এই বছর নতুন শিক্ষাক্রম শুরুর প্রাক্কালে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিতরণকৃত বইয়ের মান দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। এই নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা সমালোচনার মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী জানান পর্যাপ্ত হোয়াইট প্রিন্ট কাগজের অভাবে এই রকম কাগজে বই ছাপানো হয়েছে। অথচ এশিয়ার সর্ববৃহৎ কাগজ কল কর্ণফুলী পেপার মিল বাংলাদেশে অবস্থিত। ১৯৫৩ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় এই মিল প্রতিষ্ঠিত হয়। কর্ণফুলী পেপার মিল শিল্প আইনের অধীনে নিবন্ধিত প্রথম কাগজ শিল্প যাতে ত্রিশ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছিলো। মিলটি আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, সুইডেন এবং ইতালির সহযোগিতায় ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় স্থাপিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্যমাত্রা ছিল বার্ষিক ৩০ হাজার মে. টন কাগজ। ১৯৫৩ সালের ১৬ই অক্টোবর এটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায়।
বর্তমানে এটি ঋণে লোকসানে জর্জরিত হয়ে ‘মুমূর্ষু’ অবস্থায় আছে, কমেছে এর উৎপাদন ক্ষমতা। বিগত ২০২১–২২ বছরে উৎপাদিত হয়েছে মাত্র ২,২৭৬ টন কাগজ। তবে একসময় প্রতিষ্ঠানটির মানসম্পন্ন কাগজের কদর ছিল দেশজুড়ে। প্রকাশনাসহ নানা কাজে ব্যবহার হতো সেই কাগজ। এখন এটি ‘মান্ধাতার আমলের’ প্রযুক্তি ও কম জনবল নিয়ে চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বছরের অর্ধেক সময় বন্ধ থাকছে কারখানার উৎপাদন। ফলে বছরে উৎপাদন ঠেকেছে ২ থেকে ৬ হাজার টনে। কিন্তু কেন এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির এই দশা? কারণ গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে এই কারখানার বড় কোনো সংস্কার হয় নি। পুরানো লক্কর ঝক্কর যন্ত্রপাতি দিয়ে চলে এর উৎপাদন প্রক্রিয়া। এতে করে যন্ত্রপাতিগুলো প্রতি মুহূর্তে বিকল হয়ে পড়ে। ফলে উৎপাদন তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। কাগজের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) অধীনে কেপিএম পরিচালিত হয়। প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার একর জায়গা নিয়ে কারখানাটি অবস্থিত। এরমধ্যে মিলের ক্রয়কৃত জমির পরিমাণ প্রায় ৩২.৪৭ একর, লিজপ্রাপ্ত জমি পরিমাণ ১১৯২.৯৬ একর এবং এটির মিল এলাকা ৪৪২.৩২ একর। এর অন্যতম প্রধান কাঁচামাল হল বাঁশ। নিরবিচ্ছিন্ন কাঁচামাল প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য রাইংক্ষং এলাকায় লিজপ্রাপ্ত প্রায় ৮৩,৪০৮ একর এবং কাচালং এলাকায় লিজপ্রাপ্ত প্রায় ৪২,৮৬৯ একর জমিতে বাঁশ চাষ করা হয়।
তবে দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় কারখানার জরাজীর্ণ ভবনগুলোর ছাদ ভেঙে গেছে। পলেস্তার খসে পড়ছে, মরিচা পড়েছে এর যন্ত্রপাতিতে। কারখানাটির গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যান্ট ৯টি।
এগুলো হলো চিপস ওয়াশিং প্ল্যান্ট, পাল্প স্ক্রিনিং প্ল্যান্ট, বাঁশ ও কাঠকে মণ্ডে রূপান্তর করার প্ল্যান্ট, মণ্ড সাদা করাসহ নানা কাজের জন্য ব্লিচিং টাওয়ার, কেমিক্যাল প্ল্যান্ট, অঙিজেন সিস্টেম, বয়লার, এয়ার কমেপ্রশার ও কাগজ তৈরির মূল প্ল্যান্ট।
এই কারখানায় কাগজ তৈরীর প্রক্রিয়ায় প্রথমে চিপস ওয়াশিং প্ল্যান্টে বাঁশ ও কাঠকে টুকরা টুকরা করা হয়। এটির দুটি ভাগ। বর্তমানে এর একটি অংশের ছাদ নেই। আরেকটি অংশে টিনের ছাউনি। সেই টিনও ফুটো হয়ে গেছে, দেয়ালে ফাটল ধরেছে। শ্রমিকেরা জানান, প্ল্যান্টটি বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে। মাঝেমধ্যে চালু করা হয়। তবে কাজ তেমন একটা হয় না।
ওয়াশিং প্ল্যান্টের পাশে মণ্ড তৈরির প্ল্যান্ট। ২০১৭ সালে থেকে প্ল্যান্টটি বন্ধ। যন্ত্রগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে। দেয়ালের গায়ে জন্মেছে শেওলা। এটি বন্ধ থাকায় কাগজ তৈরির পাল্প বা মণ্ড আমদানি করে কারখানা চালানো হয়। মণ্ড তৈরির প্ল্যান্টের মতো একই অবস্থা ব্লিচিং টাওয়ারেরও। ২০১০ সালের দিকে প্রায় ৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় এটি। নতুন তৈরি এই প্ল্যান্ট অন্তত তিন বছর ধরে কোনো কাজে আসছে না। এই প্ল্যান্টে বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করে মণ্ডকে সাদা করা হতো। বিশেষত ক্লোরিনের মাধ্যমে মণ্ডকে প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। কিন্তু ক্লোরিনের যন্ত্রটি নষ্ট হওয়ায় প্ল্যান্টটি বন্ধ হয়ে গেছে।
অভিযোগ আছে, ব্লিচিং টাওয়ার চালুর সময়েই নিম্নমানের যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়েছিল। এ কারণে শুরুর চার থেকে পাঁচ বছরের মাথায় বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বিকল হওয়া শুরু করে। কেপিএমের রয়েছে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থা। বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নষ্ট হওয়ার কারণে গ্যাসচালিত এই বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট প্রায় এক মাস বন্ধ থাকার পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে চালু করা হয়েছে। অন্যদিকে কেমিক্যাল প্ল্যান্ট বন্ধ আছে অন্তত ১০ বছর।
বর্তমানে কেপিএমে কর্মরত আছেন ৪১ কর্মকর্তা ৩৯ কর্মচারী ও ১৮০ জন শ্রমিক। প্রতি টন কাগজ উৎপাদনে লোকসান হয় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। কেপিএমে এখন প্রতি টন কাগজ উৎপাদনে খরচ হয় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু বিক্রয় মূল্য ৯৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। বেতনভাতা, মেরামত, উৎপাদন ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি মিলিয়ে বছরে গড়ে ৪৫ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বিসিআইসির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১০ বছরে কেপিএম লোকসান দিয়েছে ৪৫৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। তবে ২০০৮–০৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি ৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা লাভ করেছিলো। তখন কাগজের উৎপাদন ছিল ২৪ হাজার ২০০ টন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিসিআইসির কাছে কেপিএমের প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ঋণ আছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালে প্রকাশিত বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কেপিএমের যন্ত্রগুলো পুরোনো। বড় সংস্কারের কাজ তিন দশক ধরে হয়নি। ঠিকমতো হয় না রক্ষণাবেক্ষণের কাজও। এ কারণে কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম ঘন ঘন ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় লোকসান দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। অকেজো পুরোনো যন্ত্রপাতিগুলো সংস্কারের সুযোগ নেই। কারণ যন্ত্রাংশগুলো বাজারে পাওয়া যায় না। ফলে সংস্কার করলেও তেমন ফল হবে না। তবে কেপিএমের এমন দুরবস্থার জন্য কর্তৃপক্ষের গাফিলতিকে দায়ী করছেন কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকেরা। তাঁরা বলেন, যন্ত্রগুলো যখন সংস্কারের দরকার ছিল, তখন করা হয়নি। দিনের পর দিন ফেলে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি দক্ষ জনবল নিয়োগ দেয়নি কর্তৃপক্ষ, নিয়োগে ছিল স্বজনপ্রীতি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেপিএমে একসময় ২৩ রকমের কাগজ উৎপাদন হতো। এখন উৎপাদন হয় তিন থেকে চার ধরনের কাগজ। সাদা কাগজ, স্পেশাল রাইটিং পেপার, রঙিন কাগজ ও ব্রাউন সালফেট কাগজ। তবে সেই কাগজের মানও কমে গেছে বলে জানান বিভিন্ন ছাপাখানার মালিকেরা। এদিকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বছরে কাগজের চাহিদা ১৫ থেকে ১৬ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় ১০ থেকে ১২ লাখ মেট্রিক টন। বাকি কাগজ আমদানি করতে হয় বিভিন্ন দেশ থেকে।
তবে কেপিএমের পুরোনো যন্ত্রপাতি বদলে নতুন পাঁচটি কারখানা তৈরির পরিকল্পনা করছে বিসিআইসি। কেপিএমের কর্মকর্তারা জানান, নতুন কারখানায় থাকবে আধুনিক যন্ত্রপাতি। এটি হবে সমন্বিত কারখানা। থাকবে বিদ্যুৎকেন্দ্র সহ নানা সুবিধা। প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ সমপ্রতি শেষ হয়েছে। কেপিএমের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, এখন কেপিএমে যে যন্ত্রপাতি রয়েছে, তা দিয়ে মানসম্মত কাগজ তৈরি করা সম্ভব নয়। একসময় সরকারি বইপত্র ছাপানো হতো কেপিএমের কাগজ দিয়ে। এখন ছাপতে গেলে কালি ছড়িয়ে যায়। ফলে ওখানে নতুন করে কারখানা তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৩০–৪০ বছর আগ পর্যন্ত কেপিএম ছিলো কর্মব্যস্ত একটি প্রতিষ্ঠান। তখন এতে ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করতো।
প্রায় ৩০ হাজার টন নানা রকমের মান সম্পন্ন কাগজ উৎপন্ন হতো। যা দিয়ে দেশের সম্পূর্ণ চাহিদা মিটানো হতো। তখন প্রতিনিয়ত লাখ লাখ মানুষের যাতায়াতে মুখরিত ছিলো কারখানা এলাকা। হাজার হাজার মানুষের জীবন জীবিকা আবেগ অনুভূতি জড়িত ছিলো কেপিএমের উৎপাদনের সাথে। এই কারখানাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে চন্দ্রঘোনা এলাকার বাজার ও স্থাপনা। সারাক্ষণ কারখানার আওয়াজ ও মানুষের কর্ম চাঞ্চল্য ছিলো চোখে পড়ার মত। কিন্তু কর্তৃপক্ষের স্বজন প্রীতি, অদক্ষতা, সিদ্ধান্তহীনতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় একটি কর্মদক্ষ প্রতিষ্ঠান আজ মৃতপ্রায়। তাই কেপিএম নিয়ে সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। প্রয়োজনবোধে কেপিএমকে মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসির অধীনে না রেখে বিকল্প উপায় খুঁজে বের করা উচিত। তবেই হয়ত ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি এই যাত্রা বেঁচে যেতে পারে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট