলম বিএ,ভূপেন্দ্র নাথ চৌধুরী বিএ, রাজ্যেশ্বর চক্রবর্ত্তী বিএ,ও মৌলভী নুরুচ্ছফা–কে স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। স্কুলের গৃহ নির্মাণে স্থানীয় কৃষক ও দিন মজুররা স্কুল তৈরির বিবিধ উপকরণ সরবরাহ সহ স্বেচ্ছাশ্রম প্রদান করতঃ এ স্কুল প্রতিষ্ঠার পথ সহজ ও সুগম করেন। তৎকালের বহু শিক্ষক যৎসামান্য বেতনে স্কুলে আন্তরিক পাঠদান করেছেন, অনেকে যেমন সরোজ রায় বেতনও নেননি, যাঁদের নাম এখনো প্রাতঃস্মরণীয়। পড়াশুনার পাশাপাশি বার্ষিক নাটক নাচ গান আবৃত্তি সহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলা সাঁতার ও বিভিন্ন দিবস পালন নির্ভর অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া লেগেই থাকতো। এ গ্রামে ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘রূপনিকেতন’ প্রতিষ্ঠানটি সঙ্গীত ও সংস্কৃতিচর্চার পরিপুরক হিসেবে কাজ করেছে। শ্রী সুধীর চৌধুরী এম এ স্কুলকে চারটি পুকুর দান করেন যার আনুমানিক বার্ষিক আয় তিন লক্ষ টাকা। এভাবে সেই থেকে এই স্কুল সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে।
২০০৮ সালে নানা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কেলিশহর স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র–ছাত্রীদের নিয়ে একটি পরিষদ গঠিত হয়। পহেলা আগস্ট ২০০৮ সালে কেলিশহর আর্বাণ কো–অপারেটিভ ব্যাংকের তৎকালের খোলা নীচতলায় পরিষদের প্রথম সভা হয়। ২০০৯ সালের ২৭ মার্চ ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে এই সংগঠনের এক বর্ণাঢ্য পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান হয়। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে এটিকে একটি উদারনৈতিক গতিশীল প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী পরিষদে ও সমাজকল্যাণমূলক সংগঠনে রূপ দিতে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। এরপরের ১৪ বছর আমি সভাপতির দায়িত্বে থেকেছি। ২০২২–এ এসে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। উল্লেখ্য, ২০০৯ এর পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে ভূমিদানের কয়েকটি ঘোষণামূলক প্রতিশ্রুতিও ছিল। এ বছর সেই প্রতিশ্রুতির নিরিখে স্কুলের ‘৮০ ব্যাচের ছাত্র শ্রী অরুণ চক্রবর্তী উক্ত পরিষদকে ১০ গণ্ডা জায়গা দান করে সেখানে একটি মাল্টিপারপাস কমপ্লেঙ তৈরির সুযোগ করে দিলেন, যেখানে হতে পারে তরুণ–তরুণীদের জন্য একটি কারিগরী শিক্ষা কেন্দ্রও। ২০০৯ এর অনুষ্ঠান থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে সঞ্চয় করেছিলাম যা এখন বেড়ে প্রায় দু‘লক্ষ টাকা এবং এটি প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের একটি একাউন্টে গচ্ছিত রেখেছি, এ টাকা প্রাক্তনদের কাজে লাগবে দেখে আমি অত্যন্ত তৃপ্ত ও আনন্দিত।
২০০৯ এর পুনর্মিলনীতে আমার সম্পাদনায় একটি সমৃদ্ধ তথ্যবহুল পুনর্মিলনী স্মারক বের হয়েছিল যার নাম ছিল ‘খাড়াং‘। প্রসঙ্গতঃ, খাড়াং শব্দটি চট্টগ্রামের লৌকিক গ্রামীণ আঞ্চলিক শব্দ যা বেত ও বাঁশের তৈরি ঝুড়ি বুঝায়, এটি গ্রামবাংলার লোকজ শব্দ–স্মারক। এটি বিভিন্ন বর্ণের আকারের স্বাদের ফসল সংরক্ষণে পরিবহনে চট্টগ্রামে ব্যবহৃত হাজার বছরের অপরিবর্তনীয় উপযুক্ত আধার। স্বভাবতই এটা লৌকিক আঞ্চলিক মৌলিক শব্দ। আর তাই ‘অংকুর– উঠান’ সহ নানা নাম মাথায় এলেও খাড়াং শব্দটি আমরা জাতি ধর্ম বর্ণ উঁচু নীচ হীন ক্ষীণ দীন নির্বিশেষে সকলের সম্মিলনের জন্য এই সংকলনের নামকরণার্থে কাজে লাগিয়েছিলাম। বলাবাহুল্য নামটি ছিল আমার দেয়া। তবে লোকজ ও কৃষিজ শব্দগুলো আজকের ফাস্টফুড, নোট বই ও পিৎজাহাটের যুগে অনেকেই পছন্দ করেন না। যা হোক। এবারের পুনর্মিলনীতে বর্তমান আহ্বায়ক কমিটি প্রকাশিতব্য সংকলনের নাম পরিবর্তন করে আরো সুন্দর নাম রেখেছেন– প্রথমে ‘প্লাটিনাম‘ ও পরে তা পরিবর্তন করে ‘চিরন্তন‘।
২০০৯ এ আমাদের অনুষ্ঠানের পরে স্বর্গীয় শিক্ষক শ্রদ্ধেয় দাদা শ্রী বাদল দে এবং স্বর্গীয় প্রধান শিক্ষক শ্রী বাবুল কান্তি দে–র নেতৃত্বে অন্য নামের একটি প্রাক্তন ছাত্র–ছাত্রীদের সংগঠনের উদ্যোগে আরো একটি পৃথক ও ভিন্ন অনুষ্ঠান হয়েছিল। শুনেছি এ অনুষ্ঠানও সার্বিক সুন্দর হয়েছে এবং ‘দর্পণ‘ নামে একটি ভালো সংকলনও বের হয়েছিল।
এবারের পুনর্মিলনীর সংকলনে ২০০৯ এ ‘খাড়াং’ এ প্রকাশিত কতগুলো অমূল্য অভিজ্ঞতালব্ধ লেখার পুনর্মুদ্রণ এলাকার ও স্কুলের সাংস্কৃতিক শিক্ষাগত ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় সহায়ক হতে পারে। স্কুলের কৃতি ছাত্র প্রয়াত ইঞ্জিনিয়ার তপন দাশ, অধ্যাপক মাদল দে, কৃতি ছাত্র ও অনন্য সমাজ ব্যক্তিত্ব সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট হরিসাধন দেবব্রহ্মণের লেখা ত্রয়ী‘র মূল্য বিবেচনায় পুনরায় সংকলনে যুক্ত করলে ভালোই হবে। অনুরূপ এ স্কুলের উজ্জ্বল নক্ষত্র কানাডায় বসবাসরত ইলা কানুনগো, সমর ভঞ্জ, সংগঠক সুনীল বিশ্বাস, লে. কর্ণেল(অবঃ) নার্স বেলা পাঠক, স্কুলের এবং পরিষদের পরম শুভানুধ্যায়ী চন্দনা কানুনগো, শিক্ষিকা স্বপ্না দাশ গুপ্তা‘র লেখা একটা যুগের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য শিক্ষণীয় এ লেখাগুলো গতানুগতিকতার বাইরে হওয়ায় এগুলি তাদের জন্য আদর্শের উদ্দীপনার উৎস ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্তস্থল হতে পারে। তাছাড়া সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রাজকুমার দে‘র উপর গৌরি দে‘র লেখা ও শিক্ষক শশধর মুখার্জির উপর নেপাল মুখার্জির লেখা দু‘টি–ও যেতে পারে। তবে পুরোনো লেখা হওয়ার কারণে বর্তমান আহ্বায়ক কমিটি এগুলি নির্বাচিত করবেন কিনা জানা নেই। আহ্বায়ক কমিটি লেখাগুলি বিবেচনায় রাখলে সংকলনটি প্রাক্তন ছাত্রদের সম্মিলিত ছবির বই হওয়া ছাড়াও এলাকার ও স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস ও তথ্য সংরক্ষণের সমৃদ্ধ সংকলন হয়ে উঠতে পারে। দিনের শেষে কেলিশহরের জন্য এসব লেখাগুলিই কালজয়ী, যেন– ব্যাবিলনের হাম্বুরাবি‘র শিলালিপি, মিশরের হায়ারোগ্লিফ চিত্রলিপি, অশোকের প্রস্তর গাত্রের লিখন, রোম সাম্রাজ্য বা মধ্যপ্রাচ্যের প্যাপিরাস স্ক্রল, কিম্বা ব্রাজিল সভ্যতার ইনকা লেখনি। সুতরাং, মৃতের লেখা কথা কয়না– এ কথা আদৌ সত্য নয়। বরং এসবের সংরক্ষণই যুগোপযোগী প্রায়োরিটি বা প্রাধান্যগত বিবেচনার বিষয়।
শত বর্ষ পালন করবে একদিন এ স্কুল। আমরা তখন থাকবো না। তবে আমরা উদযাপনের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার যে কর্মসূচি ২০০৮ এ শুরু করলাম তার মশাল আমাদের উত্তরসূরীরাও প্রজ্বলিত রাখবে এবং সে মশাল সামনে এগিয়ে দেবে, এ আশাই করি। আগত ও অনাগত সকলকে হৃদয়ভরা শুভেচ্ছা।
লেখক : শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ, কবি ও কলামিস্ট, মানবাধিকার কর্মী।